মিসরের অবস্থা ইরাকের মতো হতে পারে

বিদ্রোহ দমনের, অর্থাৎ ‘সন্ত্রাসবাদ’বিরোধী যুদ্ধে সব সময়ই দুর্নীতি ও পাল্টা খুন হয়। এখন মিসরও তার প্রতিবেশীদের মতো এক দূষিত পথ অনুসরণ করতে শুরু করেছে। ব্যাপারটা হচ্ছে, তারা সিনাইয়ে আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এক খুনি বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে নামিয়ে দিয়েছে। অধিকাংশ সেনাবাহিনীরই ছায়া মিত্র থাকে, যারা তার তথ্য সরবরাহকারী হিসেবে কাজ করে। এরা আবার বেসামরিক লোকদের সঙ্গে নৃশংস আচরণ করতে পারে। ১৯৭৬ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত সিরিয়া, ইরাক, তুরস্ক, ইসরায়েল প্রভৃতি দেশ লেবাননের যে রক্ষীবাহিনী গড়ে তুলেছিল, তাদের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। কিন্তু শেষমেশ দেখা গেল, সব দেশই এই মিত্রদের নৃশংসতায় লজ্জিত হয়েছে।

কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে যে মিসর সিনাই উপদ্বীপে উর্দিধারী রক্ষীবাহিনী মোতায়েন করছে। কারণ, সেখানকার বড় অংশ আইএস দখল করে নিয়েছে। মিসরের এই প্রেসিডেন্ট কিন্তু দেশটির প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে উৎখাত করেছিলেন। বোঝা যাচ্ছে, আইএসবিরোধী যুদ্ধ কোন পর্যায়ে চলে গেছে যে মিসরের প্রেসিডেন্ট একজন ফিল্ড মার্শাল হওয়া সত্ত্বেও এই পদক্ষেপ নিলেন। এখন মিসরের পুলিশ ও সেনাবাহিনীর ওপর প্রতিদিন হামলা হয়। অন্যদিকে বেসামরিক মানুষ পালিয়ে যাচ্ছে। তাদের মনে যেমন আইএসের ভয় আছে, তেমনি সেনাবাহিনীর ‘সহযোগীদের’ ব্যাপারেও তাদের ভয় আছে। এরা নাকি ‘সন্দেহভাজন’ ব্যক্তিদের তুলে নিয়ে হত্যা করছে।

কায়রোতে একাধিক ভিডিও ফুটেজ রাষ্ট্র হয়ে গেছে। সেগুলোতে দেখা যাচ্ছে, দুই বেসামরিক নাগরিককে সামান্য জিজ্ঞাসাবাদ করার পর রাইফেল দিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। আরেকটি ভিডিওতে আটজন বেসামরিক নাগরিকের মরদেহ দেখা যাচ্ছে, যার মধ্যে দুজনের লাশ আগের ভিডিওতেই দেখা গেছে। দৃশ্যত, তারা সন্ত্রাসী—এটা বোঝানোর জন্য তাদের মরদেহের পাশে অস্ত্র শোয়ানো আছে। মিসরীয় সেনাবাহিনীর এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা এই মৃত্যুদণ্ডের নির্দেশ দিচ্ছেন। এই ভিডিওগুলো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে পাওয়া যাচ্ছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এগুলো দেখে নিন্দা জানিয়ে বলল, এটা জঘন্য কাজ হয়েছে। তারা ইঙ্গিত দিল, সিনাইয়ে মিসরীয় সরকারের অভিযান ‘নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে’। তারা এ-ও বলল, যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া সশস্ত্র গাড়িতে বন্দীদের হত্যাকাণ্ডের স্থানে আনা হয়েছে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ দাবি করছে, মিসরীয় সেনাবাহিনী যত দিন মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ না করছে, তত দিন যেসব দেশ মিসরীয় সেনাবাহিনীকে অস্ত্র, সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, তাদের উচিত হবে এই সহায়তা বন্ধ করে দেওয়া। তাদের এই দাবি আকাশকুসুম কল্পনার শামিল।

মাথাগরম মার্কিন প্রশাসন ও তাদের ভারসাম্যহীন প্রেসিডেন্ট নিরপরাধ মানুষের মৃত্যু নিয়ে মোটেও চিন্তিত নন। সম্প্রতি তারা মানবাধিকারের ব্যাপারে বাহরাইনের সরকারের সংখ্যালঘু অংশ ও রাজতন্ত্রের উদ্বেগকে মোটেও পাত্তা না দিয়ে দেশটির কাছে এফ-১৬ বিমান বিক্রি করতে সম্মত হয়েছে। রাশিয়া যখন সিরীয়দের রক্ষায় এগিয়ে এসেছিল, তখন কি তারা এমন দাবি করেছিল? বেসামরিক সুন্নি নাগরিকেরা ফালুজা ছেড়ে যাওয়ার সময় শিয়া জঙ্গিরা তাদের গুম করে দিচ্ছিল, সে সময় মার্কিন সেনারা ইরাকি সেনাদের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে পাহারা দিচ্ছিল। এই সুন্নি বেসামরিক নাগরিকেরা এখন মসুল ছেড়ে যাচ্ছে। অথচ মার্কিন সেনারা টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করেনি। আর উল্লিখিত ভিডিওচিত্রের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত কোন দেশটি আরব দেশের সঙ্গে লাভজনক অস্ত্র ব্যবসা বন্ধ করে দেবে? এমনকি টাইম ম্যাগাজিন অনেক মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রশস্তি গাইলেও তারা বলতে পেরেছে, ‘মধ্যপ্রাচ্যে ট্রাম্প একজন নির্ভরযোগ্য ও সমমনা মিত্র চান। তাঁর চাওয়ার সঙ্গে সিসির বৈশিষ্ট্যের মিল আছে।’ বাহরাইন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে যে ব্যবহার পেয়েছে, সিসিও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সেই ব্যবহার চান। এ মুহূর্তে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে দেনদরবার করছেন, যাতে তারা মুসলিম ব্রাদারহুডকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আখ্যা দেয়। একইভাবে, তুরস্কের রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান চান, যুক্তরাষ্ট্র যেন গুলেনবাদীদের সন্ত্রাসী আখ্যা দেয়। কুর্দিদের একটি গোষ্ঠীকেও তিনি সন্ত্রাসী আখ্যায়িত করাতে চান, যারা আইএসবিরোধী যুদ্ধে নিজেদের যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র (এটা তাদের অজ্ঞতা) মনে করে।

সিনাই নিয়ে আলোচনা করতে গেলে তারা যে পুলিশ, সৈন্য ও বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা করেছে, সেটাও আমলে নিতে হবে। ‘অবিশ্বাসীদের’ শিরশ্ছেদ করা হয়েছে, খ্রিষ্টানদের হত্যা করা হয়েছে; সিগারেট বিক্রেতাকে প্রহার করা হয়েছে এবং কিছু কিছু জেলায় নারীদের নেকাব পরতে বাধ্য করা হয়েছে। অন্য কথায়, এটি আইএসের জমানায় গোত্রকেন্দ্রিক নৃশংসতা। আর এখন কায়রো, আলেকজান্দ্রিয়া ও তান্তায় খ্রিষ্টানদের গির্জায় হামলা হয়েছে। এমনকি মিসরের মধ্যাঞ্চলেও আইএসের আক্রমণ হতে পারে। সুয়েজ খালের পশ্চিম তীরে আরও সেনা মোতায়েন করা হবে। এর সঙ্গে আরও আরও খুনি জঙ্গি সৃষ্টি হবে।

১৯৯২-৯৮ সাল পর্যন্ত আলজেরীয় সরকার ‘সন্ত্রাসবিরোধী’ যুদ্ধে জেতার জন্য যে কৌশল অবলম্বন করেছিল, মিসরীয় গণমাধ্যম এখন সেই ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। কায়রোর গণমাধ্যম এখন বলে যাচ্ছে, ‘সন্ত্রাস’বিরোধী যুদ্ধে মিসর পরাজিত হয়েছে বলা যাবে না, কারণ, লন্ডন, প্যারিস ও স্টকহোমও ‘সন্ত্রাসের’ শিকার হচ্ছে। কাতারের অর্থায়নে পরিচালিত আল-আরাবি আল-জাদিদ নামের এক ওয়েবসাইট সিনাইয়ের এই যুদ্ধের সঙ্গে পিকেকের বিরুদ্ধে তুরস্কের যুদ্ধের তুলনা করেছে।

বস্তুত, কায়রোর জনগণ আল-সিসির নতুন পুলিশি রাষ্ট্রের জমানায় বোধগম্যভাবেই নীরব ছিল। এখন তারা সামরিক ‘রক্ষাকর্তাদের’ ব্যাপারে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে, যারা মিসরকে দারিদ্র্য ও ‘সন্ত্রাস’ থেকে মুক্ত করার অঙ্গীকার করেছিল। খ্রিষ্টানেরা অবশ্যই এ কারণে সরকারের দ্বারা রক্ষিত হলেও মুসলিম-অধ্যুষিত দেশে বিচ্ছিন্ন বোধ করে। এই মুসলমান নাগরিকেরা বিপজ্জনকভাবে আবারও বিপ্লবের কথা বলছে। সম্ভবত, যে বিপ্লবে মোবারকের পতন হলো, সে রকম ‘শুদ্ধ’ বিপ্লব নয়। বহুকালের একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে ২০১১ সালে তরুণেরা যে বিপ্লব করল, মিসরীয়রা এখন তাকে কৌতূহলোদ্দীপকভাবে ‘শুদ্ধ’ আখ্যা দিয়ে থাকে। ওদিকে আল-সিসি এখনো নিজেকে মহান মধ্যপন্থী বলে থাকেন, যিনি মিসরকে ইসলামি চরমপন্থার হাত থেকে বাঁচিয়েছেন।

সমস্যা হচ্ছে, মিসরের সঙ্গে আইএসের নিয়ন্ত্রণহীন যুদ্ধ ও সুয়েজ খালের পশ্চিম তীরে আইএসের নতুন হন্তারক দলের তোড়ে মিসরের প্রতিষ্ঠানগুলো শিগগিরই ক্ষমতাহীন হয়ে যাতে পারে। আর রক্ষীবাহিনী যখন রাষ্ট্রের সম্ভাব্য শত্রুদের কতল করছে, তখন শুধু ইরাকের কথা ভাবুন।

অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, ব্রিটিশ দৈনিক দ্য ইনডিপেনডেন্ট থেকে নেওয়া।

রবার্ট ফিস্ক: দ্য ইনডিপেনডেন্ট-এর মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি।