মিসরের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে সিনাই

২৪ অক্টোবর সিনাইয়ে আত্মঘাতী বোমা হামলায় ৩০ জন মিসরীয় সেনা মারা যায়
২৪ অক্টোবর সিনাইয়ে আত্মঘাতী বোমা হামলায় ৩০ জন মিসরীয় সেনা মারা যায়

সিনাই উপদ্বীপে হামলার পর থেকেই সাধারণ মিসরীয়দের মন বিবমিষায় ভরে উঠেছে। তাদের হৃদয় দুঃখভারাক্রান্ত, সেখানে জ্বলছে প্রতিশোধের আগুন। সে হামলায় ৩০ জন সেনা মারা গেছে, আহত হয়েছে আরও ২৮ জন। সন্ত্রাসী ও সেনাদের মধ্যে ভারী গোলাবর্ষণ হয়েছে। এর মধ্যে আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীদের আটকে পড়া একটি গাড়ি বিস্ফোরণে উড়ে যায়, ঘটনাটি ঘটেছে গত ২৪ অক্টোবর।
এরপর মিসরীয়রা মনের দুঃখে ভাবে: ‘এই কি সেই পবিত্র স্থান, যেখানে সর্বশক্তিমান ঈশ্বর সিনাই পর্বতে নিজেকে প্রকাশ করেছিলেন, মুসা নবীর সঙ্গে কথা বলেছিলেন। মানবজাতির মধ্যে মুসা নবীকেই ঈশ্বর বেছে নেন, কোনো মাধ্যম ছাড়াই ঈশ্বর নিজেকে প্রকাশ করেন।’
মিসরীয়রা ভেবে অবাক হয়: সিনাই উপদ্বীপের ভাবমূর্তি কেন এভাবে বিকৃত করা হলো যে শেষ পর্যন্ত মৌলবাদী ও সশস্ত্র ইসলামপন্থীরা এটিকে ঘাঁটি বানিয়ে ফেলল। এর সঙ্গে তো এই পবিত্র স্থানকে আরেকটি আফগানিস্তান বানানোর আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত রয়েছেই।
হামলার পর মিসরীয় প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি এই আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত সম্পর্কে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, বাইরের শক্তিগুলো মিসরীয় সেনাবাহিনীর নৈতিক শক্তি নস্যাৎ করতেই এ হামলা চালিয়েছে। তাই মিসর এক অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে। তিনি আরও বলেন, সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সন্ত্রাসবাদ সমূলে উৎপাটন করা হবে। তাঁর বর্ণিত পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে, উত্তর সিনাইয়ে তিন মাসের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা এবং রাফার আবাসিক এলাকা থেকে লোকজন সরিয়ে নেওয়া।
২৪ অক্টোবর সেনাদের ওপর যে হামলা হলো, সেটাই এ ধরনের প্রথম ঘটনা নয় বা শেষও নয়। গত ২৫ জানুয়ারির বিপ্লবের পর থেকে সিনাইয়ে যত ঘটনা ও সন্ত্রাসবাদী হামলার ঘটনা ঘটেছে, তার সঙ্গে এ হামলার পার্থক্য চোখে পড়ার মতো। আগে সাধারণত গ্যাসলাইনে বোমা হামলা করা হতো আর এবার সরাসরি সেনাদের ওপর হামলা চালানো হলো, আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হলো। প্রেসিডেন্ট মুরসির শাসনের প্রথম মাসেই রাফায় একটি নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটে গেল, যে হামলায় ১৬ জন লোক পবিত্র রমজান মাসে ইফতার করার সময় মারা যায়।
একই বছরের ৩ নভেম্বর সিনাইয়ে টহলরত একটি পুলিশ দলের ওপর হামলায় পুলিশের তিনজন সদস্য নিহত হন, আহত হন আরও দুজন। ২০১৩ সালের ১৫ আগস্ট আল-আরিশের একটি সেনা টহলচৌকিতে হামলার ঘটনায় সাতজন সেনাসদস্য মারা যান, আহত হন আরও পাঁচজন। এ রকম ফিরিস্তি দিতে গেলে লেখাটি টেনে অনেক লম্বা করতে হবে, সেদিকে আর না যাই।
মিসরের নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ আবদেল সুলায়মান ২৪ অক্টোবরের ঘটনার বিশ্লেষণ করে বলেন, এ হামলার সঙ্গে পেশাদার গোয়েন্দা বাহিনীর কার্যক্রমের মিল আছে। এমনকি সেই হামলায় আত্মঘাতী বোমা হামলার ব্যবস্থা ছিল। তিনি আরও বলেন, তহবিল ও নিরাপদ আস্তানা থাকায় সন্ত্রাসীরা হামলা চালানোর পর নিরাপদে পালিয়ে যেতে পেরেছে। তাঁর কথায়, এ হামলার সঙ্গে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার যোগসাজশের ইঙ্গিত আছে। প্রেসিডেন্ট সিসির ভাষ্যে, উত্তর সিনাইয়ে এরূপ উপর্যুপরি হামলার নানা রকম ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। এ হামলা ঐক্যবদ্ধ মিসর রাষ্ট্র ও তার সেনাবাহিনীর জন্য হুমকিস্বরূপ।
জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক খলিল আনানি বিশ্বাস করেন, এ হামলার প্রভাব পুরো মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় অনুভূত হবে। একই সঙ্গে তা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্যও চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু মিসরীয় সেনাবাহিনী যে সহিংস কায়দায় পুরো বিষয়টি মোকাবিলা করেছে, তা সেখানকার জনগণকে আরও ক্রোধান্বিত করে তুলেছে। তিনি আরও বলেন, সিনাইয়ের সন্ত্রাসী হামলায় তৃতীয় পক্ষের যুক্ততার অভিযোগ তোলা আসলে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল। তিনি এসব বিদেশি শক্তির মুখোশ উন্মোচনের দাবি তুলেছেন।
তিউনিসিয়ার নাহদা পার্টির নেতা রশিদ ঘানৌচির কথায়, মিসর, সিরিয়া, ইরাক প্রভৃতি দেশের কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলোই সন্ত্রাসবাদের জন্য দায়ী, তারা ইসলামপন্থী দলগুলোর ওপর নিপীড়ন চালানোর কারণে এই হামলাকারীরা সন্ত্রাসবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। অন্যদিকে মিসরের ইসলামিস্ট বিল্ডিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির সভাপতি ও রাজনৈতিকভাবে নির্বাসিত নেতা তারেক-আল-জোমোর এই হামলায় ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের হাত আছে বলে অভিযোগ করেছে। তিনি বলেন, এজাতীয় হামলার দূরবর্তী প্রভাব হিসেবে সিনাই মিসর থেকে আলাদা হয়ে যেতে পারে—খোদা না করুন।
কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক হাসান নাফা বলেছেন, প্রেসিডেন্ট সিসি কোনো বিদেশি শক্তির নাম উল্লেখ না করলেও তাঁর কথার ইঙ্গিত আছে, যে গোষ্ঠী সিনাইয়ে হামলা করেছে, তাদের সঙ্গে এমন দেশ ও শক্তির সম্পর্ক আছে, যারা প্রমাণ করতে চায় যে মিসর একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র। তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, সেই আনোয়ার সাদাতের আমল থেকেই মিসর সিনাইয়ের উন্নয়ন এবং এর নিরাপত্তা বিধান করতে ব্যর্থ হয়েছে।
আল-আহলি পত্রিকার সম্পাদক আমিনা আল-নিকাশ বলেন, সিনাই উপদ্বীপ ৬০ বছর ধরে নিগৃহীত হচ্ছে, সেখানে সাম্প্রতিক এই হামলার পেছনে কাজ করেছে এই বঞ্চনার ইতিহাস। তিনি দেখিয়েছেন, ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের কারণে উপদ্বীপটির বিশাল এক অংশ মিসরীয় রাষ্ট্রের আওতার বাইরে চলে গেছে, যেটা পরিণামে মিসর রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্যই হুমকি হয়ে উঠবে।
এই হামলার পর মিসরীয় সেনাবাহিনীর মুখপাত্র কর্নেল আহমেদ মোহামেদ আলী বলেন, আসলে সিনাই উপদ্বীপটি সাম্প্রতিক সময়ে উপেক্ষিত থাকায় কোনো গোষ্ঠী সেখানে সন্ত্রাসবাদ রপ্তানির চেষ্টা করেছে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, সিনাই মিসরের গৌরবোজ্জ্বল জাতীয় ঐতিহ্যের অংশ এবং মিসরীয় সেনাবাহিনী তা সংরক্ষণ করতে গিয়ে অনেক প্রাণ দিয়েছে। তিনি বলেন, মৌলবাদী ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো নিরাপত্তা বাহিনী, সরকারি স্থাপনা ও উত্তর সিনাইয়ের গ্যাসলাইনের ওপর উপর্যুপরি হামলা চালিয়ে যাচ্ছে, এটা অভূতপূর্ব। ৩০ জুনের বিপ্লবের সফলতা ও মুসলিম ব্রাদারহুড উৎখাতের ঘটনায় এরা উৎসাহিত হয়েছে।
২৪ অক্টোবরের হামলার পর মিসরীয় সেনাবাহিনী তার প্রধান মাহমুদ হেগাজির নেতৃত্বে এক অভূতপূর্ব অভিযান শুরু করেছে। তারা ঘোষণা দিয়েছে, যেকোনো মূল্যেই সিনাই থেকে সন্ত্রাসবাদ সমূলে উৎপাটন করা হবে, সেখানে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা হবে। সেনাবাহিনী প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, মিসর, মিসরীয় জনগণ ও জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি সব হুমকি নস্যাৎ না করা পর্যন্ত তারা ঘরে ফিরবে না। সব সন্ত্রাসী ও অপরাধীকে তারা শায়েস্তা করবে, মৌলবাদের উর্বর ভূমি নিষ্ফলা করে দেবে।
সাধারণভাবে মিসরীয় সেনাবাহিনী তাদের অভিযান চালানোর জন্য সিনাই উপদ্বীপের ভৌগোলিক (পার্বত্য) অবস্থা, এর জনসংখ্যা বিন্যাস প্রভৃতি আমলে নেবে। আর তা করতে গিয়ে তারা জনগণের স্বার্থ ও তাদের স্বাধীনতার সঙ্গে আপস করবে না। তারা সেখানে অবৈধ অনুপ্রবেশ এবং চোরাকারবারি ঠেকাবে, আর সরকার একই সঙ্গে সে এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন কার্যক্রম হাতে নেবে।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
কামাল গাবালা: মিসরের আল-আহরাম পত্রিকার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক।