মিয়ানমারের রাজনীতিতে যে দর–কষাকষি চলছে

অং সান সু চি
ছবি: রয়টার্স


আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মিয়ানমার নিয়ে যত ক্ষোভ-বিক্ষোভ থাকুক, অভ্যন্তরীণভাবে দেশটি বেশ স্বস্তিতে আছে। বড় কোনো অনিয়ম ছাড়াই জাতীয় নির্বাচন হয়ে গেছে। দু-তিন মাস পরই নতুন করে এনএলডি সরকার আবার প্রশাসনের দায়িত্ব নেবে। জাপান, চীন, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, ভারত শক্তভাবে তার পাশে আছে। আপাতদৃষ্টে সবই যেন ছকে বাঁধা পরিস্থিতি। তবে রাজধানী নেপিডোতে কান পাতলেই চাপা উত্তেজনা টের পাওয়া যায়। সেই উত্তেজনা অবশ্য নতুন সরকারে কে কোন মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রী হচ্ছেন, সে রকম বিষয় নিয়ে নয়। দুটি অনিশ্চয়তাকে ঘিরে চলতি উত্তেজনা। প্রথমত, অং সান সু চি প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন কি না? দ্বিতীয়ত, সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং কি আরও এক মেয়াদের জন্য সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান থাকছেন কি না?

ব্যাপক বিজয়ের পরও যে কারণে সু চি অতৃপ্ত
গত ৮ নভেম্বরের নির্বাচনে সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) ২০১৫ সালের চেয়েও বেশি আসন পেয়েছে। ইউনিয়ন পার্লামেন্টের দুই কক্ষ এবং আঞ্চলিক প্রতিনিধি সভা মিলে নির্বাচনযোগ্য আসন ছিল ১১৭১। কিছু জায়গায় নির্বাচন হয়নি। নির্বাচন হওয়া ১১১৭ আসনের মধ্যে এনএলডি ৯২০টিতে দখল নিয়েছে। এটা গতবারের চেয়ে ৬১টি বেশি এবং মোট আসনের ৮২ শতাংশ। বলা যায়, এনএলডির সামনে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাই গড়তে পারেনি সেনাসমর্থিত ইউএসডিপি (ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি)। অন্য কোনো দলও নয়। অথচ ৮৭টি দল নির্বাচনে অংশ নেয়।

যেকোনো রাজনৈতিক দলের প্রধানের জন্য এটা স্বপ্নের সমান এক পরিস্থিতি। তারপরও সু চির জন্য অতৃপ্তির কারণ রয়েছে। চাইলেও তিনি সরকারের প্রধান হতে পারছেন না। সেনাবাহিনী ১৯৮৮ সালে তৈরি সংবিধানে এমন বিধান করে রেখেছে (অনুচ্ছেদ ৫৯-চ) বিদেশি নাগরিককে বিয়ের কারণে এবং সন্তানেরা বিদেশি নাগরিক হওয়ায় সু চি প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না। তাঁর রাজনৈতিক জীবনে এটা চরম হতাশার দিকই বটে। পরপর দুটি নির্বাচনে ভূমিধস বিজয়ের পরও প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকারে প্রেসিডেন্ট হতে পারছেন না তিনি। তবে এখনো হাল ছাড়ছে না এনএলডি। যদিও সে লক্ষ্যে আছে অনিশ্চয়তা।

সিনিয়র জেনারেল স্বপদে থাকতে আগ্রহী
সু চির মতোই অনিশ্চয়তায় আছেন সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইংও। প্রায় ১০ বছর দেশটির ক্ষমতাধর সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান তিনি। তিনি মিয়ানমারের সব ক্ষমতার অধিকারী, এ কথায় অনেকের ভিন্নমত থাকতে পারে। কিন্তু তিনি যে দেশটিতে সমান্তরালে একটা সরকার চালান, তাতে কমই আপত্তি থাকবে। দেশটির অতীত ঐতিহ্যের ওপর দাঁড়িয়ে এমনও বলা যায়, তিনি চাইলে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে পুরো ক্ষমতাই নিয়ে নিতে পারেন। কিন্তু ১৯৫৯ সালের ডিফেন্স অ্যাক্টের সংশোধনী মেনে আগামী বছরই তাঁকে পদটি ছাড়তে হবে। আগে এমন নিয়ম ছিল না। টাটমাড নামে পরিচিত ‘সশস্ত্র বাহিনী যত দিন চাইত’, তত দিন প্রধানেরা ওই পদে থাকতেন। নিজেদের রাজত্বের মেয়াদ নিজেরাই নির্ধারণ করতেন আগের চিফরা। মিন অং যাঁর উত্তরসূরি, সেই থান শ ১৯ বছর এ পদে থেকে গেছেন।

তবে ২০১৪ সালের নতুন নিয়ম অনুযায়ী ৬৫ বছর বয়সে ‘কমান্ডার ইন চিফ’ এবং ‘ডেপুটি চিফ’কে যেতে হবে। আর পাঁচ মাস পরই জেনারেল মিন অংয়ের ৬৫ হবে। ১৯৭৪ থেকে বাহিনীতে আছেন তিনি। গুঞ্জন রয়েছে, ‘দেশের স্বার্থে’ বর্তমান পদে আরও থাকতে আগ্রহী তিনি। সে জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে যেটা দরকার, প্রেসিডেন্টের সম্মতি। সচরাচর ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটি কাউন্সিল চিফের মনোনয়ন দেয়। সেখানে ১১ সদস্যের ৬ জনই সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিনিধি। তবে শেষ অনুমোদন প্রেসিডেন্টই দেন। নতুন সরকারে প্রেসিডেন্ট হবেন সু চির এনএলডি থেকে কেউ। ফলে মিন অংয়ের অভিলাষ পূরণ করতে পারেন পর্দার আড়াল থেকে কেবল সু চি। যেভাবে সু চির প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথ বাধামুক্ত করতে পারেন শুধু জেনারেল মিন অং।

এখানেই দর-কষাকষির সুযোগ। এখানে এসেই মিয়ানমারের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দুই চরিত্রের চাওয়া-পাওয়া বিনিময়ের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

সু চির সামনে দুটি বিকল্প। এনএলডির বিজয় সত্ত্বেও সশস্ত্র বাহিনীর তৈরি সংবিধানের বাধায় তিনি ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি। ‘স্টেট কাউন্সিলর’ নামের ব্যতিক্রমধর্মী একটা পদ তৈরি করে সরকার পরিচালনা করে গেছেন। সেনাবাহিনী তাঁকে প্রেসিডেন্ট হতে দিতে না চাইলে সু চিকে আবারও স্টেট কাউন্সিলর হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। দ্বিতীয় বিকল্প হলো, মিন অংকে আরও তিন বছর সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান থাকার সুযোগ দিয়ে তাঁদের কাছ থেকে প্রেসিডেন্ট হওয়ার সুযোগ চেয়ে নিতে পারেন সু চি। সশস্ত্র বাহিনী চাইলে পার্লামেন্টে অনায়াসে সে রকম বিধান হতে পারে। পার্লামেন্টে সশস্ত্র বাহিনীর ২৫ ভাগ সদস্য আছেন। সিনিয়র জেনারেল যা ইশারা করবেন, সেভাবেই ভূমিকা রাখবেন তাঁরা।

সু চির মতোই মিন অংয়ের সামনেও দুটি বিকল্প। সু চির সঙ্গে দর-কষাকষি ছাড়াই নির্ধারিত বয়স শেষে অবসরে চলে যাওয়া অথবা দর-কষাকষি করে পরস্পর জেতার সুযোগ নেওয়া। যেখানে সু চি প্রেসিডেন্ট হবেন এবং সিনিয়র জেনারেল আরও কয়েক বছর স্বপদে থাকবেন।

সু চির সঙ্গে কোনো সমঝোতা ছাড়াই যদি মিন অং হ্লাইং অবসরে চলে যান, তাহলে সু চি তাঁকে রক্ষায় ভবিষ্যতে আগ্রহী না-ও হতে পারেন। কেবল মিন অং নিজে নন, তাঁর পরিবার ও তাঁর সময়ের উচ্চপদস্থ জেনারেলরাও মামলা–মোকদ্দমার শঙ্কার মধ্যে আছেন।

দর-কষাকষি বেশি জরুরি জেনারেলদের জন্য
আপাতত সিনিয়র জেনারেলের জন্যই আপসরফা বেশি জরুরি। সু চির সামনে হারানোর কিছু নেই। দেশ-বিদেশে সবাই জানে, তিনিই দেশটির রাজনীতির প্রধান চরিত্র। বিপুল জনসমর্থন নিয়ে আগামী মেয়াদও গত পাঁচ বছরের মতো কাটিয়ে দিতে পারেন তিনি। কিন্তু সিনিয়র জেনারেলের জন্য বাজে শঙ্কা আছে।

মানবতাবিরোধী অপরাধে অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলের আন্তর্জাতিক বিচারের সম্ভাবনা আছে। এমনকি পরবর্তী কমান্ডার ইন চিফ নিজেদের পরিচ্ছন্ন দেখাতে দেশের ভেতরও একই উদ্যোগ নিতে পারেন। যদিও আপাতত এটা অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে।

সু চির সঙ্গে কোনো সমঝোতা ছাড়াই যদি মিন অং হ্লাইং অবসরে চলে যান, তাহলে সু চি তাঁকে রক্ষায় ভবিষ্যতে আগ্রহী না-ও হতে পারেন। কেবল মিন অং নিজে নন, তাঁর পরিবার ও তাঁর সময়ের উচ্চপদস্থ জেনারেলরাও মামলা–মোকদ্দমার শঙ্কার মধ্যে আছেন। তাঁরা সবাই চাইবেন মিন অং নতুন সরকার গঠনের আগেই সু চির সঙ্গে একটা সমঝোতায় পৌঁছাবেন। মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের একাধিক সংবাদমাধ্যমে এ রকমই খবর বের হচ্ছে।

জেনারেলদের দর-কষাকষির শক্তি কমে গেছে যে কারণে
গত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট বামাররা সেনাবাহিনীর সমর্থক কেবল প্রতিরক্ষার প্রশ্নে এবং অপর ক্ষুদ্র জাতিগুলোকে দমনের কাজে। রাজনীতিতে তারা সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ চাইছে না। ইউএসডিপির খারাপ ফলাফল এই বার্তাই দেয়। ২০১৫ সালে দলটি ১১৭ আসন পায়। এবার পেল ৭১টি (মোট আসনের ৬ শতাংশ মাত্র)। ইউএসডিপির এই নির্বাচনী দারিদ্র্য সিনিয়র জেনারেলের দর-কষাকষির শক্তি কমিয়ে দিয়েছে। নির্বাচনের আগে মিয়ানমারজুড়ে কানাঘুষা ছিল মিন অং অবসরের পর প্রেসিডেন্ট হতে আগ্রহী। নির্বাচনের পর সেই গুঞ্জন বন্ধ হয়ে গেছে। এরও কারণ ইউএসডিপি। এই পরিস্থিতি সু চির জন্য ভালো সুযোগ। এই প্রথম তিনি সেনাবাহিনীর সঙ্গে একটা দীর্ঘমেয়াদি বোঝাপড়ায় আসার সুযোগ পেলেন। হয়তো এতে দেশের পরিস্থিতিকে নিজের মতো করে পরিচালনায় এক ধাপ এগোতে পারবেন এনএলডি নেত্রী।

রাজনীতি মাত্রই আপসের শিল্পকলা। মিয়ানমারের সবচেয়ে আলোচিত রাজনীতিবিদের কন্যা হিসেবে এটা সু চির অজানা নেই। নিজেও ৩২ বছর রাজনীতিতে রয়েছেন। জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়েরও একই সূত্র না জানার কথা নয়। ৪৬ বছর এমন এক বাহিনীতে কাজ করেছেন, যাঁরা বরাবরই রাজনৈতিক ভূমিকায় ছিলেন। চলমান দর-কষাকষিতে তাঁরা উভয়ে জিততে পারেন।

সে রকম হলে মিয়ানমারের প্রান্তিক জাতিসত্তাগুলোর জন্য এটা ভালো খবর হবে। সু চি তাঁদের স্বায়ত্তশাসন প্রশ্নে আরও ছাড় দিয়ে চলমান আলোচনা এগিয়ে নিতে পারবেন। বাংলাদেশের জন্যও একটা ভালো খবর হবে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শক্তি ও স্বাধীনতার ওপর বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তন কিছুটা হলেও নির্ভর করছে। ২০১৭ সাল থেকে আরাকানে সশস্ত্র বাহিনী যে অসহনীয় অবস্থা তৈরি করেছে, তার সংশোধন এবং সেখানে স্থানীয় রোহিঙ্গা ও রাখাইন উভয় সম্প্রদায়ের শান্তিপূর্ণ পুনর্বাসনের বিষয়ে গণতান্ত্রিক সরকারের স্বাধীন উদ্যোগের জন্য জেনারেলদের কর্তৃত্ব কমা জরুরি। সু চির হাত যত শক্তিশালী হবে, মিয়ানমার সেদিকে ধীরলয়ে হলেও এগোবে।

আলতাফ পারভেজ গবেষক ও দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে বিশেষজ্ঞ