‘মৃত’ মেয়েটির ফিরে আসা...

বাংলাদেশ জাদুবাস্তবতার দেশ হয়ে গেছে। এই দেশে খালে-বিলে-নদীতে পানি নেই, কিন্তু রাজপথে–মহাসড়কে পানি, ঘরদোরে পানি। এই দেশ গরিব, কিন্তু কেউ দুই–চার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে গিলে ফেললে আমরা বলি, দুই হাজার কোটি টাকা এমন কী! এই দেশে নর্দমা দিয়ে টাকা ভেসে যায় আর মানুষ তা ধরে ধরে তোলে। এই দেশে টাকা থাকে বালিশে! ২০ হাজার টাকা বেতনের মিটার-রিডার ৪০ হাজার টাকা বেতন দিয়ে তিনজনকে নিয়োগ করে আর সে নিজে পাজেরো গাড়ি হাঁকিয়ে গোটা ছয়েক ছয়তলা বাড়ির ভাড়া তুলে খায়! এই দেশে শুধু বোনাস পাওয়ার লোভে ১০ হাজার টাকার বিদ্যুতের বিল ২ লাখ টাকা বানিয়ে গ্রাহকের কাছে পাঠানো যায়।

এখন এই দেশে ধর্ষণের শিকার, তারপর নিহত বলে প্রচারিত একটি মেয়ে ফিরে এসেছে। সেটা আমাদের জন্য সুখবর হলেও নারায়ণগঞ্জ সদর থানার পুলিশদের জন্য চরম দুঃসংবাদ। কারণ, এরই মধ্যে তিনজন স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছে যে তারা মেয়েটিকে ধর্ষণ করে হত্যা করেছে। আর এই দায় থেকে মুক্তির আশায় পুলিশকে ঘুষও দিয়ে ফেলেছে! এখন পুলিশ পরিবারগুলোর পেছনে পেছনে ঘুরছে ঘুষের টাকা ফেরত দিতে!

এই কৌতুকটা পুরোনো। তিন দেশের পুলিশের যৌথ প্রশিক্ষণ ক্যাম্প চলছে। বন থেকে হরিণ ধরে আনতে হবে। ব্রিটিশ পুলিশ আধঘণ্টায় হরিণ ধরে আনল। আমেরিকান পুলিশ দুই ঘণ্টা পরে একটা হরিণকে বুটে চেপে মেরে তার দেহ আনল। আর ‘দেশি’ পুলিশ দুই দিন ধরে ফেরে না। দুই দিন পর একটা ছাগল ধরে আনল তারা। কী ব্যাপার? ছাগল কেন? ‘দেশি’ পুলিশ বলল, আরে, কে বলে ছাগল? ওরে রিমান্ডে নিতে দেন। ও নিজেই স্বীকার করবে ও হরিণ।

হায়! এটা যে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ ঘটিয়ে ছাড়বে কে জানত! যে মেয়ে আদৌ মারা যায়নি, তাকে হত্যার দায় তিন–তিনজন স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়ে বসে আছে!

এই দেশে রিমান্ডের নামে অত্যাচার করা হয়। এই দেশে নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবার সংবাদ সম্মেলনে কেঁদে বলে, ক্রসফায়ার ভিকটিমের পরিবারের তবু সান্ত্বনা আছে, গুম হয়ে যাওয়া পরিবারের তো তা–ও নেই, আমরা যে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি।

আপনাকে একদিন পুলিশ ধরে নিয়ে গেল। ধরা যাক, আপনার নাম জজ মিয়া। আপনাকে সেদ্ধ ডিম দিয়ে বলল, বল, তুই গ্রেনেড মেরেছিস। আপনার নাম লাল মিয়া, সবুজ মিয়া, আপনার নাম অ্যাপেলা, ডিউক, আপনার নাম শরৎ, হেমন্ত, বসন্ত, আপনাকে বলল,
তুই রেপ করেছিস, খুন করেছিস। ডিমের সঙ্গে দুটো মরিচ ডলে দিলে আপনি বলবেন, অবশ্যই করেছি, আর কী কী করেছি স্যার লিখে দ্যান, কোথায় সাইন করতে হবে বলেন।

বলছি বটে, কিন্তু আপনার চোখে পানি আসবে, যদি আপনি ভাবেন কতখানি নির্যাতন করা হলে একটা লোক স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে অপরাধ সংঘটিতই হয় নাই, সেটা সে করেছে। শুধু স্বীকার করলেই তো হবে না, বাড়ি থেকে ঘটিবাটি, সহায়সম্বল বেচে টাকা এনে দিতে হবে।

শারীরিকভাবে নির্যাতিত না হওয়ার অধিকার মৌলিক মানবাধিকার। প্রথম আলো অনলাইনের খবর, সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলের ছেলে বলেছেন, তাঁর বাবাকে ৫৩ দিন চোখ বেঁধে রাখা হয়েছিল। তিনি অন্ধপ্রায়। এই অভিযোগ মিথ্যা, এই কথা বলার লোকও তো নাই। কারণ, তিনি কোথায় ছিলেন, আমরা তো জানি না। আমরা কি জিগ্যেস করতে পারি, একজন সাংবাদিক কেন দীর্ঘদিন নিখোঁজ ছিলেন? কেন তাঁকে ‘উদ্ধার’ করার পর হাতকড়া পরিয়ে নেওয়া হয়েছিল? তাঁর ছেলে বলছেন, আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও তাঁর বাবাকে কারাগারে সুচিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে না! আপনারা কী আইন করলেন যে একজন সাংবাদিক জামিন পাচ্ছেন না? এদিকে করোনার বিষয়ে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার অভিযোগে ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়, চারজন কারাগারে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস বলেন, ‘কেবল একটি অনিরাপদ ও স্বৈরাচারী সরকার কার্টুনিস্ট, সাংবাদিক এবং নেতা–কর্মীদের গ্রেপ্তারের জন্য মহামারিকে ব্যবহার করে। কেবল ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ পোস্ট করার কারণে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে এমন মামলা দায়ের না করে বরং আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনাগুলো গ্রহণ করা উচিত এবং কোভিড-১৯-এর বিষয়ে সরকারের প্রতিক্রিয়াতে যেকোনো ফাঁক থাকলে তা বন্ধ করার চেষ্টা করা উচিত।’ (প্রথম আলো, ৮ মে ২০২০)

রাষ্ট্র ও সরকারের বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাতমূলক কাজ না করে, ধ্বংসাত্মক কাজ না করে নিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রতিবাদ করা, ব্যঙ্গ–বিদ্রূপ করাই তো ভালো। সরকারের তাতে খুশি হওয়া উচিত। বহুদিন আগে নাট্যকার ব্রেখট বলেছিলেন, এখন এই সমাজকে নিয়ে কিছুই করার নেই, শুধু বিদ্রূপ করা ছাড়া। আমেরিকায় স্যাটায়ার বা বিদ্রূপ করাকে বৈধ হিসেবে গণ্য করা হয়। এটা ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশন্স। আমেরিকার সংবিধানের প্রথম সংশোধনীতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে নিরঙ্কুশ গ্যারান্টিযুক্ত করে রাখা হয়েছে। শফিকুল ইসলাম কাজলকে মুক্তি দিন। কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরসহ ব্যঙ্গ করার অভিযোগে আটক চারজনকে মুক্তি দিন।

যে দেশে নিচতলা থেকে তিনতলায় বালিশ ওঠানোর জন্য হাজার টাকা বিল করা হয়, যে দেশে পর্দার দাম লাখ টাকা ধরা হয়, যে দেশে একটা ল্যাক্টোমিটারের দাম কয়েক লাখ টাকা প্রাক্কলিত হয়, যে দেশে যে মারা যায়নি, তাকে মারার দায় স্বীকার করে তিনজন জবানবন্দি দেয়, সেই দেশটা জাদুবাস্তবতার দেশ। সেই দেশে মানুষ বাঁচতে পারে কেবল কৌতুক করে, ব্যঙ্গ–বিদ্রূপ করে। করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে আমাদের মন হাসিখুশি রাখতে হবে। দেশে এমন সব কাণ্ড ঘটছে যে কাঁদতে গিয়ে মানুষ হেসে ফেলছে, চুল ছিঁড়তে গিয়ে নিজের ভুরু ছিঁড়ে ফেলার জোগাড়। এগুলোর প্রতিবিধান চাইতে পারব কি না, চাইলে আদৌ প্রতিবিধান পাব কি না, জানি না। অন্তত ব্যঙ্গ–বিদ্রূপ করতে দিন।

ফিরে আসা ‘মৃত’ মেয়েটি যেন ভালো থাকে। রবীন্দ্রনাথের গল্পের মতো যেন না হয়, কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল সে মরে নাই। একটা গল্প পড়েছিলাম, এক লোকের নামের আগে মৃত ছাপা হয়েছে। লোকটি তালিকাওয়ালাদের কাছে গেলে তাঁরা বলেন, আপনি যে মরেন নাই, তার কি কোনো প্রমাণ আছে? আপনি সার্টিফিকেট আনেন যে আপনি মরেননি। নারায়ণগঞ্জের এই মেয়েটিকে যেন এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে না হয়।


আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক