মৃত্যুরে লব অমৃত করিয়া

করোনাভাইরাস
প্রতীকী ছবি

করোনা নিষ্ঠুর ও বিধ্বংসী হয়ে উঠেছে বিশ্বময়। কেড়ে নিচ্ছে মানুষ। মানছে না বয়স, বর্ণ, ধর্ম, খ্যাতি, পরিচিতি। খ্যাতিমানদের বিদায়সংবাদে ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছে সংবাদজগৎ আর সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো। বিশ্বজুড়ে হতাশা। কেউ কেউ দিনপঞ্জি থেকেই বছরটি ঝেঁটিয়ে বিদায় দিতে চান। কুসংস্কারমুক্ত বলে পরিচিত পশ্চিমা দেশেও ১৩ সংখ্যাটিকে ‘আনলাকি’ বা অপয়া ভাবা হয়। এলিভেটরে ১৩ সংখ্যা থাকে না। হাইরাইজে ১২ তলার পরের তলাটির নাম ১৩ তলা নয়, ১৪ তলা। ২০২০ নিয়েও সে রকম কুসংস্কারের খবর আসছে। প্রসূতিদের অনেকে গর্ভপাত করাতে ক্লিনিকে ছুটছেন। তাঁরা চাইছেন না তাঁদের সন্তান ২০২০ সালে জন্মাক। বেড়ে ওঠা সন্তানের দিকে তাকিয়ে তাঁদের যেন বলতে না হয় ‘তোর জন্মবছরটি অপয়া। সেই বছরটি আমাদের বহু আপনজন ও প্রিয় মানুষকে কেড়ে নিয়ে গেছে।’ মানবিক বোধের, সম্পর্কের ও আবেগের অনুভূতিগুলোকেও ধাক্কা দিতে ছাড়ছে না কোভিড।

করোনায় মৃত্যুতে ভাইরাসটিই কি শুধু দায়ী? মোটেই নয়। বিবিসির ‘ফিউচার’ বিভাগটি দেখিয়েছে যে করোনাকালে এক বড় অংশই মারা যাচ্ছে অন্যান্য সহযোগী কারণে। যেমন হাসপাতালে জীবাণুর ছড়াছড়ি থাকার কথা। হয়তো দেখা যাবে কোভিড নেগেটিভ, কারও হৃদ্‌রোগের অপারেশন হয়েছে। সবই ঠিক ছিল। কিন্তু এই সময়ে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম থাকার কারণে নতুন করে সামান্য করোনা সংস্পর্শেই তাঁর মৃত্যু ঘটল। এ বছরের মে মাসে প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা ছিল ‘কোলাটেরাল ড্যামেজ’ বা ঘটনাচক্রে অনাকাঙ্ক্ষিত ক্ষতির কথা। এর বড় প্রমাণ চিকিৎসাসেবা–সংশ্লিষ্টদের ব্যাপক সংখ্যায় মৃত্যু। যেসব মানুষ আগে থেকেই ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ক্যানসার, কিডনি ও ফুসফুসের সমস্যায় ভুগছিলেন, তাঁদের মৃত্যুই ঘটছে বেশি। অন্যথায় করোনাভাইরাসটি হয়তো নিয়ন্ত্রণে থাকত। অথবা অতটা বিধ্বংসী হয়ে উঠতে পারত না।

অনেকের মতে, করোনা প্রমাণ করে দিয়েছে ম্যালথাসের ‘প্রকৃতির প্রতিরোধ’ ধারণাটি ঠিক। তাঁর বক্তব্যের জনমিতিক অংশের সারকথা এই যে মানুষের অবিবেচক আচরণে প্রকৃতির ওপর চাপ পড়লে বন্যা, খরা, দুর্ভিক্ষ ও রোগ জনসংখ্যার এক বড় অংশের বিনাশের কারণ হয়ে উঠবে। গ্যারেট হার্ডিন তাঁর বিখ্যাত ট্র্যাজেডি অব দ্য কমন্স–এ বিষয়টি আরও পরিষ্কার করে বলেছেন ভোগ, উন্নয়ন বা অধিকার যেকোনো কিছুই প্রকৃতির ধারণক্ষমতা ছাড়িয়ে গেলে প্রকৃতি প্রত্যাঘাত করবেই এবং বিনাশের কারণ হয়ে উঠবেই। সে যা–ই হোক, করোনা অথবা করোনার বছরটির ভালো কিছুই কি নেই? সেই প্রশ্নের উত্তরও খুঁজতে নেমেছেন সমাজবিজ্ঞানীরা। খুঁজতে নেমে তাঁরা দেখছেন আমরা পেতে চলেছি একটি ভিন্ন রকম আগামী।

করোনা বিপুলসংখ্যক মানুষের মনে নানা প্রশ্ন তৈরি করেছে। একটি প্রশ্ন মানবসমাজ টাকাপয়সা, ধনদৌলতের পেছনে দৌড়ে গলদঘর্ম হতে গিয়েই রোগটি নিয়ে আসেনি তো? ‘দাও ফিরে সে অরণ্য লও এ নগর’ মনোভাব বাড়ছে। ব্যাক টু দ্য বেসিকস বা ‘চলো শিকড়ে ফিরি’ আন্দোলন জোরদার হচ্ছে। অনেকেই শহরের পাট চুকিয়ে গ্রামে ফিরছেন। উদ্দেশ্য প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে চাষবাস করা খাদ্যশস্য-ফলমূল উৎপাদন করবেন, পশুপাখি লালন-পালন করবেন। করোনায় আটকে থেকে, গৃহবন্দী হয়ে শুরুতে অস্থির হয়ে পড়েছিল মানুষ। তাঁদের অনেকেই এখন বলছেন, গৃহবন্দিত্ব তাঁদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে শিখিয়েছে গৃহ সম্পর্ক ও স্বজন সংস্পর্শের নিদারুণ আনন্দের দিকগুলো।

জুলাইয়ের মাঝামাঝি ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম দেখাল যে শুধু ২০২০ সালেই বিশ্বময় ক্ষতিকর কার্বন নিঃসরণ কমবে প্রায় ৭ শতাংশ। এই রকম প্রাকৃতিক নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ বিগত এক শ বছরে কখনোই দেখা যায়নি। করোনা স্পষ্টভাবে শিখিয়ে দিয়ে গেল যে পুঁজিবাদী বিশ্বের লাগামছাড়া খাই খাই উন্নয়নের রাক্ষুসে স্বভাবই সবার জন্য বড় বিপদের কারণ হয়ে উঠছিল।

অসংখ্য লেখাজোখা ও জরিপে দেখা যাচ্ছে যে ঘরের ভেতরে ঘরবাগান এবং ছাদে ছাদবাগান গড়ে উঠছে। মানুষের পাঠের অভ্যাস বেড়েছে। অনলাইনে ডিজিটাল বই বিক্রিও বেড়েছে। ঘরে স্বাস্থ্যসম্মত রান্নাবান্নার নিত্যনতুন রেসিপি প্রকাশিত হচ্ছে অনলাইনে। হোটেল-রেস্তোরাঁয় অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণের বদভ্যাস থেকে সরে এসেছে বিপুলসংখ্যক মানুষ। ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকি কমছে। বিভিন্ন কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের চিকিৎসাসেবার পেছনে জাতীয় বাজেটের একটি বড় অংশ খরচ হতো। মনে করা হচ্ছে সেসব দেশে স্বাস্থ্য খাতে খরচ কমলে সেই অর্থ অন্য গুরুত্বপূর্ণ খাতে (যেমন শিক্ষা) ব্যবহার করা যাবে। তদুপরি, করোনায় মৃত ব্যক্তিদের বড় অংশই বয়স্কজন হওয়ায় ইউরোপের দেশগুলোর বয়স্ক ভাতার একটি বড় অংশ বেঁচে যাবে। বেঁচে যাওয়া অর্থ অর্থনীতির ক্ষতিগ্রস্ত খাতগুলোর অর্থসংকট নিরসনে ব্যবহার করা যাবে।

এখানেই শেষ নয়। সচ্ছল মধ্যবিত্তের ঘরে ঘরে ব্যায়ামাগার গড়ে উঠছে। ২০২০ সালে গৃহে ব্যবহারযোগ্য ব্যায়াম ও স্বাস্থ্য সরঞ্জামের বিক্রি বেড়েছে উল্লেখযোগ্য রকম। ঘরবাড়ির পরিচর্যা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, ভাঙাচোরা সংস্কার ও পুনর্নির্মাণ বেড়েছে। ফলে মশা–মাছি, কীটপতঙ্গ ও ছত্রাকজনিত রোগবালাই কমবে। সবকিছু ছাড়িয়ে যে বিষয়টি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, তার নাম অনলাইন পড়াশোনা ও যোগাযোগ। এমনকি ঘরে থেকেই যে কার্যকর অফিস–আদালত গড়া যায়, করোনা না এলে জানাই যেত না। জুম এখন একটি পপ-কালচারের নাম। তবু কথা থেকে যায়। শহুরে মধ্যবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্তদের জীবনে করোনা এসব সুবিধা নিয়ে এলেও দরিদ্রদের অবস্থা তথৈবচই। হালের অর্থনীতিতে যেমন গরিবই ভুক্তভোগী, রোগবালাইয়েরও প্রধান শিকার তারাই।

করোনার সময়টি দুনিয়া বদলে দেওয়ার অভিজ্ঞান হয়ে উঠেছে বলেই কিছু সত্য মেনে নেওয়া প্রয়োজন। কবিগুরুর ভাষায়, ‘সত্যরে লও সহজে’। করোনার ক্ষতিকর দিকের পাশাপাশি শিক্ষণীয় দিকগুলোকেও স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন, আমলে নেওয়া প্রয়োজন। জীবন থেমে থাকে না। করোনারও সাধ্য নেই মানবজন্ম ঠেকিয়ে রাখার। নতুন মানুষের জন্ম হবে। আমাদের ভাবনার কেন্দ্রেও তাদের ভবিষ্যৎ চিন্তাকেই জায়গা দিতে হবে। করোনার শিক্ষাকে মাথায় রেখে ভবিষ্যৎ মানব পরিকল্পনার মূলমন্ত্র কী রকম হওয়া প্রয়োজন? এ উত্তর দিতে চাই সুকান্তর ভাষায়, ‘বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি; নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’ কবিগুরুর ভাষায় ‘মৃত্যুরে লব অমৃত করিয়া...’।

ড. হেলাল মহিউদ্দীন: অধ্যাপক, রাজনীতিবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ; নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি