মুদ্রা পাচার: কানাডার সরকারি সংস্থার তালিকায় বাংলাদেশি কতজন?

ম্যানসন আকৃতির আলিশান বাড়ির সামনে ড্রাইভওয়েতে হাল মডেলের দামি গাড়ি আর পেছনে নোঙর করা ব্যক্তিগত স্পিডবোট। বাড়ির পেছন দিয়ে বের হয়েই ব্যক্তিগত বোটে লেকে ঘুরে আসা যায়। কিংবা ড্রাইভওয়েতে পার্ক করে রাখা অতি দামি গাড়ি নিয়ে শাঁই শাঁই করে ছুটে যাওয়া যায় যেকোনো দিকে। এমন দৃশ্যের বর্ণনা দিলে যে কেউ এটিকে কোনো সিনেমার দৃশ্য হিসেবেই বিবেচনা করবেন।
টরন্টো থেকে গার্ডিনার এক্সপ্রেস ধরে মাত্র ৪০ কিলোমিটারের দূরত্বে এমন সিনেমাটিক জীবন যাপন করছেন বেশ কিছু বাংলাদেশি। না, তাঁরা যে কানাডায় অনেক বছর ধরে আছেন, তুমুল জীবনসংগ্রামের পথ পাড়ি দিয়ে কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্য করে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছেন, তা নয়। তাঁদের অধিকাংশই কানাডায় এসেছেন গত কয়েক বছরে এবং বাড়িগুলো কেনা হয়েছে এ সময়েই। কানাডায় তাঁদের দৃশ্যমান তেমন আয়ের কোনো উৎস নেই। তাঁদের অধিকাংশই বাংলাদেশের সরকারি বিভিন্ন বিভাগের বর্তমান বা সাবেক কর্মকর্তা। কানাডার বেগমপাড়ার চেয়েও নতুন কিছু নাম টরন্টোর বাংলাদেশিদের আড্ডায় এখন উচ্চারিত হয়। বিশেষ কয়েকটি পেশা বা বিভাগের নামে পল্লি বা পাড়া যুক্ত হয়ে নতুন উপমাগুলো বেগমপাড়াকেও ম্লান করে দিচ্ছে।

গত ৫–৬ মাসে বাংলাদেশ থেকে যে পরিমাণ টাকা কানাডায় এসেছে, গত কয়েক বছরেও তা আসেনি, এমন কথা এখন টরন্টোর বাংলাদেশি কমিউনিটিতে ব্যাপকভাবে উচ্চারিত হয়।

২.
বাংলাদেশের ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়ে সেগুলো ফেরত না দিয়ে কানাডায় পাচার করে আয়েশি জীবন যাপন করা বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে গত বছরের শেষের দিকে আমরা যখন সামাজিক আন্দোলন শুরু করি, তখন বাংলাদেশের সরকারি পর্যায় থেকে সেই আন্দোলনকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। রাশেদ খান মেনন অন্যান্য ইস্যুর সঙ্গে জাতীয় সংসদে বিষয়টি উত্থাপন করলেও সংসদের আলোচনায় কিংবা মিডিয়ায় সেটি তেমন গুরুত্ব পায়নি। ঢাকায় সরকার যেমন এই বিষয়ে নীরব থেকেছে, তেমনি কানাডায় বাংলাদেশ দূতাবাস বা কনসাল জেনারেল অফিস ওই আন্দোলন থেকে নিজেদের যতটা সম্ভব দূরে সরিয়ে রেখেছে।
কিন্তু এবার সরকারের খোদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরাসরি অর্থ পাচার নিয়ে কথা বলেছেন, সিংহভাগ পাচারকারী সরকারি কর্মকর্তা, এমন একটি মতামত দিয়েছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বক্তব্যের পর কানাডায় অর্থ পাচার নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), এমনকি উচ্চ আদালত পর্যন্ত এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন।
৩.
বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার করে কানাডায় আসা লোকের সংখ্যা কতজন হবে? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন। বাংলাদেশ থেকে আসা সরকারি কর্মকর্তা কিংবা ব্যবসায়ী বা রাজনীতিকমাত্রই যে অর্থ পাচারকারী, তা নয়। কিন্তু সরকারের যুগ্ম সচিব পর্যায়ে চাকরিতে থাকা কেউ যদি টরন্টোর প্রাণকেন্দ্রে দেড় থেকে দুই মিলিয়ন ডলার নগদ মূল্যে আলিশান বাড়ি কিনে ফেলেন, তখন তাঁদের সন্দেহের চোখে দেখার যথেষ্ট কারণ থাকে। এটা সত্য, উত্তর আমেরিকায় ক্রেডিট স্কোর ভালো থাকলে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বাড়ি কেনা যায়। কিন্তু সে জন্য নির্দিষ্ট আয় থাকতে হয়। কানাডায় যাঁদের দৃশ্যমান কোনো আয় নেই, এমন কেউ নগদ ডলারে আলিশান বাড়ি কিনলে তাঁদের নিয়ে আলোচনা হতেই পারে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এমন সময় বাংলাদেশ থেকে কানাডায় অর্থ পাচারকারী ২৮ জনের তথ্য থাকার কথা জানিয়েছেন, যখন কানাডার ফেডারেল সংস্থা ১ হাজার ৫৮২টি মুদ্রা পাচারের তথ্য দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে দিয়েছে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, তাঁর কাছে ২৮টি কেসের তথ্য সংগ্রহ আছে। গত বছরের শেষে টরন্টোয় লুটেরাবিরোধী সামাজিক আন্দোলনের সময় বিশ্বব্যাপী মুদ্রা পাচার নিয়ে কাজ করা ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজস্টসের (আইসিআইজে) সঙ্গে জড়িত কানাডীয় কয়েকজন সাংবাদিক অনানুষ্ঠানিকভাবে আমাদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। সেই সব আলোচনায় কানাডার প্রভাবশালী একটি পত্রিকার একজন সাংবাদিক জানিয়েছিলেন, তাঁদের কাছে সন্দেহভাজন মুদ্রা পাচারকারী ২০০ বাংলাদেশির একটি তালিকা আছে। তালিকা ধরে তাঁরা তথ্যগুলো যাচাই–বাছাই করার কাজ করছেন।
এদিকে কানাডায় সন্দেহভাজন আর্থিক লেনদেন দেখভালের দায়িত্বে থাকা ফেডারেল সংস্থা ফিনট্র্যাক (দ্য ফাইন্যান্সিয়াল ট্রানজেকশনস অ্যান্ড রিপোর্ট অ্যানালাইসিস সেন্টার অব কানাডা) মুদ্রা পাচারের ১ হাজার ৫৮২টি ঘটনা চিহ্নিত করেছে। গত এক বছর সময়ে এই পাচারের ঘটনাগুলো ঘটেছে বলে জানা যায়। সারা দেশ থেকে খুঁজে বের করা মুদ্রা পাচারকারীদের বিস্তারিত তথ্য কানাডীয় সিকিউরিটিজ ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস এবং আরসিএমপির কাছে হস্তান্তর করেছে তারা।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এমন সময় বাংলাদেশ থেকে কানাডায় অর্থ পাচারকারী ২৮ জনের তথ্য থাকার কথা জানিয়েছেন, যখন কানাডার ফেডারেল সংস্থা ১ হাজার ৫৮২টি মুদ্রা পাচারের তথ্য দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে দিয়েছে। তবে বাংলাদেশের মন্ত্রীর কাছে থাকা ২৮ জনের তথ্য আর কানাডার ফিনট্র্যাকের তথ্যের মধ্যে কোনো যোগসূত্র আছে কি না, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

জানা গেছে, ব্যাংক, ইনস্যুরেন্স কোম্পানি, শেয়ারবাজারের ব্রোকার, রিয়েল এস্টেট ব্রোকারেজ এবং ক্যাসিনো থেকে তথ্য সংগ্রহ করে ফেডারেল সংস্থাটি অধিকতর তদন্তের মাধ্যমে মুদ্রা পাচারের ঘটনা উদ্‌ঘাটন করে। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, কোভিডের মধ্যেও বিভিন্ন দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়ে কানাডায় আসছে, এমন তথ্যের ভিত্তিতে ফিনট্র্যাক বাড়তি তদন্ত শুরু করে। রিয়েল এস্টেট ব্রোকারেজগুলোয় গোয়েন্দাদের বাড়তি নজর রয়েছে বলে জানা যায়।
কোভিডে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতোই কানাডার অর্থনীতি প্রবল চাপের মধ্যে থাকলেও রিয়েল এস্টেট বাজার যথেষ্ট চাঙা রয়েছে। টারানেট-ন্যাশনাল ব্যাংকের ইনডেক্সের তথ্য অনুসারে, পুরো কানাডায় অক্টোবর মাসে বাড়ির দাম ২২ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। বাড়ির দাম পর্যবেক্ষণের তথ্যের জন্য এই ইনডেক্সকেই গ্রহণযোগ্য সূত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

অর্থনীতি চাপে থাকা সত্ত্বেও বাড়ি বাজার এত চাঙা হলো কীভাবে? কারা কিনছেন এই বাড়ি? এ নিয়ে নানা ধরনের মুখরোচক গল্প চালু আছে বাংলাদেশি কমিউনিটিতে। কোন সরকারি কর্মকর্তা কোথায় আড়াই মিলিয়ন ডলার (২৫ লাখ ডলার বা প্রায় ২২ কোটি টাকা) নগদ দিয়ে বাড়ি কিনলেন, কোন রাজনীতিকের মেয়ের জামাই আলিশান বাড়ি কিনেছেন, কোন টেলিভিশনের পরিচালক নিজের পছন্দ করা নকশায় দৃষ্টিনন্দন বাড়ি বানাচ্ছেন নগদ অর্থে, এসব নিয়েও তুমুল আলোচনা হয়।

গত ৫–৬ মাসে বাংলাদেশ থেকে যে পরিমাণ টাকা কানাডায় এসেছে, গত কয়েক বছরেও তা আসেনি, এমন কথা এখন টরন্টোর বাংলাদেশি কমিউনিটিতে ব্যাপকভাবে উচ্চারিত হয়। সব আলোচনা ছাপিয়ে কানাডার সরকারি সংস্থার তালিকায় কতজন বাংলাদেশি আছেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর তালিকাটি সেখান থেকেই পাওয়া কি না, এ নিয়ে তুমুল কৌতূহল তৈরি হয়েছে সর্বত্র।

শওগাত আলী সাগর কানাডাপ্রবাসী সাংবাদিক।