মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বিএনপির অবস্থান

মুক্তিযুদ্ধের শহীদ ও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রশ্নে বিএনপিপ্রধান খালেদা জিয়া এবং দলের আরেকজন নেতা নতুন বিতর্ক
সৃষ্টি করেছেন। এসব বিতর্ক শুধু অবাঞ্ছিত নয়, অপ্রয়োজনীয়ও। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা না থাকলে এ ধরনের উক্তি করা যায়। মোটা দাগে বললে বলা যায়, দুজন নেতাই এই দুটি মন্তব্য করে দলের ক্ষতি করেছেন। এই ক্ষতি সহজে পূরণ হবে না।
নানা কারণে বিএনপি একটি দুর্বল দলে পরিণত হয়েছে। সমর্থক বা ভোটারদের দিক থেকে ততটা দুর্বল নয়। দুর্বল হয়েছে নেতৃত্বের দিক থেকে। বিএনপির নীতিনির্ধারক তথা কেন্দ্রীয় নেতারা দলের জন্য কার্যকর ও উপযুক্ত কৌশল বা কর্মসূচি গ্রহণে অনেক সময় সফল হচ্ছেন না। বিএনপির বিভিন্ন কৌশল বা কর্মসূচি কারা নেয়, কোথায় নেয়, তা-ও খুব স্পষ্ট নয়। অনেকে বলেন, বিএনপির প্রধান কৌশল বা কর্মসূচি লন্ডন থেকে আসে। যদি এটা সত্য হয়ে থাকে, তাহলে সেটি হবে বিএনপির জন্য বিপজ্জনক। কারণ লন্ডনে বসে যঁারা দলের কলকাঠি নাড়তে চান, তঁারা বাস্তববাদী নন। তঁাদের অতীত রাজনীতি নিষ্কলুষ নয়। তঁাদের কারণে ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় বিএনপিকে অনেক খেসারত দিতে হয়েছে। কাজেই দলের প্রধান ও নীতিনির্ধারকদের উচিত লন্ডনের ওপর নির্ভর না করা। আগামী কয়েক বছর বিএনপির জন্য খুব কঠিন সময়। ২০১৯ সালে তারা সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে কি নেবে না, নির্দল তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে আগামী নির্বাচনে তাদের অবস্থান কী হবে, দলের অসংখ্য নেতার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা তারা মোকাবিলা করবে কীভাবে, আগামী নির্বাচনের জন্য দলের একটি সময় উপযোগী ও বাস্তবমুখী ইশতেহার রচনা, দলকে গোছানো, ৩০০ জন জনপ্রিয়, সৎ ও দেশপ্রেমিক ব্যক্তির মনোনয়ন নিয়ে চিন্তা ইত্যাদি বহু কাজ এই দলের সামনে রয়েছে। কাজেই আগামী কয়েক বছর দলের কৌশল ও নীতিনির্ধারণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
পাশাপাশি বর্তমান সরকার যে অন্যায় ও ভুলগুলো করছে, তা প্রায় প্রতিদিন চিহ্নিত করে সমালোচনা করাও দলের বড় কাজ। আমাদের ধারণা, বিএনপি সেই কাজগুলোও ঠিকভাবে করতে পারছে না। সরকারের ব্যর্থতাগুলো ধরতে পারার মতো নেতারও অভাব রয়েছে বিএনপিতে। বিএনপি তার মূল কাজগুলো না করে অহেতুক মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিতর্কিত ও অবাঞ্ছিত মন্তব্য করে দলের ক্ষতি করছে। মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইত্যাদি প্রশ্নে বিএনপির কিছু নেতার মন্তব্য শুনে মনে হয়, যুদ্ধাপরাধীদের প্রেতাত্মারা এখনো বিএনপিতে রয়ে গেছে। তাদের নীতিনির্ধারণের জায়গা থেকে সরাতে না পারলে দলটি বারবার বিপদগ্রস্ত ও বিতর্কিত হবে।
গত কয়েক বছরে দেশের রাজনীতিতে একটা গুণগত পরিবর্তন হয়েছে বা হতে যাচ্ছে। এই গুণগত পরিবর্তনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার একটা বড় ঘটনা। অনেকে এটাকে ছোট করে দেখতে চাইলেও লাভ হবে না। এটা বড় ঘটনা।
বিএনপি একটি বড় ও জনপ্রিয় দল। জোড়াতালি দিয়ে এই দল পরিচালিত হওয়া উচিত নয়। এই দলের নীতি ও কৌশল সম্পর্কে একটা স্পষ্টতা থাকতে হবে। ‘যখন যেমন তখন তেমন’ নীতি দিয়ে একটি বড় রাজনৈতিক দল পরিচালিত হতে পারে না। বাংলাদেশে রাজনীতি করতে হলে, ক্ষমতায় যেতে হলে ‘মুক্তিযুদ্ধ’ সম্পর্কে স্পষ্ট নীতি বা বক্তব্য থাকতে হবে। যেখানে ইতিহাসের প্রতিফলন ঘটবে। আবার আওয়ামী লীগ যেভাবে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে, সেটিও একপেশে। মাওলানা ভাসানীসহ দেশের বামপন্থী গোষ্ঠী যে মুক্তিযুদ্ধে বড় অবদান রেখেছে, তা তারা স্বীকার করে না। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ যে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, সে কথাও আনুষ্ঠানিক বক্তৃতা বা লেখায় সেভাবে আসে না। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তাজউদ্দীনই মুক্তিযুদ্ধটি সংগঠিত করেছিলেন। পরিচালনা করেছিলেন। আওয়ামী লীগ কি তাঁকে যথাযথ মর্যাদা দিয়েছে?
বিএনপিতে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ নেতা ও কর্মী আছেন, তাঁদের আজ সংঘবদ্ধ হতে হবে। সোচ্চার হতে হবে। কারণ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লুকোচুরি করে বাংলাদেশে রাজনীতি করা যাবে না। ১৯৭১ সালে বিএনপির জন্ম হয়নি। তাই নিরপেক্ষভাবে ’৭১কে দেখতে বিএনপির সমস্যা হওয়ার কথা নয়। ১৯৭১ সালে যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, পাকিস্তানি সেনাদের লুটপাটে ও হত্যাকাণ্ডে সহায়তা করেছিল, তাদের ঘৃণাই করতে হবে। তাদের মিত্র ভাবার কারণ নেই। কয়েকটা ভোটের জন্য মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের সঙ্গে মৈত্রী কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। বিএনপি যদি রাজাকারদের সঙ্গ ছেড়ে দেয়, অন্যদের কাছ থেকে তাদের ভোট আসতেও পারে। এই বাস্তবতাও বিএনপিকে বুঝতে হবে। রাজাকারদের ভোটকে বিএনপির মধ্যে কেউ কেউ বড় করে দেখে। এটা বিভ্রান্তিকর।
এই বিভ্রান্তি ও অপবাদ থেকে মুক্তির জন্য বিএনপির মুক্তিযুদ্ধপন্থী নেতা ও কর্মীরা ১৯৭১ সম্পর্কে একটা অভ্যন্তরীণ ইশতেহার রচনার দাবি করতে পারেন। যেখানে তাঁরা দাবি করবেন, ‘১৯৭১-এর সার্বিক মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বিএনপির অবস্থান, বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বিএনপির বক্তব্য, অস্থায়ী সরকার সম্পর্কে বিএনপির বক্তব্য, মুক্তিযুদ্ধে ভারত সরকারের সহযোগিতা সম্পর্কে বিএনপির অবস্থান, রাজাকার, আলবদর সম্পর্কে বিএনপির অবস্থান, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে বিএনপির অবস্থান, ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান সম্পর্কে বিএনপির বক্তব্য ইত্যাদি।’
১৯৭১ সালে বিএনপি নামে কোনো দল ছিল না। কাজেই বর্তমান বিএনপি নির্মোহভাবে এই ইশতেহার রচনা করতে পারে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিএনপির কোনো কোনো নেতা বা কর্মী এই ইশতেহারের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করতে পারেন, সেটা তাঁদের সমস্যা। কিন্তু দলকে একটা অভিন্ন মত বা অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। এ জন্য দলের মধ্যে অনেক বিতর্ক হতে পারে। সেই বিতর্ক হোক। একবারই হোক। কিন্তু বিতর্ক করে তা চূড়ান্ত করতে হবে। একবার এটা চূড়ান্ত হয়ে গেলে দলের কোনো নেতা-কর্মী আনুষ্ঠানিকভাবে এর বাইরে বক্তব্য দিতে পারবেন না। কেউ বক্তব্য দিেল তা শৃঙ্খলাবিরোধী কাজ বলে বিবেচিত হবে।
এভাবে কিছু না করলে বিএনপিকে প্রায়ই মুক্তিযুদ্ধ–বিষয়ক বিতর্কে জড়াতে হবে। কারণ বিএনপিতে বিভিন্ন দল, মতের নেতা-কর্মী, সুবিধাবাদী, পাকিস্তান প্রেমিক, রাজাকার, আলবদর, যুদ্ধাপরাধীর সম্মিলন ঘটেছে। ১৯৭৮ সালে দল গঠনের সময় জিয়াউর রহমান সব ধরনের লোক নিয়ে বিএনপি (প্রথমে জাগদল) গঠন করেছিলেন। তখন বিএনপিতে যোগ দেওয়ার একটিমাত্র অলিখিত শর্ত ছিল ‘আওয়ামী লীগ বিরোধী’।
স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরেও আমরা যদি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করি, ইতিহাসের নানা খুঁটিনাটি নিয়ে কলহে লিপ্ত হই, তাহলে এগোব কীভাবে? আমাদের পাশের অনেক দেশ বহুদূর এগিয়ে গেছে। আমরা এখনো নজরুলের ভাষায় ‘বউ তালাকের ফতোয়া খুঁজছি’।
১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের নানা ঘটনা, স্বাধীনতার ঘোষণা, প্রবাসী সরকারের ভূমিকা, ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান ইত্যাদি নিয়ে ইতিহাসবিদেরা নানা ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ, পর্যালোচনা, সমালোচনা করতে পারেন। এগুলো হলো ইতিহাসের ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ। এর সঙ্গে ইতিহাসের মূল ঘটনাগুলোকে বিকৃত করার সুযোগ নেই। ৪৭-এর দেশভাগ নিয়ে এখনো বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে ইতিহাসবিদ ও গবেষকেরা বই লিখে চলেছেন। ৪৭-এর দেশভাগ নিয়ে এখনো নানা বিতর্ক রয়েছে। ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ কার কী ভূমিকা ছিল, তা নিয়ে বিতর্ক থাকবে। ইতিহাসচর্চাকে আইন দিয়ে স্তব্ধ করা যায় না। বিএনপির উচিত বিষয়টি ইতিহাসবিদদের ওপর ছেড়ে দেওয়া। স্বল্পবিদ্যা নিয়ে ইতিহাসের তর্ক-বিতর্ক মানায় না। বিএনপির নেতারা চলমান রাজনৈতিক ঘটনার মধ্যে তাঁদের মনোযোগ ও বক্তব্য সীমাবদ্ধ রাখলে দেশেরও মঙ্গল হবে, দলেরও মঙ্গল হবে।
বিএনপিকে একটি সক্রিয় গণতান্ত্রিক দল হিসেবে আমরা দেখতে চাই। যাতে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের চর্চা থাকে। বিএনপি দুর্বল হওয়া মানে পরোক্ষভাবে একদলীয় শাসন কায়েম হওয়া। সেটা গণতন্ত্রের জন্য ভালো হবে না। ছোট দলগুলো এখনো নিজের শক্তিতে ক্ষমতায় যাওয়ার মতো পর্যায়ে পৌঁছায়নি। সে জন্য একটি গণতান্ত্রিক ও শক্তিশালী বিএনপি দেশের জন্য খুব প্রয়োজন।
বিএনপি অনেক সময় অপচয় করেছে। আর নয়। ১৯৭১ ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিএনপির একটা লিখিত, স্পষ্ট বক্তব্য তৈরি করতে হবে। যার রেফারেন্স পয়েন্ট হতে পারে জিয়াউর রহমান রচিত একটি জাতির জন্ম প্রবন্ধটি, যা ১৯৭২ সালে বিচিত্রায় ছাপা হয়েছিল। জিয়াউর রহমানের বক্তব্যকে অস্বীকার করে নিশ্চয় বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের কথা বলবে না।
বিএনপির মুক্তিযুদ্ধপন্থী নেতা ও কর্মীরা দলের মধ্যে এ ব্যাপারে সোচ্চার হবেন আশা করি।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।