মুসলমানরা ভোটের ফলাফলে বড় প্রভাবক!

মুসলমানদের ভোট কোন পক্ষ কতটা পেল তা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে
মুসলমানদের ভোট কোন পক্ষ কতটা পেল তা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে

পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে বিরোধী বাম ও কংগ্রেস জোটের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই এখন তুঙ্গে। কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থার মধ্যেই লাগাতার সংঘর্ষ চলছে। ভোটপর্ব শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শাসক ও বিরোধী জোটের শিবিরে জয়-পরাজয় নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ ও হিসাব চলছে। সেই প্রসঙ্গে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে রাজ্যের সংখ্যালঘু মুসলমানদের ভোট কোন পক্ষ কতটা পেল। সংখ্যালঘু প্রশ্নটি এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার কারণ, এ রাজ্যের ২৭ শতাংশই মুসলমান। আর যেহেতু এঁদের বড় অংশই কয়েকটি জেলার মধ্যে বসবাস করেন, তাই রাজ্যের মোট ২৯৪টি আসনের মধ্যে প্রায় ১২৫টিতেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন ভোটের ফলাফল প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখেন। অর্থাৎ ওই সব আসনে ২০ থেকে ৪০ শতাংশ মুসলমান ভোট থাকলে এবং তার অধিকাংশই একদিকে পড়লে তা ভোটের ফলকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে।
পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি মুসলমানদের সিংহভাগই গ্রামে থাকেন এবং পেশায় কৃষিজীবী। তাই সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামে বামফ্রন্ট সরকার কৃষিজমি জোর করে অধিগ্রহণ করে শিল্পায়নের চেষ্টা করায় তাঁরা বিপন্ন বোধ করেন এবং বামবিরোধী তৃণমূল কংগ্রেসের দিকে ঝুঁকে পড়েন। এই প্রবণতা বিশেষ করে দক্ষিণবঙ্গে দেখা যায় এবং ভোটের ফলাফলেও তা প্রতিফলিত হয়। ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের সময় নরেন্দ্র মোদির পক্ষে দেশজুড়ে হাওয়া ছিল তুঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনী প্রচারে এসে মোদি শাসিয়েছিলেন যে ক্ষমতায় এসে তিনি ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের’ ফেরত যেতে বাধ্য করবেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন পাল্টা শাসিয়েছিলেন, এমন কিছু করলে মোদিকে কোমরে দড়ি পরিয়ে গ্রেপ্তার করাবেন। বাম ও কংগ্রেস তখন তৃণমূল কংগ্রেসের আক্রমণে ছত্রভঙ্গ। এ অবস্থায় তারা যে মুসলমানদের নিরাপত্তা দিতে পারবে না, তা ভেবে মুসলমানরা ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের দিকে বেশি করে ঝুঁকে পড়েন। নির্বাচনের ফলেও সেটা ধরা পড়ে। শেষ দফার নির্বাচনে দক্ষিণবঙ্গের ১৭টি লোকসভা কেন্দ্রে ভোট ছিল। তার মধ্যে নদীয়া, উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, হাওড়া, হুগলি ও পূর্ব মেদিনীপুরে মুসলমান-অধ্যুষিত কেন্দ্রগুলো ছিল। একমাত্র আসানসোল (যেখানে অবাঙালি ভোটার ৫০ শতাংশ) ছাড়া সব কটিতে তৃণমূল কংগ্রেস জেতে। তবে দক্ষিণবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের আধিপত্য বিস্তার হলেও উত্তরবঙ্গে কংগ্রেস প্রভাব অটুট থাকে।
নদীয়ার রানাঘাটের একটি স্কুলের শিক্ষক সফিকুল ইসলাম কলকাতার তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত কলম পত্রিকায় (সংখ্যালঘুদের জন্য) লেখালেখি করেন। তাঁর দাবি, দক্ষিণবঙ্গের গ্রামীণ মুসলমানরা এখনো বেশির ভাগই আগের মতো মমতার পাশেই রয়েছেন। তবে তিনি ইদানীং লক্ষ করছেন তাঁদের একাংশ তৃণমূল ছেড়ে জোটের দিকে ঝুঁকছেন। ভোটের মুখে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ক্যানিং, মহেশতলা, কাকদ্বীপ প্রভৃতি এলাকায় মিছিল করে মুসলমানদের তৃণমূল ছেড়ে সিপিএম দলে যোগ দিতে দেখা গেছে। পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রামে মুসলমানরা (৪০ শতাংশ) এখনো সিপিএমের বিরুদ্ধে তৃণমূলের সঙ্গেই। কিন্তু জেলার সর্বত্র সেই চিত্র নেই। নন্দীগ্রামের লাগোয়া চণ্ডীপুর বিধানসভা কেন্দ্রেই দেখা গেছে সিপিএমের বিশাল জনসভায় মুসলমান পুরুষ ও নারীদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো।
উত্তর চব্বিশ পরগনার কথাই ধরা যাক। প্রশাসনিক দিক থেকে বসিরহাট, বারাসাত, বনগাঁ ও ব্যারাকপুর—এই চার মহকুমা রয়েছে। তার মধ্যে শুধু বসিরহাটের স্বরূপনগর, বাদুরিয়া, বসিরহাট উত্তর, বসিরহাট দক্ষিণ, হাড়োয়া, হাসনাবাদ, দেগঙ্গা, মীনাখাঁ, হিঙ্গলগঞ্জ ও সন্দেশখালী বিধানসভা আসনে মুসলমান ভোটদাতারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। গড়ে ৫৫ থেকে ৫৭ শতাংশ। এই বসিরহাটেই তৃণমূলের জবরদস্ত নেতা রফিকুল ইসলাম দল ছেড়ে সিপিএম প্রার্থী হয়েছেন। ভোটের সময় দেখা গেল, একমাত্র হাড়োয়া কেন্দ্রে তৃণমূল প্রভাব অটুট রয়েছে, বাকি সব জায়গায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বাম-কংগ্রেস জোটের লোকজন। মুসলমানরা ওখানে কোথাও কংগ্রেস, কোথাও সিপিএমের দিকে সরে এসেছেন। স্বরূপনগরের বাসিন্দা জাফরুলের মতো অনেকেই লক্ষ করেছেন, লোকাল ট্রেনে ও বাসে যাত্রীরা (যাঁদের বড় অংশ মুসলমান) প্রকাশ্যেই আলোচনা করছেন, ১৯ তারিখ ভোটের বাক্স খুললে শুধুই সিপিএম দেখা যাবে।
মুসলমানদের একাংশও যদি এভাবে দক্ষিণবঙ্গে শাসক দলকে ছেড়ে বিরোধী জোটের পাশে দাঁড়ান, তাহলে পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক পালাবদল অনিবার্য। প্রশ্ন হলো, কেন তাঁরা সরছেন। হুগলির ফুরফুরা শরিফের ত্বহা সিদ্দিকী ভোটের মুখেই সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলেন, গালভরা প্রতিশ্রুতি দিলেও মমতার সরকার মুসলমানদের উন্নয়নে কোনো কাজ করেনি। তাঁর কথার ভিত্তি আছে। হাওড়ার উলুবেড়িয়া, পাঁচলা এবং হুগলির খানাকুল প্রভৃতি এলাকায় মুসলমান পরিবারের নারীরা ঘরে ঘরে জরি তৈরির কাজ করে সংসার চালান। ওই সব পরিবারের সন্তানেরা সুদূর মুম্বাই, সুরাট প্রভৃতি শহরে জরি বানানোর কাজ করেন। মমতা ক্ষমতায় এসে বলেছিলেন, পাঁচলায় জরি ‘হাব’ তৈরি হবে। অর্থাৎ জরির যাবতীয় কাজ এখানেই হবে, ছেলেদের মুম্বাই যেতে হবে না। এবার ভোটের প্রচারের একেবারে শুরুতেই পাঁচলায় সিপিএমের মহম্মদ সেলিমের বিশাল জনসভায় মুসলমানরা ভিড় করেছিলেন। তাঁদেরই একজন তিক্ত গলায় মনে করিয়ে দেন, জরি হাবের মতো অনেক প্রতিশ্রুতিই মমতা বাস্তবায়ন করেননি।
কিছুদিন আগেই রাজ্য সরকার মাদ্রাসা বোর্ডের পরীক্ষার ফল প্রকাশ করেছে। মোট পরীক্ষার্থী ৬০ হাজার ৩৫৮ জন। তার মধ্যে ৪৩ হাজার ৩৪৮ জনই ছাত্রী। ছাত্র ও ছাত্রীর সংখ্যার ফারাক ২০১০ থেকেই বেড়ে চলেছে। কারণ সহজেই অনুমেয়। মালদহ, মুর্শিদাবাদ, নদীয়া, দুই চব্বিশ পরগনাসহ গ্রামবাংলার বহু ছেলেই এখন পেটের টানে রাজ্য ছেড়ে ভারতের দক্ষিণতম প্রান্তে কেরালায় কাজ করছেন। কেরালায় প্রকাশিত এক সমীক্ষায় জানা যাচ্ছে, ভিন রাজ্য থেকে কেরালায় আসা শ্রমিকদের ৫২ শতাংশই পশ্চিমবঙ্গের। প্রধানত রাজমিস্ত্রি, ছুতোর, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি ইত্যাদি কাজ করেন। কেরালার শ্রমিক আরব দুনিয়ায় চলে যাওয়ায় সেই শূন্যস্থান পূরণ করছেন এঁরা। পড়াশোনা মাঝপথে ছেড়ে কাজে যোগ দিচ্ছেন।
পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়ন না হওয়ায় নতুন কাজের সুযোগ তৈরি হচ্ছে না। বাধ্য হয়ে শিক্ষায় পিছিয়ে থাকা দরিদ্র মুসলমান পরিবারের সন্তানেরা অনেকেই ঘর ছাড়ছেন। অবস্থার পরিবর্তনের আশা দেখিয়েও মমতা কোনো কাজ করেননি, সেই হতাশা রয়েছে। তার সঙ্গে জাতীয় রাজনীতিতে মোদি সরকার ক্রমেই নানা সমস্যায় জেরবার হওয়ায় নিরাপত্তার অভাবজনিত আতঙ্কও আগের মতো তাড়া করছে না তাঁদের। ফলে ইচ্ছেমতো নিজের পছন্দের দলকে বেছে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন মুসলমানরা। ভোটের ফলে সেটাই পার্থক্য গড়ে দিতে পারে।
রজত রায়: ভারতীয় সাংবাদিক।