মৃতপ্রায় রংপুরের শত নদী

বাংলাদেশ ছিল সহস্রাধিক নদ-নদীর দেশ। ‘নদীমাতৃক’ বিশেষণে বিশেষায়িত। দেশবাসীর পরিচয় মাছে-ভাতে বাঙালি। সেই সহস্রাধিক নদ-নদীর বাংলাদেশে এখন ছয় মাস নদী থাকে। বাকি ছয় মাস দেখা যায় নদীর কঙ্কাল। রংপুর বিভাগের বিভিন্ন জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রায় এক শ নদ-নদীই এখন পানিশূন্য। শুষ্ক মৌসুমে আগে এই নদীগুলো একেবারে শুকিয়ে যেত না। কিছুটা পানি থাকত। মানুষ পানির স্বাভাবিক প্রবাহে বিভিন্ন রকমের কৃত্রিম সংকটের সৃষ্টি করে নদ-নদীগুলোকে মেরে ফেলার ব্যবস্থাই করেছে।
একসময়ের প্রায় ১১ কিলোমিটার প্রশস্ত খরস্রোতা ব্রহ্মপুত্রের এখন করুণ দশা। হেঁটে চরের ওপর দিয়ে পার হওয়া যায় তিস্তা। তিস্তা, বুড়ি তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার, ফুলপুর, নীলকমল, রতনাই, করতোয়া, রণচণ্ডী, আত্রাই, মহানন্দাসহ বিভিন্ন নদ-নদীর পানির প্রবাহে ভারত বাঁধ দিয়ে বাংলাদেশ অংশ পানিশূন্য করে রেখেছে।
যমুনেশ্বরী, ঢেপা, ইছামতী, ছোট যমুনা, ঘাঘট, আঁখিরা, হলহলিয়াসহ অন্যান্য নদ-নদীও এখন কোথাও নালা কিংবা খালে রূপ নিয়েছে। কোথাও বা এমনভাবে চাষাবাদ হচ্ছে, বোঝারই উপায় নেই সেগুলোর আসল রূপ।
নদ-নদীগুলো কঙ্কালসার হওয়ার কারণে জলপথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে ভীষণ নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে কয়েক শ ঘাট। নদীপথে রংপুরের সমৃদ্ধ যোগাযোগ ছিল। নদীর যেসব অংশে সামান্য পানি আছে, সেখানে খনন না করার কারণে দীর্ঘ পথ ঘুরে যেতে হয়।
নদীগুলো পানিশূন্য থাকায় যাঁরা নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন কিংবা নৌকা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন, তাঁদের এখন অন্য পেশার সন্ধান করতে হচ্ছে। বর্ষাকালে নদীর ভাঙনে অনেক মানুষ সহায়সম্পদহীন হয়, গৃহহীন হয়। আবার তারা শুষ্ক মৌসুমেও পানিশূন্যতায় কর্মহীন হয়ে পড়ে।
গত ২২ মার্চ বিশ্ব পানি দিবস উপলক্ষে এনজিও ফোরামের উদ্যোগে বেশ কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা এবং সরকারি সংস্থা যৌথভাবে ঢাকায় একটি সেমিনারের আয়োজন করেছিল। সেই সেমিনারে রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, রাঙামাটি, সিলেট, হাওর অঞ্চল এবং রংপুর অঞ্চলের পানি ও জীবিকা নিয়ে একটি করে প্রবন্ধ পড়া হয়। রংপুরের অবস্থা তুলে ধরার জন্য আমিও সেখানে উপস্থিত ছিলাম। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের মিলনায়তনে সেদিন উপস্থাপিত প্রতিটি প্রবন্ধে সেই অঞ্চলগুলোর সংকটের কথা উঠে এসেছে। রাজশাহীর নদ-নদীগুলো একেবারেই পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। খুলনার পানিতে লবণাক্ততা বেড়েই চলেছে, যার অন্যতম কারণ—উজানের নদীগুলোতে পানির প্রবাহ না থাকায় সমুদ্রের লবণাক্ত পানির ক্রমশ ওপরের দিকে উঠে আসা। হাওর অঞ্চলের প্রবন্ধপাঠক বলছিলেন, হাওর তাঁদের জন্য আশীর্বাদ। আবার একই সঙ্গে তা অভিশাপও। পার্বত্য এলাকায় পানীয় জলের সংকট চরমে।

>রংপুরে আরেকটি নদীর নাম আঁখিরা। নৌকায় করে প্রতিদিন পার হয়ে স্কুল করতেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আর এম হাফিজুর রহমান। তিনি দুঃখ করে বলছিলেন, আগে আঁখিরা পার হতে আধা ঘণ্টার প্রয়োজন হতো। প্রশস্ত আঁখিরার এখন কী মৃত দশা!

রংপুর বিভাগে প্রায় এক শ নদ-নদীর নাম এখনো পাওয়া যায়। বগুড়ার একজনের সঙ্গে রংপুরে কথা হচ্ছিল করতোয়া নিয়ে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘করতোয়া দেখার চেয়ে একটি খাল দেখাও ভালো।’ করতোয়ার এতটাই করুণ অবস্থা। অথচ এই করতোয়ার পাশেই গড়ে উঠেছিল ঐতিহাসিক পুন্ড্রের রাজধানী মহাস্থানগড়। উত্তরাঞ্চলের সবচেয়ে বড় নদী ছিল এই করতোয়া। আড়াই হাজার বছর আগেও এই নদী ছিল।
আদি রংপুর মাহীগঞ্জ গড়ে উঠেছিল ঘাঘট নদের তীরে। সেই ঘাঘটের ঘাটে ভিড়ত অসংখ্য বাণিজ্যতরি। বর্তমানে যে খোকসা ঘাঘট আছে, সেই ঘাঘটকে অনেকেই শ্যামাসুন্দরী খালের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলেন। শ্যামাসুন্দরী খাল যখন কাটা হয়, তখন সেই খাল ঘাঘট থেকে এসে মিশেছিল তিস্তার শাখানদী ইছামতী। এখন সেই ইছামতীর কোনো অস্তিত্বই নেই। গণমাধ্যমকর্মী শাহাজাদা মিয়া বলেন, আজ থেকে ৩৫-৪০ বছর আগে মাহীগঞ্জ এলাকায় পুকুর খনন করতে গিয়ে বড় একটি নৌকার গলুই পাওয়া গিয়েছিল। এতে বোঝা যায়, মাহীগঞ্জ গড়ে উঠেছিল নদীরই পাশে।
রংপুরের নদীর অনেকগুলোতে ছিল ছোট-বড় অসংখ্য বন্দর, যা এখন শুধুই অতীত। রংপুরের হারাগাছে তিস্তা নদীকেন্দ্রিক বন্দর ছিল একসময়। সেই নৌবন্দর, সেই নদী—কোনোটিরই এখন সন্ধান পাওয়া যায় না। অথচ এই বন্দরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বাণিজ্য করতে বণিকেরা আসতেন। ইংরেজরাও নৌপথে এসে এখানে তামাকের চাষ শুরু করেছিল। একইভাবে নীলফামারীতে বামনডাঙ্গা নদীর পাড়ে ছিল শাখামাছি বন্দর। সেই নদীবন্দরের এখন আর কিছু অবশিষ্ট নেই। দিনাজপুরে কাঁকড়া ও চিরি নদীর সংযোগস্থলে গড়ে উঠেছিল চিরিরবন্দর। এখন আর সেই বন্দর নেই। ব্রহ্মপুত্রের ওপর চিলমারীর বিখ্যাত বন্দরটিও নেই। এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যবন্দর ছিল এই চিলমারী। রাজারহাট, কাউনিয়া, মোগলহাটেও ছিল বন্দর। বর্তমানে এগুলোর অস্তিত্বই নেই।
রংপুরে আরেকটি নদীর নাম আঁখিরা। নৌকায় করে প্রতিদিন পার হয়ে স্কুল করতেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আর এম হাফিজুর রহমান। তিনি দুঃখ করে বলছিলেন, আগে আঁখিরা পার হতে আধা ঘণ্টার প্রয়োজন হতো। প্রশস্ত আঁখিরার এখন কী মৃত দশা!
কুড়িগ্রামের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার, ফুলকুমর, বোয়ালমারী, শিয়ালদহ, জিঞ্জিরাম, সোনাইমুড়ি, কালনদী, গঙ্গাধর, ধরণী, হলহলিয়া, কালকিনি, নীলকমল, জালশিরা। এগুলোর মধ্যে অল্প পরিমাণে পানি আছে ব্রহ্মপুত্রে। অন্যগুলোর অবস্থা তো আরও করুণ। কোনো কোনোটিতে কোনো পানিই থাকে না। এর মধ্যে জিঞ্জিরােম ভারতের বাঁধ দেওয়ার কারণে বাংলাদেশ অংশে এসে মরে গেছে। নীলকমলসহ অনেকগুলো নদ-নদীর অবস্থা সরু খালের মতো। কুড়িগ্রামের ১৬টি নদ-নদীর কোনো যত্ন না নেওয়ার কারণে এবং ভারতের স্বেচ্ছাচারের কারণে বর্ষা ও শুষ্ক উভয় মৌসুমেই কুড়িগ্রামবাসীর জন্য অভিশাপ হয়ে দেখা দেয়।
দিনাজপুরের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রায় কুড়িটি নদী এখন পানিশূন্য। পঞ্চগড়ের ওপর দিয়ে বয়ে চলা কুড়িটির বেশি নদ-নদীর অবস্থাও সংকটাপন্ন। নীলফামারীর বড় নদীগুলো এখন মৃত। লালমনিরহাটের ১২-১৩টি নদ-নদীর কোনোটিই শুষ্ক মৌসুমে নদীর বৈশিষ্ট্য নিয়ে বেঁচে থাকে না। একইভাবে গাইবান্ধা-ঠাকুরগাঁও ও রংপুরের নদ-নদীরও মরণ দশা লক্ষ করা যাচ্ছে।
তাই বিলম্ব না করে নদ-নদী রক্ষায় এখনই কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করা জরুরি।
তুহিন ওয়াদুদ: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর। সিনেটর, রিভারাইন পিপল।
[email protected]