মুখ ও মুখোশ নিয়ে অতি সামান্য হইল

মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক। মাস্ক না পরলে জরিমানা। শীত বাড়ছে, বাংলার আকাশে আজ ধূলিকণার ঘনঘটা, তার শ্যামল প্রাণ-ধরে আজ করোনার আলপনা, কে তাকে আশা দেবে, কে তাকে ভরসা দেবে, কে তাকে শোনাবে জাগরণের অভয় বাণী? দিতে পারে কেবল মুখোশ। মাস্ক। সমস্যা হলো মুখঢাকা মুখোশের এই দুনিয়ায় মানুষকে কী বলে চিনবে বলো!

হোয়াট বেঙ্গল থিংকস টুডে, ইন্ডিয়া থিংকস টুমরো, দ্য ওয়ার্ল্ড থিংকস দ্য ডে আফটার টুমরো। ঢাকায় নির্মিত প্রথম ছবির নাম মুখ ও মুখোশ। একদিন মুখের চেয়ে মুখোশ যে বড় হয়ে দেখা দেবে, তা ঢাকার চিত্রনির্মাতারা ছাড়া আর কে বুঝতে পেরেছিল! বাংলাদেশে একটা
মাস্কের দাম ১৫ টাকার বেশি তো নয়। আমরা বলে থাকি, যে না মোর চেহারা, আট আনা দামের পেয়ারা! সেই পেয়ারা এখন ১৫ টাকাতেও বিকোয়। কিন্তু একটা মুখোশের দাম? খবরে প্রকাশ, একটা মাস্কের খরচ পড়ছে ১৫ লাখ ডলার। প্রায় ১৪ কোটি টাকা। ভাবছেন, বাংলাদেশের কোনো পূর্ব-অভিজ্ঞতাবিহীন সরবরাহকারী এই দাম ‘কোট’ করেছে! বালিশ–কাণ্ডের মতো এ এক নতুন মুখোশ–কাণ্ড! না, ঘটনা তা নয়। এটা সত্যি। এক চীনা ব্যবসায়ী ১৫ লাখ ডলারের মাস্কের অর্ডার করেছেন। প্রথম আলোর খবরে বলা হচ্ছে:

এখন পর্যন্ত সেটিই সবচেয়ে দামি ফেস মাস্ক বলে ধারণা করা হচ্ছে। ১৮ ক্যারেট সোনার মাস্কটি তৈরি করেছে ইসরায়েলি জহুরি অর্না এবং আইজ্যাক লেভির অলংকার তৈরির প্রতিষ্ঠান ইভেল। তাতে যুক্ত করা হচ্ছে মোট ২১০ ক্যারেটের ৩ হাজার ৬০৮ টুকরা হীরা। তো এই মাস্কের বাইরে থাকবে হীরার স্তর, তারপর সোনার স্তর, তারপর এন-৯৯ মাস্কের উপাদান। আমরা বাইরে থেকে হীরা দেখব।

বাংলাদেশের যেকোনো ব্যাংকখেলাপি এই খবর শুনে হাসবেন। দুই হাজার, চার হাজার কোটি টাকা হাপিস করে দেওয়া তাঁদের জন্য ওয়ান-টুর ব্যাপার। তো তাঁরা ১৬ কোটি টাকা দিয়ে মাস্ক কিনতে পারবেন, ৩২ কোটি টাকা দিয়ে পারবেন। তবে করোনা আবার বড়লোকদের পছন্দ করে বেশি। সহায়-সম্পদ বল, সকলি ফুরায় কাল, আয়ু যেন পদ্মপত্রে নীর।

আচ্ছা যাঁরা শত হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে লোন নেন, আর শোধ করেন না, যাঁরা ১০ টাকার বালিশের দাম ২৯ হাজার টাকা ধরে বিল করেন, তাঁরা কি সোনার চাল সেদ্ধ করে ভাত খান? হাউ মাচ ল্যান্ড ডাজ আ ম্যান নিড! ‘লোভী মানুষের মুখ কেবল কবরের মাটি দ্বারাই পূর্ণ হয়ে থাকে।’ তবে চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনি।

মাস্কের কথায় আসি। দেশে কোভিডে মৃত্যুর সংখ্যা আবার বেড়ে যাচ্ছে, ৩২ থেকে বেড়ে হয়েছে ৩৯। উদ্বেগজনক। আমাদের বুক গোরস্থান হয়ে যাচ্ছে, এত পরিচিত, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনকে বিদায় বলতে হলো। আরও কতজনকে বিদায় জানাতে হবে, নাকি নিজেই টুপ করে বোঁটা আলগা শীতের জীর্ণ পাতার মতো ডাল থেকে ঝরে পড়ব, কে জানে। মানুষ যে জন্মাবেই, এটার কোনো নিশ্চয়তা আছে কি নেই, কিন্তু মানুষ মারা যাবে, তার মতো ধ্রুব তো আর কিছু নেই। কাজেই আমাদের সাবধান হতে হবে, স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে এবং মুখোশ পরতে হবে।

পরব। নিশ্চয়ই পরছি। কিন্তু কতগুলো বাস্তব অসুবিধা আছে। মুখোশ পরে খাওয়া যায় না। মুখোশ খুলতেই হয়। মুখোশ পরলে মুখশ্রী প্রকাশ করা যায় না। রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতায় অমিত বলে, ফ্যাশানটা হল মুখোশ, স্টাইলটা হল মুখশ্রী। তো মাস্ক মুখ ঢেকে রাখে।

এতে ক্রিমিনালদেরও সুবিধা হয়েছে। সিসিটিভিতে মুখ না দেখিয়েই তারা দিব্যি অপকর্ম করে বেড়াতে পারবে। এ থেকে রক্ষার জন্য একটা উপায় বের করা দরকার। ট্রান্সপারেন্ট মুখোশ। করোনাভাইরাস নাকে-মুখে ঢুকতে পারবে না, আবার আমার মুখটাও পুরোটাই দেখা যাবে। এটা যদি করা হয়, আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি, ১৭ কোটি টাকায় তা বিক্রি করা যাবে।

তবু কবির বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে। মুখ দেখে ভুল কোরো না মুখটা তো নয় মনের আয় না, মানুষের ভেতরের খবর তো কেউ পায় না। সাধু আর শয়তানে যে ভাই দুনিয়ায় চলেছে লড়াই, কে সাধু কে শয়তান কিছুই বলা যায় না। কে সাধু কে শয়তান বুঝবেন কী করে।

প্রবাদ আছে, বেটা সাধু বেশে পাকা চোর। হয়তো মুখোশটাই সত্য। মুখটাই একটা মায়া। আছে কি নেই, আমরা জানি না।

আর আমাদের জীবনটা কলুর বলদের মতো একই চক্রে ঘুরছে। কলুর বলদ দেখেছেন। তার চোখ ঠুলি পরা থাকে। সে জানে না, সে একই চক্রে ঘুরছে। আর গরু যখন ধানের বিচালি মাড়াই করে, তখন দেখেছেন। গরুর মুখে টোপর পরিয়ে দেওয়া হয়। যাতে সে বিচালি খেতে না পারে।

আমাদের জীবনে আমরা কলুর বলদের মতো চোখে ঠুলি পরেছি, মাড়াইয়ের গরুর মতো মুখে টোপর পরেছি, আর একই চক্রে ঘুরছি। আমরা দেখি না, আমরা খাই না। শুধু তা–ই না, আমরা বলিও না। সৈয়দ শামসুল হক লিখেছিলেন, মানুষের চোখ আছে তা দেখবার জন্য শুধু নয়, কাঁদবারও জন্য। আমরা বলি, মানুষের মুখ আছে, তা কেবল খাওয়ার জন্য নয়, বলবারও জন্য। আমাদের মুখে আমরা মুখোশ পরে আছি। আমরা মুখ দেখাব না এবং আমরা কিছু বলবও না। বোবার শত্রু নেই।


আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক