মূল সমস্যা কোথায়?

একটি নগরকে বাসযোগ্য করতে হলে কিছু নিয়মনীতি মেনে চলতে হয়
একটি নগরকে বাসযোগ্য করতে হলে কিছু নিয়মনীতি মেনে চলতে হয়

আমার বিভিন্ন দেশের সহকর্মীরা, যাঁরা বাংলাদেশে এসেছেন, সবারই আলোচনার বিষয় এক—ঢাকার যানজট। এঁদের মধ্যে অনেকেরই ধারণা, যানজটের সমস্যা আসলে উন্নয়নশীল দেশগুলোর নগর প্রশাসনের সামগ্রিক দুর্বলতার প্রতীক। ঢাকাবাসীর সঙ্গে যানজট নিয়ে কথা উঠলেই দুই ধরনের পরাজিত মানসিকতা দেখা যায়। এটার কোনো সমাধান অদূর ভবিষ্যতে নেই আর এভাবেই চলবে, এর মাঝেই বেঁচে থাকতে হবে। শত হতাশার মধ্যেও সরকারি আর বেসরকারি বিশেষজ্ঞরা তাঁদের সমাধান দিয়ে চলেছেন। এর মাঝে নগর উন্নয়ন তত্পরতা থেমে নেই। অনেক ফ্লাইওভার নির্মিত হচ্ছে আর ভূমি-ঊর্ধ্ব দ্রুতগতির রাস্তার পরিকল্পনা চলছে। কিন্তু যানজটের সমস্যা প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে।
আসল কথায় আসা যাক। ঢাকার যানজট সমাধানের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে নগর প্রশাসনের বেপরোয়া বিশ্বাস যে এই সমস্যার একটা সহজ সমাধান আছে। ফ্লাইওভার অথবা দ্রুতগতির রাস্তা অথবা এমনকি গণপরিবহন–ব্যবস্থাকে ঢাকার যানজটের একমাত্র সমাধান ভেবে বসলে এই প্রকট নগর সমস্যার মৌলিক উত্সগুলোকে বোঝা তো যাবেই না, সমাধান তো দূরের কথা।
একটি পরিস্থিতির কথা ভাবা যেতে পারে। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঢাকায় রাস্তার মোড় আছে ৬৫০টির মতো। অথচ ট্রাফিক লাইট আছে মাত্র ৬০টিতে। এত বড় রাজধানী শহরে রাস্তার এই সমীকরণ কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও ধারণা করা ভুল হবে যে মোড়ে মোড়ে লাইট বসালেই যানজটের সমাধান হয়ে যাবে। ট্রাফিক লাইটকে যানজটের সমাধান ভেবে বসলে এই ব্যাপক নগর সমস্যার মিথ্যা সরলীকরণই হবে। যত দিন নগরবাসী বুঝতে না পারবে যে ট্রাফিক লাইট মেনে রাস্তায় চলাচল করা নগরজীবনের একটি মৌলিক চাহিদা, তত দিন যানজট নিরসনের কোনো সম্ভাবনা নেই।
গণপরিবহনের জন্য নির্ধারিত লেন একটি পরীক্ষিত নগরব্যবস্থা। কিন্তু যে তরুণ বাসচালক গ্রাম থেকে শহরে এসেছে দুই বছর আগে, তার রাস্তার নিয়মকানুন মেনে চলার আগ্রহ থাকবে, এটা আশা করাটা একই সঙ্গে অবাস্তব এবং অযৌক্তিক। একজন বাসচালক যেখানে–সেখানে বাস থামিয়ে যাত্রী নিচ্ছে এবং এর ফলে যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। এই সমস্যার কারিগরি সমাধান নেই। এখানে বাসচালকদের নগর সড়কব্যবস্থার নিয়মনীতির মৌলিক চাহিদাকে বুঝতে না পারাকে বিশ্লেষণ করতে হবে নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে।
রাস্তায় জেব্রা ক্রসিং এঁকে দিলেই কি পথচারীরা তা মেনে চলবে? এখানে সবচেয়ে কঠিন প্রশ্ন হলো, পথচারীদের কীভাবে উদ্বুদ্ধ করা যায় রাস্তার নিয়মকানুনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে? পৃথিবীর বড় বড় শহর, যেমন লন্ডন, প্যারিস, আর নিউইয়র্ক, তাদের নগর বিবর্তনের একপর্যায়ে এই সরল-জটিল প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছে এবং সামাজিক সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছিল। এ থেকে আমাদের যা শিক্ষণীয় তা হলো: নগর সড়ককে কার্যকর করতে হলে নগরবাসীকে অলিখিতভাবে স্বীকার করে নিতে হবে যে সুষ্ঠু নগরজীবন তৈরির দায়িত্ব সবার। বাসযোগ্য নগরজীবন তৈরি করা একটি সামাজিক দায়িত্ব। অর্থাৎ, একটা শহরকে সুষ্ঠুভাবে টিকে থাকতে হলে নগরবাসীর কিছু প্রাত্যহিক নগর আচরণকে নগরজীবনের সামাজিক বিধি হিসেবে মেনে নিতে হবে।
শহরের নিয়মনীতি মেনে চলার সামাজিক দায়িত্ববোধের যে অভাব রয়েছে, আমাদের মধ্যে তা কিছুটা প্রত্যাশিত। কারণ, আমাদের নগর ইতিহাস খুবই সংক্ষিপ্ত। ১৯৭১ সালে আমাদের নগর জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৭ শতাংশ। কাজেই যানজটের মতো একটি বহুমাত্রিক সমস্যার সমাধানও খুঁজতে হবে বহুমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। এর জন্য প্রয়োজন সভ্য নগর আচরণ তৈরির সামাজিক উদ্যোগ আর টেকসই সড়ক প্রকৌশলের সমন্বয়। বাস্তবতা হলো এই লক্ষ্য পূরণ করতে হয়তো এক বা দুই প্রজন্ম পার হয়ে যেতে পারে।
কত তাড়াতাড়ি যানজটের মতো একটি নগর সমস্যার নিরসন করা যাবে, তা নির্ভর করবে আমরা কত তাড়াতাড়ি যানজটের সনাতনি, একপক্ষীয় কারিগরি সমাধানের বাইরে গিয়ে একে মানবিক সমস্যার আলোকে দেখতে পারব। প্রযুক্তির প্রয়োগ যত সহজ, সামাজিক পরিবর্তন তত সহজ নয়। যানজট নিরসনের জন্য প্রয়োজন নগর মানসিকতার সাংস্কৃতিক পরিবর্তন। এই পরিবর্তন আনতে হলে বুঝতে হবে আমাদের নগর পরিকল্পনার মানসিকতায় মধ্যবিত্ত মূল্যবোধের ভূমিকা। যেমন আমাদের নগরচেতনা প্রায়ই ব্যক্তিগত গাড়ির মালিকানাকে প্রাধান্য দেয়। আরও বেশি সড়ক তৈরি হোক, যাতে করে ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার আরও বাড়ে। চাহিদা এবং জোগানের অসম্ভব সমীকরণের ভেতরে বন্দী আমাদের পরিকল্পনার মানসিকতা। একটি উদাহরণ লক্ষণীয়, ঢাকার প্রাত্যহিক কাজকেন্দ্রিক যাতায়াতের মাত্র ৫-১০ শতাংশ ব্যক্তিগত গাড়ির মাধ্যমে পূরণ হয়। অথচ সড়ক পরিসরের ৭০-৮০ শতাংশ গ্রাস করে ব্যক্তিগত গাড়ি। গণপরিবহন–ব্যবস্থাকে অগ্রাহ্য করে, ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহারকে প্রাধান্য দিয়ে নগর পরিকল্পনা করলে এ ধরনের বৈপরীত্য তৈরি হবেই।
গণপরিবহন–ব্যবস্থা আমাদের দেশে সব সময়ই অবহেলিত, তার প্রধান কারণ, আমাদের শাসকশ্রেণি আর মধ্যবিত্তের চেতনায় ব্যক্তিগত গাড়ির মালিকানাকে সামাজিকভাবে মহিমান্বিত করা হয়েছে। এটাও ঠিক যে অনেকেই রাস্তাঘাটে নিরাপত্তার অভাব এবং নারীদের চলাচলে সামাজিক অস্বস্তির বিপরীতে ব্যক্তিগত গাড়িকে আবশ্যিক সমাধান হিসেবে দেখেন। কিন্তু এটাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে আমাদের মধ্যবিত্তের মনমানসিকতায় গাড়ির মালিকানাকে দেখা হয় অর্থনৈতিক উন্নতির সবচেয়ে উজ্জ্বল প্রতীক হিসেবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই মানসিকতাই আমাদের নগর এবং সড়ক পরিকল্পনার মূল চালিকাশক্তি। ভালো গণপরিবহন–ব্যবস্থা যে আবশ্যিকভাবে ব্যক্তিগত গাড়ির ওপরে নির্ভরতা কমিয়ে আনবে—এ রকম পর্যাপ্ত জরিপনির্ভর প্রমাণ নেই।
যানজটের সৃষ্টিশীল নিরসনের জন্য এ কারণেই আমাদের এই সমস্যাকে নগরবাসীর সামাজিক আচরণের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে কেন দিল্লির রাস্তায় ৮০ লাখ ব্যক্তিগত গাড়ি ছুটে চলেছে। প্রতিদিন ১ হাজার ২০০ নতুন গাড়ি যোগ হচ্ছে দিল্লির রাস্তায়। ঢাকার রাস্তায় প্রতিদিন ২০০-র ওপর গাড়ি নামছে। এই বিশাল স্রোতকে সামাল দিতে আরও বেশি রাস্তা কোনোমতেই সমাধান নয়। চাহিদা এবং জোগানের সনাতনি নগরচিন্তা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। যতই নতুন রাস্তা তৈরি হোক না কেন, ব্যক্তিগত গাড়ির বহর তা শিগগির গ্রাস করে ফেলবে।
কাজেই আমাদের নগর পরিকল্পনার দার্শনিক এবং কাঠামোগত পরিবর্তন প্রয়োজন। জোগান দেওয়ার দক্ষতাকে নয়, বরং চাহিদাকে কমিয়ে আনার ওপরে প্রাধান্য দিতে হবে। সেই সঙ্গে নগরবাসীর মধ্যে নিয়ম মানার সংস্কৃতি তৈরির সামাজিক আন্দোলন শুরু
করা প্রয়োজন।
একটি নগরকে বাসযোগ্য করে তুলতে কিছু নিয়মনীতি মেনে চলতে হবে। এই ধারণাকে একটি বৃহত্তর সামাজিক মূল্যবোধে পরিণত করতে হবে। রৈখিক, ভোগবাদী আর ব্যক্তিনির্ভর নগরজীবন নয়, সামাজিক দায়বদ্ধতা আর জনসম্পৃক্ততার নগরায়ণ হচ্ছে ভবিষ্যতের কাঙ্ক্ষিত পথ। আজকে টেকসই নগরায়ণের যে বৈশ্বিক আন্দোলন শুরু হয়েছে, তার মূল কথাই হচ্ছে এটি।
আদনান মোর্শেদ: সহযোগী অধ্যাপক, স্থাপত্য ও পরিকল্পনা, ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটি অব আমেরিকা, ওয়াশিংটন ডিসি।