মুক্তির বীজ ছয় দফায় আজ ফিরে তাকানোর দিন

১৯৬৬ সালে ঢাকার ইডেন হোটেলে ছয় দফার মঞ্চ থেকে জনগণের কাছে ৬ দফা ব্যাখ্যা করছেন বঙ্গবন্ধু।
ছবি: জাতির জনক অ্যালবাম থেকে

১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর ১৯৬৬ সালের ৫-৬ ফেব্রুয়ারি অখণ্ড পাকিস্তানের সব বিরোধী দলের কনভেনশন/সম্মেলন আহ্বান করা হয়েছিল লাহোরে। কনভেনশনের প্রথম দিনই আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দলের সাধারণ সম্পাদক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঐতিহাসিক ছয় দফা কর্মসূচি উত্থাপনের চেষ্টা করেন। কিন্তু আলোচনার জন্য সাবজেক্ট কমিটিতে তাঁর কর্মসূচি গৃহীত হয়নি। এ অবস্থায় বঙ্গবন্ধু কনভেনশন বর্জন করেন এবং ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে সংবাদ সম্মেলন করে ছয় দফা কর্মসূচি পেশ করেন।

১১ ফেব্রুয়ারি দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের কাছে ছয় দফা কর্মসূচি ব্যাখ্যা করেন। পরদিন ১২ ফেব্রুয়ারি ইত্তেফাক পত্রিকা ছয় দফা নিয়ে লিড নিউজ করে। শিরোনাম ছিল: ‘পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে ৫ কোটি মানুষের সহিত বিশ্বাসঘাতকতা করা সম্ভব নহে, তাই…, লাহোর সম্মেলনের সহিত সম্পর্কচ্ছেদের কারণ বর্ণনা প্রসঙ্গে শেখ মুজিব, দেশের উভয় অংশের মধ্যে অটুট ঐক্য ও সংহতি গড়িয়া তোলার জন্য ৬-দফা কর্তব্য নির্দেশ’। পাকিস্তানের তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর শোষণ ও বৈষম্য নীতির বিরুদ্ধে ছয় দফা কর্মসূচি সর্বস্তরের বাঙালিকে উজ্জীবিত করে।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পরই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে আসছিল। কিন্তু পাকিস্তান সরকার এ যৌক্তিক দাবির সম্পূর্ণ বিরোধিতা করে ১৯৪৮ সালে উর্দুকে একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করে। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার মানুষ প্রতিবাদ জানাতে থাকে। পরবর্তীতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্ররা একত্রিত হন। পুলিশ এ সমাবেশের ওপর গুলি চালালে রফিক, সালাম, বরকত, জব্বারসহ আরও অনেকে শহীদ হন। এই ঘটনা আন্দোলনকে এক নতুন মাত্রা দান করে এবং রাজনৈতিক গুরুত্ব বহুমাত্রায় বাড়িয়ে দেয়।

এরপর পূর্ব বাংলায় ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট মুসলিম লীগকে হারিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করে। পূর্ব বাংলায় সংখ্যাগরিষ্ঠ যুক্তফ্রন্ট প্রাদেশিক সরকার গঠন করে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকেরা বাঙালির এই আধিপত্য মেনে নিতে পারেনি। নানা কূটকৌশলে তারা ঐতিহাসিক এই বিজয় নস্যাৎ করে দেয়। প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে কেন্দ্রীয় শাসন জারি করা হয়।
পরবর্তীতে ১৯৫৬ সালে তরুণ শেখ মুজিব পাকিস্তানি রাজনীতির শঠতা ও বৈষম্য প্রতিরোধের লক্ষ্যে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে খসড়া সংবিধানে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন দাবি জানিয়েছিলেন। ছয় দফার প্রাক-ইতিহাস হিসেবে বঙ্গবন্ধুর এই প্রাথমিক প্রয়াসটিও উল্লেখযোগ্য।

ছয় দফার পটভূমি
জনসংখ্যা ও কৃষি সম্পদ পূর্ব বাংলায় বেশি থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কিছুদিনের মধ্যেই রাজনৈতিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। পশ্চিম পাকিস্তানি নেতারা নানা কৌশল ও ছল-চাতুরীর মাধ্যমে দেশের মূল নেতৃত্ব নিজেদের কবজায় নেন। একই সঙ্গে শুরু হয় অর্থনৈতিক শোষণ ও বৈষম্য।

পূর্ব পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী থাকলেও, দুই ভাগে বিভক্ত দেশটিতে পশ্চিম পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবেও আধিপত্য বিস্তার করছিল। জনসংখ্যা কম হওয়া সত্ত্বেও পশ্চিম পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের সিংহভাগ বরাদ্দ পাচ্ছিল। পূর্ব বাংলা অর্থনৈতিকভাবে আগে থেকেই অনগ্রসর ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানে কেন্দ্রীয় সরকারের অধিক বরাদ্দে এই অনগ্রসরতা আরও বৃদ্ধি পায়। পশ্চিম পাকিস্তানে অভিবাসী ব্যবসায়ীদের সংখ্যাধিক্যের কারণে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা পশ্চিম পাকিস্তানেই কেন্দ্রীভূত হয়। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের মোট রপ্তানি আয়ের ৭০ ভাগ এসেছিল পূর্ব পাকিস্তানের রপ্তানি থেকে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান এই অর্থের মাত্র ২৫ ভাগ বরাদ্দ পেয়েছিল।

১৯৫৯ সালে পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচনের সময় নির্ধারিত হলে পাকিস্তানি কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এই প্রেক্ষাপটে ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হয়। মাওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধুসহ অনেক বাঙালি নেতা গ্রেপ্তার হন। ১৯৬২ সালে সামরিক আইন প্রত্যাহার করা হলে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র সমাজ ফের আন্দোলনে নামে। তথাকথিত শিক্ষা নীতিকে কেন্দ্র করে ১৯৬৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর এই আন্দোলন আরও বেগবান হয়।

১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ১৭ দিনের এই যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান অরক্ষিত ছিল। এ দেশের মানুষ উপলব্ধি করেন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকেরা পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তা বিধানে কিছুই করেনি। এরপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা করলে পশ্চিম পাকিস্তানে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীকে এ কর্মসূচি শঙ্কিত করে তোলে। আইয়ুব খান নিজেও ছয় দফাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী, ধ্বংসাত্মক, বৃহত্তর বাংলা প্রতিষ্ঠার কর্মসূচি ইত্যাদি আখ্যায়িত করেন। তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের এক নম্বর দুশমন হিসেবে চিহ্নিত করে ছয় দফাপন্থীদের দমনে অস্ত্রের ভাষা প্রয়োগের হুমকি দেন। এমনকি পূর্ব পাকিস্তানেও অনেকে ছয় দফার সমালোচনা করতে থাকেন। বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের হুমকিতে দমে যাননি।

ছয় দফা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ
বঙ্গবন্ধু লাহোর থেকে ফিরে ১৮-২০ মার্চ মতিঝিলের ইডেন হোটেলে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন আহ্বান করেন। তখন দলের সভাপতি ছিলেন মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ। এই কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধু দলের সভাপতি নির্বাচিত হন। আর সাধারণ সম্পাদক হন তাজউদ্দীন আহমদ। বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে ছয় দফা কর্মসূচি অনুমোদন করিয়ে নেন। এরপর জনমত সৃষ্টির জন্য ছয় দফার পক্ষে সারা দেশে সফর শুরু করেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর ছয় দফা কর্মসূচিকে ‘আমাদের (বাঙালির) বাঁচার দাবি’ হিসেবে আখ্যায়িত করে জনগণের কাছে তুলে ধরেন। একের পর এক জনসভা করেন। তিনি ঘোষণা করেন, ‘ছয় দফা আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্ন’, ‘ছয় দফা রাজনৈতিক দর-কষাকষির কোনো ব্যাপার নয়’, ‘পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিসনদ ছয় দফা’, ‘ছয় দফা প্রশ্নে কোনো আপস নেই’।

ধীরে ধীরে মানুষ ছয় দফাকে সমর্থন দিতে শুরু করেন। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তাও বৃদ্ধি পায়। পাকিস্তানের নিরাপত্তা আইনে তাঁকে বারবার গ্রেপ্তার করা হয়। কখনো সিলেটে, কখনো ময়মনসিংহে, কখনো ঢাকায় আবার কখনো নারায়ণগঞ্জে। তিন মাসে তিনি আটবার গ্রেপ্তার হন। সর্বশেষ ১৯৬৬ সালের ৮ মে নারায়ণগঞ্জের পাটকল শ্রমিকদের জনসভায় বক্তৃতা শেষে ঢাকায় ফিরে এলে ওই দিন রাতে তিনি গ্রেপ্তার হন। ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মুক্তির আগ পর্যন্ত তিনি প্রায় তিন বছর একনাগাড়ে কারাগারে থাকেন। আইয়ুবের অনুগত গভর্নর মোনায়েম খান বলেন, ‘আমি যত দিন গভর্নর আছি, মুজিবকে জেলেই থাকতে হবে।’

ছয় দফাকে কেন্দ্র করে আইয়ুব সরকার ৮ মে বঙ্গবন্ধু ছাড়াও তাজউদ্দীন আহমদ, জহুর আহমেদ চৌধুরী প্রমুখ নেতাকে গ্রেপ্তার করে। পরে আরও অনেক নেতা ও কর্মীকে কারাবন্দী করা হয়। কিন্তু ছয় দফার আন্দোলন থেমে যায়নি। ১৪৪ ধারা, নির্যাতন, নিষ্পেষণ ও গুলিবর্ষণ উপেক্ষা করে দেশব্যাপী ছয় দফার দাবিতে ছাত্র, শ্রমিক, কৃষকসহ আপামর জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন চলতে থাকে। ৭ জুন শেখ মুজিবসহ অন্য নেতাদের মুক্তির দাবিতে সারা দেশে ধর্মঘট পালিত হয়। ধর্মঘট চলাকালে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও টঙ্গীতে পুলিশের গুলিতে ১১ জন শ্রমিক শহীদ হন। শহীদের রক্তে রঞ্জিত ৭ জুন স্বীকৃতি অর্জন করে বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফার দিবস হিসেবে।

এ ঘটনার তাৎপর্য ছিল বহুমাত্রিক। শ্রমিকদের আত্মোৎসর্গের ফলে ছয় দফা আন্দোলন সর্বজনীনতা লাভ করে। বঙ্গবন্ধু গণমানুষের নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। অন্যদিকে তাঁর ছয় দফা হয়ে ওঠে পূর্ব বাংলার জনগণের বাঁচার দাবি। আইয়ুব সরকারের জেল-জুলুম, হত্যা-নির্যাতন ছয় দফা আন্দোলনের বৈপ্লবিক রূপান্তর ঘটায়। সভা-সমাবেশ, ধর্মঘট, পোস্টার, লিফলেট ইত্যাদির মাধ্যমে ছয় দফা কর্মসূচি পূর্ব বাংলার জনগণের মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং তাদের বাঁচার দাবিতে পরিণত হয়।

ছয় দফা কর্মসূচির লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ছিল ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি নির্বিশেষে বাঙালি জনগণকে জাতীয় মুক্তির চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত করা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষায়:

‘ছয় দফা বাংলার শ্রমিক-কৃষক, মজুর-মধ্যবিত্ত তথা আপামর মানুষের মুক্তির সনদ, ছয় দফা শোষকের হাত থেকে শোষিতের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার ছিনিয়ে আনার হাতিয়ার, ছয় দফা মুসলিম-হিন্দু-খ্রিষ্টান-বৌদ্ধদের নিয়ে গঠিত বাঙালি জাতির স্বকীয় মহিমায় আত্মপ্রকাশ আর আত্ম নির্ভরশীলতা অর্জনের চাবিকাঠি...ছয় দফার সংগ্রাম আমাদের জীবন-মরণের সংগ্রাম।’

ছয় দফা যখন জনগণের ব্যাপক সমর্থন পায় তখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুকে অভিযুক্ত করে এক নম্বর আসামি করা হয়। স্বৈরাচারী আইয়ুব খান ও তাঁর সহযোগীরা বঙ্গবন্ধুকে এই মামলা জড়িয়ে তাঁর রাজনৈতিক জীবন শেষ করে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার ফল হয় বিপরীত। বরং এই মামলার কারণে সাধারণ মানুষের সহানুভূতিতে সিক্ত হয়ে তিনি পরিণত হন অবিসংবাদিত নেতায়। বাংলার মানুষ মনে করেন আগরতলা মামলা বাংলার জনগণের বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের ষড়যন্ত্র। উনসত্তরে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের ষড়যন্ত্র ছাত্র-যুব-জনতা ব্যর্থ করে দেয়। শেখ মুজিব মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত হন।
ছয় দফা কর্মসূচি সমগ্র বাঙালির চেতনা মূলে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল। ছয় দফায় স্বাধীনতার কথা সরাসরি না থাকলেও তা বাঙালিদের স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত করে। এর ভেতরেই নিহিত ছিল বাঙালির জাতীয় মুক্তির বীজ। ছয় দফা ছিল বাঙালির জাতীয় মুক্তির সনদ। ছয় দফা কেন্দ্রিক আন্দোলনের পথ ধরেই জন্ম হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের।

তথ্যসূত্র: বাংলাদেশ রাজনীতি সরকার ও শাসনতান্ত্রিক উন্নয়ন ১৭৫৭-২০১৮, হারুন-অর-রশিদ, অন্য প্রকাশ ২০১৮

রাশেদুর রহমান সাংবাদিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক