মৃত্যুর হুমকি পদে পদে

১৫ নভেম্বর শনিবার ভরদুপুরে খুন হয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক এ কে এম শফিউল ইসলাম। সমাজবিজ্ঞান বিভাগের এই শিক্ষকের মাথায় ও ঘাড়ে চাপাতিজাতীয় ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানো হয়েছিল। মনে পড়ছে, বেশ কয়েক বছর আগে একুশের বইমেলার উজ্জ্বল আলো থেকে বাইরের আলো-আঁধারির রাস্তায় যখন পা রেখেছিলেন ঘরমুখো অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ, তাঁকেও কোপানো হয়েছিল একইভাবে। তাৎক্ষণিকভাবে তিনি খুন হননি সেদিন, কিন্তু আমরা জানি ওই ঘটনায় তাঁর মৃত্যু ত্বরান্বিত হয়েছিল। মুক্তমনা ও সংস্কৃতিসেবী হিসেবে অধ্যাপক শফিউল ইসলামের সুনাম ছিল। তাঁর সহকর্মী ও বিভাগের শিক্ষার্থীরা তাঁকে ভালোবাসতেন—এমন মন্তব্য ও সত্যভাষণ গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। হুমায়ুন আজাদ, শফিউল ইসলাম অথবা ব্লগার রাজীবকে চিহ্নিত বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে অচেনা ঘাতকেরা কোপায় কেন এবং মাথায় ও ঘাড়েই বা কেন—এই ব্যবচ্ছেদে পরে যাচ্ছি। 
রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব নাকি তাঁর শিষ্য ও অনুগামীদের প্রায়ই বলতেন, জন্মেছিস যখন তখন একটা দাগ রেখে যা। নিশ্চয়ই তিনি মানুষের ইতিবাচক কাজের সমর্থন করে এ রকম বলতেন। ইতিহাসে যত যুগান্তকারী মানবচরিত্র আমরা খুঁজে পাই, হাতে গোনা কয়েকজন উন্মাদ ছাড়া তাঁদের বেশির ভাগই মানবকল্যাণে ব্রতী ছিলেন। তাঁদের উপলব্ধি, জীবনবোধ, অচলায়তন ভেঙে নতুন নির্মাণের নিরলস পথচলা পরের প্রজন্মের কাছে হয়েছে পাথেয়—তিমিরবিনাশী আলোর মশাল। এর উল্টোটাও আছে। গাঢ় অন্ধকারের কালো চাদরে কেউ কেউ ঢেকে দিতে চেয়েছে জীবনের সকাল–দুপুর–রাত! এরা কখনো একক। সমষ্টি। রাষ্ট্রীয়। ভালো ও মন্দের দ্বন্দ্বযুদ্ধে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শুধু নয়, সবশেষে জয়ী হয়েছে মানুষ ও মনুষ্যত্ব। মানবসভ্যতার চলমান পথের বাঁকে বাঁকে এ রকম অসংখ্য স্মারকস্তম্ভ দাঁড়িয়ে আছে।
‘উৎকোচ’ শব্দটি কখনো কখনো দুর্বোধ্য হলেও ‘ঘুষ’ শব্দটি তুলনামূলকভাবে সহজ। আমাদের দেশে বা সমাজেই শুধু নয়, পৃথিবীজুড়েই। অন্তত সভ্যতার আলো যতটুকু যেখানে পৌঁছেছে, এই শব্দটির ব্যবহার এবং জীবনযাপনে তার প্রয়োগ নিন্দনীয়ই শুধু নয়, অপরাধও বটে। দেশ-কাল-পাত্রভেদে এটি এখনো লোকচক্ষুর অন্তরালের অপকর্ম হিসেবেই বিবেচিত। যারা ঘুষ নেয় অথবা দেয়, পত্রিকার পাতায়, সংবাদমাধ্যমে এবং সমাজে তারা নেতিবাচক চরিত্র হিসেবে উপস্থাপিত হয়। অনেক দিন ধরে আমরা তাই দেখে এসেছি।
এতটুকু পাঠ করার পর এই লেখার পাঠকদের প্রতিক্রিয়াটা আমি লিখতে লিখতেই দেখতে পাচ্ছি। তাদের উপলব্ধিটা নিশ্চয়ই এমন হচ্ছে যে এ সবই কেতাবি কথা। শিশুপাঠ্যে এসব লেখা থাকে। অথবা মাধ্যমিকের ভাবসম্প্রসারণে। কিন্তু নিভৃতে আরেকটি বিপদ ঘটে যেতে থাকে ভাবমানসে। সমাজটা অসম। সবার যাপিত জীবন একই রকমেরও নয়। শ্রেণিবিভাজন আছে। ফলে শ্রমের সঙ্গে যুক্ত জনগোষ্ঠীর ব্যক্তিগত খেদ, বঞ্চনার বোধ, অপ্রাপ্তির হাহাকার আছে। এটা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের। অন্যদিকে অল্প কিছু মানুষের জীবন চাকচিক্যময়, বিলাসিতায় মোড়ানো। এদের অপ্রদর্শিত আয় আছে। কারও কারও দেশের বাইরে বসতবাড়ি আছে, ব্যবসা-বাণিজ্য আছে। এই বৈপরীত্য একই ভূখণ্ডের সমাজে অথবা বিশ্বময়। এই অসাম্য শুধু ভাবিয়েই তোলে না বঞ্চিত মনকে, পরিত্রাণেরও উপায় খুঁজতে ঠেলতে থাকে। পরিত্রাণ, তা যেকোনো উপায়ে হোক, হোক তা নৈতিক অথবা অনৈতিক, তাতে কিছু যায়–আসে না। তখন দেশপ্রেম ফ্যাকাসে হতে থাকে; নিজস্ব অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রশ্নে মরিয়া হয়ে ওঠা এসব কাতর মন স্খলিত হয় শুভবোধ থেকে। জীবন হয়ে ওঠে ভোগের বিষয়। নান্দনিক কিছু নয়।
অসম সমাজ নিয়ে বহমান রাষ্ট্রব্যবস্থায়ও তার উৎকট প্রকাশ থাকে, আছে। এসব স্খলনের। যেহেতু রাজনীতি ও সংস্কৃতি সমাজবোধের বাহ্যিক প্রকাশ, ফলে আমরা এই সিদ্ধান্ত নিই যে কোনো একজন রাজনীতিক কিংবা তাঁর দল, আর সমাজের শিল্পী-সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীদের ক্রিয়া ও উচ্চারণে সমাজের প্রকৃত চেহারাই প্রতিফলিত হয়। আমাদের চারপাশেও তাই হয়ে চলেছে। অনেক দিন আগে স্বনামখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকার তৎকালীন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর লুৎফর রহমান সরকার উদ্যোগ নিয়েছিলেন কয়েকজন ঋণখেলাপির কাছ থেকে ঋণের টাকা ফেরত আনার। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে চিঠি গিয়েছিল তাঁদের কাছে। ফলাফল কী হয়েছিল? ঋণখেলাপিদের শিরোমণি একজন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কক্ষে ঢুকে তাঁকে লাঞ্ছিত করেছিলেন। গণমাধ্যমে ফলাও করে এই সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। ওই ঘটনার পরপরই, সম্ভবত সেই সপ্তাহেই এফবিসিসিআইয়ের এক অনুষ্ঠানে তখনকার অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়ার সঙ্গে সেই ঋণখেলাপির সহাস্য করমর্দনের আলোকচিত্র সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল। সেদিনের জনমানস বুঝে নিয়েছিল, বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি আর্থিকভাবে শক্তিশালী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর যা ইচ্ছা তাই করার অভয়ারণ্য।
অরণ্যে আমরা আদিমকালে ছিলাম। আমাদের জীবনাচরণ ছিল অশিষ্ট, স্থূল। কলাকৌশল বর্জিত। চাঁদ, মঙ্গল গ্রহ তারপর আরও দূরে অনুসন্ধানী নভোযান পাঠানো গেল ঠিকই, তবু মানুষের আদিম প্রবৃত্তির উৎকট প্রকাশ থামল না। সত্য জানার পরও জোর করে মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠা করার জবাবদিহিহীন প্রক্রিয়া নির্বিঘ্নে চলমান। অনেক সাধের পদ্মা সেতু নিয়ে ঘুষ ও কমিশন কেলেঙ্কারির সংবাদ দেশ-বিদেশে হইচই ফেলে দিলেও এমনকি কানাডার যে প্রতিষ্ঠান ঠিকাদারি কাজ পেয়েছিল, তারা তাদের নিজ দেশে অভিযুক্ত হয়ে বিচারিক প্রক্রিয়ায় নুয়ে পড়ার পরও আমাদের তখনকার পদত্যাগী যোগাযোগমন্ত্রী সার্টিফিকেট পেয়ে যান এই মর্মে যে তিনি একজন দেশপ্রেমিক। ‘হায় সেলুকাস’ বলে বিলাপ শেষ হতে না হতেই এই সেদিন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত প্রকাশ্যে বলে ফেললেন ‘স্পিড মানি বৈধ’। ফিসফিস করে নয়, নাটকের বিবেকের চরিত্র যেমন করে মীমাংসা করে দেয় বিবদমান দুই পক্ষের; অমোঘ সেই সত্য উচ্চারিত হলো অবশেষে সেদিন। সুতরাং, যারা যেকোনো রকমের লেনদেন প্রক্রিয়ায় আছেন, ঘোমটা সরিয়ে ফেলুন, ঘুষ দিন এবং নিন নির্ভয়ে। রাষ্ট্র এটাকে বৈধ বলেছে।
অনাচারী মানুষের মাথা উঁচু থাকার কথা নয়। তা যখন হয়, তখন বিপন্ন হয়ে পড়ে শুভবোধ। শৃঙ্খলা থাকে না সমাজে। আমাদেরও নেই। চলতি হাওয়ার পন্থী যাঁরা, তাঁরা সাড়ম্বর চিৎকারে উচ্চারণ করেন, এটাই নিয়ম। আর যাঁরা বিরোধিতা করেন, সত্যভাষণে মুক্তকণ্ঠ হন, অনুগামী হন না স্খলনের—তাঁরা পরিচিতি পান প্রথাবিরোধী হিসেবে। অশুভের বিপরীতে তাঁদের অবস্থান-দৃষ্টিভঙ্গি-প্রত্যয়-জীবনবোধ হয়ে ওঠে সাংঘর্ষিক। সবার জন্য আলোকিত সকাল আনার পথে তাঁরা হাঁটেন, মানুষ মানুষ বলে ডাক দেন হয়তো।
যে আলুচাষি উৎপাদন খরচ না পেয়ে বিক্রি করতে আনা আলুগুলো পথে ঢেলে দিয়ে যান নিরাশায়, স্বজনের খুন হয়ে যাওয়ার ক্ষত মুছতে বিচারালয়ে ফরিয়াদি যাঁরা, মৃত্যুর হুমকি তাঁদের পদে পদে। এখানেও দ্বন্দ্ব বাঙময়। শ্রেণিবিভক্ত সমাজে নিপীড়কের সঙ্গে নিপীড়িতের। সবলের সঙ্গে দুর্বলের। মানুষের দায় অস্বীকার করা ন্যায় নয়। তখন পাশবিকতা শ্বাপদের মতো হাসে। আর তখনই শ্বাপদকে বধ করতে হয়। তা না হলে মানুষ ও মনুষ্যত্ব কিছুই বাঁচে না। মনুষ্যত্বের জন্য লড়াই করা, মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকাটাই বৈধ। আর কিছু না। কিছুই না।
মাহমুদুজ্জামান বাবু: গায়ক ও সংস্কৃতিকর্মী।
[email protected]