মুজিবের শেষ কথা, এক ছাদের নিচে নয়

একাত্তরে উত্তাল ছিল বাংলাদেশ। একদিকে ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে আলোচনা, অন্যদিকে অভিযানের প্রস্তুতি। পাকিস্তানি আমলা হাসান জহির খুব কাছ থেকে ঘটনাপ্রবাহ প্রত্যক্ষ করেছেন। জানুয়ারি-মার্চের ঘটনাবলির ভেতর-বাহির উঠে এসেছে তাঁর বই দ্য স্যাপারেশন অব ইস্ট পাকিস্তান: দ্য রাইজ অ্যান্ড রিয়ালাইজেশন অব বেঙ্গলি মুসলিম ন্যাশনালিজম-এ। আজ তৃতীয় ও শেষ পর্ব

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে ইয়াহিয়া খান বেসামরিক মন্ত্রিসভা ভেঙে দেন। প্রশাসন নিজের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাই ছিল এর উদ্দেশ্য। এই সময়ে পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডে লোকবল ও সরঞ্জাম বাড়ানো হয়। ইতিমধ্যে সেনা নেতৃত্ব সামরিক অভিযান চালানো এবং রাজনৈতিক কার্যক্রম স্থগিত করার পরিকল্পনা নিয়েছে। ইয়াহিয়া খান মধ্য মার্চে ঢাকা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন রাজনৈতিক আলোচনার উদ্দেশ্যে।

পূর্বাংশ সংকট যত ঘনিয়ে এসেছে, ইয়াহিয়া তত ভুট্টোর কাছাকাছি চলে আসেন। এই দুই ব্যক্তির মধ্যে বৈঠকের পরই অধিবেশন স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত হয়। এর আগে টেলিফোনে মুজিব ও ইয়াহিয়ার মধ্যে আলোচনা হয়। মুজিব তাঁকে প্রশ্ন করেন, আপনি কি কেবল পশ্চিম পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট? ইয়াহিয়ার পাল্টা প্রশ্ন ছিল, আপনি কি শুধু পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী?

মুজিব ক্ষুব্ধ ছিলেন এবং ৭ মার্চের ভাষণে তিনি অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান। পাকিস্তানি শাসন আর পূর্ব পাকিস্তানে চলছিল না এবং প্রদেশটি কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ইয়াহিয়া বাস্তবতা অনুধাবনে ব্যর্থ হন। তিনি তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত না নিয়ে মুজিবকে তাঁর ঢাকা আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলেন। ১৪ মার্চ ইয়াহিয়া করাচিতে ভুট্টোর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ভুট্টো ওই দিনই জনসভায় দুই অঞ্চলের দুই সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান। পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য নেতা ভুট্টোর এ প্রস্তাবের কঠোর সমালোচনা করেন।

ইয়াহিয়া খান ১৫ মার্চ ঢাকায় পৌঁছান। এরপরই প্রেসিডেন্ট ভবনে গভর্নর ও সেনাবাহিনীর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন রাজনৈতিক এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে। মুজিব-ইয়াহিয়া প্রথম বৈঠক হয় ১৬ মার্চ সকালে, দ্বিতীয় বৈঠক ১৭ মার্চ কোনো সহযোগী ছাড়াই। দুজনের সরাসরি এ বৈঠকের কোনো কার্যবিবরণী রাখা হয়নি।

জেনারেল গুল হাসান জানান, প্রেসিডেন্টের নির্দেশ অনুযায়ী পীরজাদা ব্রিফ করেন। মুজিব ইয়াহিয়া খানকে পরিষ্কার করে দেন, পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিমের সঙ্গে আগের ভিত্তিতে একসঙ্গে থাকবে। তিনি অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার ও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানাতে থাকেন। ইয়াহিয়াও ক্ষমতা হস্তান্তর এবং গভর্নরকে সহায়তা করার জন্য নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে একটি মন্ত্রিসভা গঠনের বিষয়ে একমত হন। সামরিক বিধান বলেই সামরিক কার্যক্রম স্থগিত ও মন্ত্রিসভা গঠন করা হবে।

১৭ মার্চ প্রেসিডেন্টের সহযোগীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাদের বৈঠক হয় ক্ষমতা হস্তান্তরের বিধিমালা নিয়ে। আওয়ামী লীগ প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও কামাল হোসেন। প্রেসিডেন্টের সহযোগীরা জানান, জাতীয় পরিষদের বিধান ছাড়া সামরিক আইন প্রত্যাহার করলে আইনগত শূন্যতা দেখা দেবে। আওয়ামী লীগের নেতারা সামরিক আইন প্রত্যাহারের জন্য চাপ দিতে থাকেন এবং প্রেসিডেন্টের প্রস্তাব নাকচ করে দেন। কোনো সমঝোতা ছাড়াই বৈঠক মুলতবি হয়ে যায়।

১৯ মার্চ মুজিব ইয়াহিয়ার সঙ্গে দেখা করে পরবর্তী বৈঠকের প্রস্তাব মেনে নেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকেন। বিকেলে দুই পক্ষের প্রতিনিধিরা বসেন এবং প্রেসিডেন্টের সহযোগীরা বলেন, ইয়াহিয়া খানের ১৯৬৯ সালের ফরমান বলেই দেশ শাসিত হচ্ছে। সামরিক ফরমান না থাকলে তাঁর (ইয়াহিয়া) ক্ষমতায় থাকার বৈধতাও থাকে না। আওয়ামী লীগ নেতা তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, এটি রাজনৈতিক বিষয়, রাজনৈতিকভাবেই সমাধান খুঁজতে হবে। কামাল হোসেন বলেন, ইয়াহিয়া খান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ বিলুপ্ত করলে, প্রেসিডেন্ট পদ গ্রহণ করলে সমস্যা নেই।

১৯ মার্চের বৈঠকের পর পীরজাদা কর্নওয়ালিশ ও গুল হাসান যৌথভাবে প্রেসিডেন্টের কাছে সুপারিশ করেন ১৯৬২ সালের সংবিধান সংশোধন করে জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের কাছে ক্ষমতা ন্যস্ত করা যায়। সামরিক আদালত ও প্রশাসক পদ যেভাবে রহিত করা হয়েছে, সেভাবে সামরিক বিধানাবলি রহিত করা যায়। কিন্তু প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক পদ বহাল থাকবে। সামরিক কর্তৃপক্ষের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও ইয়াহিয়া খান এই প্রস্তাবে সম্মতি দেন এবং কর্নওয়ালিশ এর আইনি সমস্যা সমাধান করতে বলেন।

এক দেশ নয়, কনফেডারেশন

২০ মার্চ প্রেসিডেন্টের পুরো টিম ও আওয়ামী লীগ নেতারা আরেক দফা বৈঠকে বসেন। ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসার আগে সামরিক আইন প্রত্যাহারের সমস্যা কী, কর্নওয়ালিশকে ব্যাখ্যা করতে বলেন।

কর্নওয়ালিশ যখন বিষয়টি ব্যাখ্যা করছিলেন, তাজউদ্দীন আহমদ তাঁকে বাধা দিয়ে বলেন, এসব কী বলছেন, সামরিক আইন পুরোপুরি প্রত্যাহারের বিষয়ে আমাদের নেতা ও প্রেসিডেন্ট একমত হয়েছেন। কর্নওয়ালিশ বলেন, কয়েক দিন পর ২৫ মার্চ জাতীয় অধিবেশন বসতে যাচ্ছে, অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত তা স্থগিত থাকতে পারে। মুজিব একমত হলেন না এবং বললেন, ‘না না না। আপনি বুঝতে পারছেন না এটি রাজনৈতিক বিষয়।’ আওয়ামী লীগ অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহারের বিষয়ে চাপ দিতে থাকে এবং পশ্চিম পাকিস্তানি সংবিধান বিশেষজ্ঞ এ কে ব্রোহি তাদের অবস্থানকে সমর্থন করেন। প্রেসিডেন্ট বললেন, মুজিবকে পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে।

এ বৈঠকে আরও সিদ্ধান্ত হয় যে মুজিবের প্রস্তাব অনুযায়ী জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে পূর্ব ও পশ্চিমে দুটি পৃথক কমিটি হবে এবং তাঁরা ঢাকা ও ইসলামাবাদে বসে সাংবিধানিক প্রস্তাব পেশ করবেন। পরে উভয় কমিটির প্রস্তাব জাতীয় পরিষদে উপস্থাপন করা হবে, তাঁরা দুই পক্ষের জন্য গ্রহণযোগ্য একটি সংবিধান রচনা করবেন। পরবর্তী দুদিন কর্নওয়ালিশ ও গুল হাসান আওয়ামী লীগের মতামতকে ধারণ করে এ রকম কয়েকটি ঘোষণার খসড়া তৈরি করেন। এম এম আহমদকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে তলব করা হয় অর্থনৈতিক বিষয়ে পরামর্শ নিতে।

কিন্তু ২৪ মার্চ মুজিব ও তাজউদ্দীন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে এক অনির্ধারিত বৈঠক করেন, তাঁরা আর কেন্দ্রীয় সরকারে কোনো প্রতিনিধিত্ব দিতে চান না, যাতে প্রেসিডেন্ট নেতৃত্ব দেবেন। অর্থাৎ এক ছাদের নিচে নয়। তখন মুজিবের একমাত্র দাবি প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন আহ্বান, যেখানে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের আইনি বৈধতা দেওয়া হবে। এটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। গোটা প্রদেশের ওপর আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত। উগ্রপন্থীরা প্রকাশ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের কথা বলছেন।

হাসান জহির আরও লিখেছেন, ২৪ মার্চ আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে প্রেসিডেন্টের সহযোগীদের তৃতীয় ও শেষ বৈঠক হয়। আওয়ামী লীগ নেতারা সেখানে ছয় দফার বাইরে এসে একটি সংশোধনী আনেন। আগের প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, পাকিস্তান হবে একটি যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু তাঁরা সংশোধনীতে বললেন, বাংলাদেশ স্টেটের সংবিধান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের স্টেটগুলোর সংবিধান রচনার পর প্রেসিডেন্ট জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকবেন এবং সেই অধিবেশনে সব সদস্য সার্বভৌম সংস্থার প্রতিনিধি হিসেবে পাকিস্তান কনফেডারেশনের একটি সংবিধান প্রণয়ন করবেন। প্রেসিডেন্টের সহযোগীরা দেখতে পান, আওয়ামী লীগের এ প্রস্তাব মেনে নিলে কেন্দ্রীয় সরকারের আইনগত ভিত্তি থাকে না। তাঁরা প্রতিবাদ করলেন। কর্নওয়ালিশ বললেন, এ সংশোধনী আগের খসড়ার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। তিনি কনফেডারেশন শব্দের পরিবর্তে পাকিস্তান ইউনিয়ন ব্যবহারের প্রস্তাব দিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতারা সেই প্রস্তাব এই বলে নাকচ করে দিলেন যে এ পরিবর্তন আনা হয়েছে মুজিবের নির্দেশেই।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]