মিলন ছিল প্রাণখোলা মানুষ

ডা. শামসুল আলম খান মিলন
ডা. শামসুল আলম খান মিলন

আজ ২৭ নভেম্বর, শহীদ ডা. মিলন দিবস, নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান দিবস। এদিন আনুমানিক সকাল ১০টা ৩০ মিনিটে টিএসসি এবং বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরির কোণে তৎকালীন স্বৈরশাসক এরশাদের ঘাতক বাহিনী একটি মাত্র বুলেটের অব্যর্থ আঘাতে মিলনের প্রাণপ্রদীপ নিভিয়ে দিয়েছিল।
বাসায় মিতবাক মানুষটি বন্ধুদের সান্নিধ্যে একেবারে যেন অন্য মানুষ হয়ে যেত। আড্ডায় আর প্রাণখোলা হাসিতে সবাইকে মাতিয়ে তুলত। পরিচিত, স্বল্প পরিচিত—সবার সঙ্গে অতি সহজেই একটা হৃদ্যতার সম্পর্ক গড়ে তুলতে ওর বেশি সময় লাগত না। রাজনীতিতে, আন্দোলন-সংগ্রামে যারা ওর সংস্পর্শে এসেছে, তাদের সবার অকুণ্ঠ ভালোবাসা অর্জন করেছে নিজ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের গুণে।
ডা. এম এ মাজেদ যখন ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন, মিলন তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগ শাখার (জাসদ) সভাপতি ছিল। ডা. মাজেদ সাহেব মিলনের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে এক জায়গায় লিখেছেন, ‘প্রায়ই কলেজের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আমাদের বসতে হতো। যুক্তিবাদী এই ছাত্রটির প্রতি তখন থেকেই আমার মনে শ্রদ্ধা জন্মাতে শুরু করে। আপসহীন দৃঢ়চেতা কিন্তু কী বিনয়ী ও নম্র। যখন তার সঙ্গে একমত হতে পারিনি, তখনো তাকে উত্তেজিত হতে দেখিনি। মানুষ হিসেবে সে যে কত উঁচু মাপের ছিল, তা তার বিভিন্ন আচরণ থেকে উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম।’
ডায়েরি লেখার অভ্যাস ছিল মিলনের। তখনো মুঠোফোন আসেনি দেশে। বিদেশে অবস্থানরত বন্ধুদের সঙ্গে চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ করত, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি জানাত। ওই সময় এক বন্ধুকে চিঠি লিখেছিল, ‘রাজা আসে রাজা যায়। মানুষের ভাগ্যের লীলাখেলা, রাজার আগমন-নির্গমনের সঙ্গে সঙ্গে অ্যাক্রোবেটিক চালে পরিবর্তিত হয়। এই তো তৃতীয় বিশ্ব, এই তো দরিদ্র দেশ। এখানে ব্যক্তিগত সুখ, শান্তি থাকতে পারে না। দেশ আমাদের সুখ দিতে পারেনি। আমাদের এমনই দীনদশা যে, দেশের কোনো একটি অর্থনৈতিক প্রোগ্রামও আমাদের একটু শান্তি-সুখের আশ্বাস দেয়নি। অর্থনৈতিক ভিত্তি যেখানে দুর্বল, স্বর্গীয় প্রেমও সেখানে তড়িতাহত হয়।’ তাই নিজেকে কঠোর প্রতিজ্ঞায় দীপ্ত করেছিল সমাজ বদলের লক্ষ্যে, সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে। মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছিল প্রগতিশীল সমাজতন্ত্রের দর্শন। আজীবন স্বপ্ন ছিল এ দেশের শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের ভাগ্যবদলের। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মিছিলগুলোতে ওর সরব উপস্থিতি ছিল। ১৯৮০ সালে বন্ধুকে চিঠিতে লিখেছে, ‘এই বিশ্বের কোটি কোটি শৃঙ্খলিত, নিপীড়িত মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা শোষণ, শ্রেণি বিভাজন আর বৈষম্যের বিরাট পাহাড়টাকে যেকোনো প্রকারেই হোক, আমাদের অতিক্রম করতে হবে।’ আমরা দেখেছি এই বিশাল পাহাড়টা অতিক্রম করতে মিলন ওর জীবন বাজি রাখতেও কুণ্ঠাবোধ করেনি।
১৯৯০-এর সামরিক সরকার উৎখাত করার উদ্দেশ্য ছিল দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা, দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরিয়ে আনা। কিন্তু দীর্ঘ ২৫ বছর অতিক্রান্ত হলেও আজও জনগণের সে আশা পূর্ণ হয়নি। নব্বইয়ের পর বারবার ক্ষমতার হাতবদল হয়েছে মাত্র। গণতন্ত্র এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছে। বর্তমানে সরকার বলছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ চলবে। বাস্তবতা হলো, আজ আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে অনেক দূরে সরে এসেছি। বিজ্ঞজনেরা বলেন, দেশে যথাযথ গণতন্ত্রের অভাবে জন্ম নিচ্ছে জঙ্গিবাদ, দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি, সন্ত্রাসবাদ, খুন, গুম, দখলবাজি, রাহাজানি।
দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, আমাদের দেশের রাজনীতিতে নারী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা ও দেশের সরকারপ্রধান একজন নারী হওয়া সত্ত্বেও আজ দেশের গ্রামগঞ্জে কোথায়ও নারীদের নিরাপত্তা নেই। পথেঘাটে, এমনকি চলন্ত বাসে পর্যন্ত নারীরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। শিশুরাও এসব নরপশুর হাত থেকে নিস্তার পাচ্ছে না। ভেবে অবাক হই, আমরা এ কোন সমাজে বাস করছি? সমাজ বিশ্লেষকদের মতে, বিচারহীনতার কারণে সমাজে দিন দিন অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। দুর্নীতি আজ সর্বগ্রাসীরূপে দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি টিআইবির এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ এ বছর দুর্নীতির সূচকে আগের বছরগুলোর তুলনায় আরও নিচের সারিতে চলে আসবে। ইতিপূর্বে পরপর পাঁচবার বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল। আজও সেই অবস্থার উত্তরণ ঘটেছে বলে মনে হয় না।
পত্রপত্রিকায় দেখি দেশে উন্নয়নের জোয়ার বইছে। জিডিপির হার বৃদ্ধি পেয়েছে ৭ শতাংশের ওপরে। স্বাস্থ্য খাতের অনেক উন্নতি হয়েছে। দেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে চলেছে। দেশের এমন উন্নতি আর সম্মানের কথা শুনে আমরা সত্যি আনন্দিত হই, গর্ববোধ করি। কিন্তু হাটবাজারে গিয়ে যখন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী আকাশচুম্বী মূল্যে কিনতে হয়, তখন মনে আনন্দ আর থাকে না। এ কারণে বোধ হয় বাংলাদেশের নারী ও শিশুর অপুষ্টির হার বেশি। স্বাস্থ্য খাতের উন্নতির নামে স্বাস্থ্য খাতকে বাণিজ্যিকীকরণ করা হয়েছে। সেখানে দুস্থ রোগীদের কথা তো বাদই, মধ্যবিত্ত শ্রেণিও স্বাস্থ্যসেবা নেওয়ার ক্ষমতা রাখে না।
গণতন্ত্রের সমস্যা, বিচারহীনতা, নীতিহীনতা, আর নষ্ট রাজনীতি আজ সমাজকে, তরুণসমাজকে অবক্ষয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। হতাশা আর বঞ্চনার শিকার হয়ে তরুণেরা আজ জঙ্গিবাদ আর মাদকাসক্তির দিকে ঝুঁকে পড়ছে। তারা আজ রাজনীতিবিমুখ। অথচ এই মুহূর্তে দেশ ও সমাজকে সব অবক্ষয় থেকে রক্ষা করতে হলে তরুণদের এগিয়ে আসতে হবে। তারাই পারবে এ দেশকে আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত করতে, জঙ্গিবাদের আগ্রাসন থেকে রক্ষা করতে। যেমন আসাদ, মিলন, নূর হোসেনরা জীবন দিয়ে দেশকে রাহুমুক্ত করেছিল।
সেলিনা আখতার: শহীদ ডা. মিলনের মা।