মার্চের শেষে মিসরের রাস্তাঘাট ক্ষুব্ধ ও সমালোচনামুখর মানুষের পদভারে কেঁপে ওঠে, আন্তর্জাতিক মহলেও মুসলিম ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় ওঠে। ক্ষুব্ধ ও সমালোচনাকারীদের অভিযোগ, মুসলিম ব্রাদারহুড মিসরে মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করছে।মিসরের প্রসিকিউটর জেনারেল বা প্রধান কৌঁসুলি দেশটির বিশিষ্ট ব্যঙ্গশিল্পী ও টিভি উপস্থাপক বাসেম ইউসেফকে গ্রেপ্তার ও জিজ্ঞাসাবাদ করার নির্দেশ দেওয়ার পর তাৎক্ষণিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশের সরকার ও নাগরিক অধিকারবিষয়ক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সংগঠন উদ্বেগ প্রকাশ করে এ পদক্ষেপের সমালোচনা করে। ‘আল বেরনামেগ’ নামে মিসরের একটি সাপ্তাহিক টিভি অনুষ্ঠানের উপস্থাপক বাসেম ইউসেফ দেশটির একজন খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব। প্রেসিডেন্টের নিযুক্ত কৌঁসুলি তাঁকে গ্রেপ্তার করার নির্দেশ দেন এ অভিযোগ তুলে যে, তিনি ধর্মের অবমাননা করেছেন, প্রেসিডেন্টের অবস্থানের প্রতি কটাক্ষ করেছেন এবং শান্তি ও জনশৃঙ্খলা বিঘ্নিত করেছেন।১৫ হাজার মিসরীয় পাউন্ড মুচলেকার বিনিময়ে বাসেম ইউসেফকে জামিনে মুক্তি দেওয়ার পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র বিভাগের মুখপাত্র ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড যুক্তরাষ্ট্র সরকারের উদ্বেগ ব্যক্ত করে এক বিবৃতিতে বলেন, ‘আমরা উদ্বিগ্ন যে মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করা হচ্ছে। মিসরের সরকার এ মামলাগুলো তদন্ত করছে, কিন্তু ২০১২ সালের ডিসেম্বরে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের বাইরে আন্দোলনকারীদের ওপর আক্রমণ, পুলিশের মাত্রাতিরিক্ত নৃশংসতা এবং বেআইনিভাবে সাংবাদিকদের দায়িত্ব পালনে বাধা দেওয়ার ঘটনাগুলো তদন্তের কাজে গতি নেই, পর্যাপ্ত উদ্যোগও নেই। এখানে সব ক্ষেত্রে আইনের সমান প্রয়োগ লক্ষ করা যাচ্ছে না।’নুল্যান্ডের ভাষ্য অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরিও এসব বিষয়ে মিসরীয় প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসির সঙ্গে কথা বলেছেন।এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের বিশিষ্ট টিভি উপস্থাপক জন স্টুয়ার্ট তাঁর জনপ্রিয় ‘ডেইলি শো’র একটি অংশে বাসেম ইউসেফের প্রতি সংহতি জানিয়ে প্রেসিডেন্ট মুরসির উদ্দেশে বলেন: ‘আপনি মিসরের প্রেসিডেন্ট, যে মিসর মানুষের লিখিত ইতিহাসে প্রাচীনতম ভূমি ও জাতিগুলোর অন্যতম। আপনি তার উত্তরাধিকার বহন করছেন। আপনার জাতি সভ্যতা এনেছে।’গত বছর জন স্টুয়ার্ট তাঁর ডেইলি শো অনুষ্ঠানে একবার বাসেম ইউসেফকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। বাসেম স্বীকার করেছেন, ‘আল বেরনামেগ’ অনুষ্ঠানের ভাবনা তাঁর পরিকল্পনায় এসেছে জন স্টুয়ার্টের ডেইলি শোর অনুপ্রেরণা থেকে, যা চলছে দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে।স্টুয়ার্ট তাঁর অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট মুরসির উদ্দেশে আরও বলেন, ‘আপনার দুশ্চিন্তা কিসের? আপনি মিসরের প্রেসিডেন্ট, আপনার একটা সেনাবাহিনী আছে। আর বাসেমের আছে শব্দ নিয়ে খেলা করার ক্ষমতা আর একটি টিভি অনুষ্ঠান। আপনার আছে ট্যাংকবহর, আছে বিমানবহর—আমরা এসব জানি, আমাদের কাছে এখনো এসবের কাগজপত্র আছে। মিসরের প্রেসিডেন্ট হিসেবে একজন কৌতুকশিল্পীর মুখ বন্ধ করে দেওয়া আপনার সাজে না।...বাসেম এবং যেসব সাংবাদিক, ব্লগার ও বিক্ষোভকারী তাহরির স্কয়ারে গিয়ে সোচ্চার কণ্ঠে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, তাঁদের ছাড়া আপনি, প্রেসিডেন্ট মুরসি আজ তাঁদের ওপর দমন-পীড়ন চালানোর এ অবস্থানে আসতে পারতেন না।’ঘটনাপ্রবাহের অদ্ভুত মোচড়ে বাসেম ইউসেফের গ্রেপ্তার সম্পর্কে জন স্টুয়ার্টের এ ঝাঁজালো মন্তব্যটি প্রকাশ পায় মিসরে মার্কিন দূতাবাসের আনুষ্ঠানিক টুইটার অ্যাকাউন্টে। এর প্রতিক্রিয়ায় মিসরের প্রেসিডেন্টের দপ্তর থেকে বলা হয়, কোনো কূটনৈতিক মিশনের এ ধরনের নেতিবাচক রাজনৈতিক প্রচারণায় লিপ্ত হওয়া সমীচীন নয়। পরে কায়রোতে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত অ্যান প্যাটারসনের নির্দেশে টুইটার অ্যাকাউন্টটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।বাসেম ইউসেফের মামলাটির ফলে মিসরের ক্ষমতাসীন মুসলিম ব্রাদারহুড, প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে তার প্রতিনিধি ও আমেরিকান প্রশাসনের মধ্যকার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্ক নিয়ে অনেক প্রশ্ন ও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলোর মধ্যে রয়েছে: ১. ব্রাদারহুড ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার মধুচন্দ্রিমার কি অবসান ঘটল? ২. দুই দেশের এ পারস্পরিক স্বার্থের প্রকৃত উৎস কী (মিসরের সরকারের রূপ যা-ই হোক না কেন—সামরিক, স্বৈরতান্ত্রিক বা এখনকার মতো ধর্মভিত্তিক)? ৩. ২০১১ সালের গণ-অভ্যুত্থানের সময় হোয়াইট হাউস যেভাবে হোসনি মোবারকের সরকারের ওপর থেকে রাজনৈতিক সমর্থন তুলে নিয়েছিল, মুসলিম ব্রাদারহুডের বেলায়ও শেষ পর্যন্ত তা করার সম্ভাবনা কি রয়েছে? ৪. মধ্যপ্রাচ্যের সর্বাধিক জনসংখ্যার দেশটি শাসন করছে যে মুসলিম ব্রাদারহুড, তাদের গ্রহণযোগ্যতা নিঃশেষ করে দিতে যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও সংবাদমাধ্যমের প্রভাব কতটা কার্যকর হতে পারে?মিসরের বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাংবাদিক মোহামেদ হাসানাইন হাইকেল জোর দিয়ে বলেছেন, মুসলিম ব্রাদারহুডের একসময়ের অন্যতম জ্যেষ্ঠ সদস্য মোহাম্মদ মুরসির মিসরের প্রেসিডেন্ট হওয়ার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র মিসরের রাষ্ট্রক্ষমতায় রাজনৈতিক ইসলামতন্ত্রের অধিষ্ঠানের পক্ষে সবুজসংকেত দিয়েছিল। হাইকেল আরও বলেন, ব্রাদারহুডের ক্ষমতায় যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা অত্যন্ত প্রবল ছিল বলেই তারা বাধ্য হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতামূলক সম্পর্কের পথ বেছে নিতে। হাইকেল আরও ইঙ্গিত দিয়েছেন, মিসরে হিজাব ও নিকাবের ব্যবহার ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেওয়ায় আন্তর্জাতিক মহলের ধারণা হয়েছে, এ দেশে রাজনৈতিক ইসলামতন্ত্রের পক্ষে জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের সমর্থন আছে।হাইকেল এ-ও দাবি করেন, ২০০৫ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনের আগে হোয়াইট হাউস সে সময়ের মোবারক সরকারকে একটি চিঠিতে বলেছিল, মুসলিম ব্রাদারহুডকে একটা সুযোগ দেওয়া হোক। মোবারকের সরকার তাতে রাজি হয়েছিল। ক্ষমতার পথে মুসলিম ব্রাদারহুডের ক্রমে অগ্রসর হওয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতার সরকারি সিদ্ধান্ত ওয়াশিংটন গ্রহণ করে সেই সময়েই। কিন্তু ব্রাদারহুড যে এত দ্রুত ক্ষমতায় চলে আসবে, সেটা বিস্ময়কর।একুশ শতকের শুরু থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার জিহাদি নয়—এমন ইসলামি গ্রুপগুলোকে সহযোগিতা করে আসছে। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের চরম পর্যায়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশের কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে উগ্র নয়, জিহাদি নয়, এমন ইসলামপন্থী রাজনৈতিক ধারাগুলোর জনপ্রিয়তা বেড়ে যাচ্ছে; তিউনিসিয়া, মিসর, লিবিয়া ও সিরিয়ায় এ ধরনের রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলো ক্রমে বেশি করে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হচ্ছে।মিসরের শাসকের পরিচয় কী, তা কোনো বিষয় নয়; কিছু বিষয় যেন পাথরে খোদাই করা আছে: ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিচুক্তির প্রতি মিসরের অঙ্গীকার, তেল পরিবহনের পথ হিসেবে সুয়েজ খাল সব সময় খোলা রাখা, সন্ত্রাসবাদ দমনে দুই দেশের মধ্যে কৌশলগত সহযোগিতা, আঞ্চলিক ক্ষমতার ভারসাম্য অক্ষুণ্ন রাখতে মিসরের সেনাবাহিনীর মর্যাদা রক্ষা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতাসহ নাগরিক অধিকার ও সংখ্যালঘুদের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা।কোনো কোনো বিশ্লেষক বলছেন, ওবামা প্রশাসন এ মুহূর্তে তার প্রিয় কৌশলটিই প্রয়োগ করছে। সেটা হলো সময়ক্ষেপণ। যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে সামরিক সংঘাত এড়াতে এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায়, যখন অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে আলোচনা-সংলাপ সম্ভব হবে না, যেমনটি ঘটেছে মিসর, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, ইরাক ও আফগানিস্তানে।মিসরীয় সাংবাদিক এমাদ আলদিন আদিবের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের এ কৌশলের তিনটি সুবিধা আছে। একটি হলো, এতে যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে বেশি মাথা না ঘামিয়ে, যুদ্ধের বিপুল ব্যয় এড়িয়ে নিজের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো সমাধানের প্রতি বেশি মনোযোগ দিতে পারে (শুধু এশিয়ার ব্যাপারে উদ্বেগ ছাড়া, বিশেষত চীন, জাপান ও কোরিয়া নিয়ে)।কিছু মানুষ চায় ইসলামি গোষ্ঠীগুলোর কঠোর হাত থেকে মিসরকে রক্ষা করতে সেনাবাহিনী ফিরে আসুক। অন্যরা মনে করে, এ ধরনের কিছুর জন্য যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সম্মতির দরকার হবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এটাতে সায় দেবে কেবল তখনই, যখন তার নিজের স্বার্থ বিপন্ন হবে।এটা কোনো গোপন বিষয় নয় যে, মোবারকের সরকার টিকে থাকার সামর্থ্য তখনই হারিয়ে ফেলে, যখন যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে ঘোষণা করে যে মিসরে পরিবর্তনের সময় এসে গেছে। তখন থেকেই মোবারকের পায়ের তলার মাটি কাঁপতে শুরু করে এবং ক্রোধে গর্জে ওঠা আন্দোলনকারীদের সামনে তাঁর সরকারের মনে হয় যেন সে মেরুদণ্ড হারিয়েছে।প্রেসিডেন্ট মুরসির বিরুদ্ধেও কি অচিরে একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটতে যাচ্ছে?ইংরেজি থেকে অনূদিতকামাল গাবালা: মিসরের দৈনিক আল-আহরাম পত্রিকার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক।