মেডিকেল শিক্ষকেরা কেমন আছেন?

বাংলাদেশে সরকারি ২১টি মেডিকেল কলেজসহ মোট মেডিকেল কলেজের সংখ্যা ৬৭ (পরিসংখ্যান ব্যুরো, ২০১২) ও স্নাতকোত্তর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১৪। এ ছাড়া পাঁচটি মেডিকেল কলেজে স্নাতকোত্তর কোর্স চালু করা হয়েছে। মেডিকেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এ পরিসংখ্যান আপাতদৃষ্টিতে উৎসাহব্যঞ্জক বৈকি। প্রায় ৯০টির মতো মেডিকেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে এক লাখ বর্গকিলোমিটারের দারিদ্র্যপীড়িত এ ছোট্ট দেশটিতে। এসব মেডিকেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনা ও চিকিৎসাসেবা প্রদানের মূল কাজটি যাঁরা করেন, তাঁদের বলা হয় চিকিৎসক শিক্ষক।
আমরা চিকিৎসাশিক্ষার দিকে যদি লক্ষ করি, তাহলে দেখব, দেশে মেডিকেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বৃদ্ধির সমান্তরালে শিক্ষার মান বাড়েনি। এই মান না বাড়ার পেছনে অনেক উপাদান বিদ্যমান।এই আলোচনায় সেদিকে যাব না। আলোচনা মূলত শিক্ষকদের বর্তমান অবস্থানেই সীমাবদ্ধ রাখব।
আমাদের মেডিকেল শিক্ষকেরা কেমন আছেন? এ প্রশ্নের জবাবে এককথায় বলতে হয়, ভালো নেই। ভালো বলতে এখানে একজন শিক্ষকের আদর্শিক অবস্থানে থেকে সুষ্ঠু পরিবেশে শিক্ষাদান প্রক্রিয়ার কথা বোঝাতে চাইছি। একজন শিক্ষকের মূল পাওয়া তো এখানেই! ছাত্রদের প্রতি মমত্ববোধ, তাদের পাঠদান ও পাঠ গ্রহণে উদ্বুদ্ধকরণ, আদর্শিক চেতনায় গড়ে ওঠায় সহায়তা প্রদান। মেডিকেল শিক্ষকদের প্রায় সবাই এমন একটি অবস্থানের কথা ভাবেন এবং এ ভাবনার সঙ্গে বাস্তবের ফারাক দেখে আহত বোধ করেন এবং অবচেতন মনে তাঁর এই অবস্থানকে নিয়তি হিসেবে ধরে নিয়ে আপন অসহায়ত্বে নিজের ভেতর সান্ত্বনা খোঁজেন।

২.
আমাদের মেডিকেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মপরিবেশের অভাব সর্বত্রই বিদ্যমান। কোনো হায়ারার্কি নেই। বিশেষ করে, শিক্ষকদের প্রতি প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালে কর্মরত কর্মচারীদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। চিকিৎসক শিক্ষকদের প্রতি তাঁদের আচরণ সুষ্ঠু কর্মপরিবেশের অনুকূল নয়। এ অবস্থা দেশের শীর্ষতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সর্বত্রই বিরাজমান। অবাক করার মতো হলেও সত্য যে দেশের শীর্ষতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে (দেশের একমাত্র মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) চিকিৎসক শিক্ষকেরা জোট শাসনামলে অনিশ্চিত একধরনের অবরুদ্ধ পরিবেশে কাজ করেছেন। তাঁদের নেমপ্লেটে সরকারদলীয় কর্মচারীরা অমোছনীয় কালিতে প্রতিষ্ঠানের নাম আচ্ছাদিত করেছিলেন। কর্তৃপক্ষের কাছে বলেও প্রতিকারহীন আচরণ পেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া উপায় ছিল না। শৃঙ্খলাহীন দায়বোধশূন্য এমন অদ্ভুত পরিবেশ আর কোথাও আছে কি না জানা নেই। মেডিকেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সুচিকিৎসার পরিবেশ শিক্ষাদান-প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত। এ ক্ষেত্রে সর্বস্তরের কর্মচারী ও শিক্ষকদের আন্তরিক সহযোগিতার পরিবেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। মেডিকেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ সম্পর্কের ঘাটতি নিয়েই চিকিৎসক শিক্ষকদের দায়িত্ব পালন করতে হয়।

৩.
মেডিকেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মূলত ছাত্রদের জন্য প্রতিষ্ঠিত। এসব প্রতিষ্ঠানে ছাত্ররা হাতে-কলমে শেখেন, নতুন নতুন অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়ে তাঁরা দেশের চিকিৎসাবিজ্ঞানী হিসেবে ছড়িয়ে পড়বেন বিভিন্ন স্থানে—দেশ, দেশান্তরে। কিন্তু মেডিকেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষকদের প্রতি ছাত্রদের শ্রদ্ধাবোধের ঘাটতি লক্ষণীয়। ছাত্ররাজনীতির বিকৃত রূপ এ ক্ষেত্রে বহুলাংশে দায়ী। ছাত্ররাজনীতিতে পেশিশক্তি, কালোটাকার প্রভাব অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো মেডিকেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও বিদ্যমান। এখানেও ছাত্রনেতারা ঠিকাদার, দরপত্র নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত। তাঁদের অবস্থান

মেডিকেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসনের সঙ্গে সখ্যসুলভ হওয়ায় শিক্ষকেরা তাঁদের ‘করুণার’ পাত্র। অপ্রিয় হলেও সত্য যে শিক্ষকেরা তাঁদের অবস্থান ও প্রমোশনের জন্য যেন ছাত্রনেতাদের মর্জির ওপর নির্ভরশীল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোন শিক্ষক থাকবেন, কোন শিক্ষক থাকবেন না; কোন শিক্ষক পক্ষের, কোন শিক্ষক বৈরী ইত্যাদি নেতাদের দ্বারা নির্ধারিত।

৪.
শিক্ষকেরা যাঁকে অভিভাবক হিসেবে ভাবেন, সেই অভিভাবক অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানের প্রধান এখন আর শিক্ষকদের অভিভাবকের পর্যায়ে নেই। যদিও শিক্ষকদের ভেতর থেকেই প্রতিষ্ঠানপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়, কিন্তু এই নিয়োগপদ্ধতিতে, একাডেমিক দিকসহ মেধা, দক্ষতা, জ্যেষ্ঠতার চেয়ে দলীয় আনুগত্যসহ অন্যান্য বিষয় অগ্রাধিকার পায়। ফলে প্রতিষ্ঠানে একাডেমিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। প্রতিষ্ঠানপ্রধান পদটি দলীয় প্রশাসকে রূপান্তরিত হয়ে যায় এবং এই রূপান্তরিত প্রশাসকের কাছে শিক্ষকের গুরুত্বের চেয়ে অন্যদের গুরুত্ব প্রাধান্য পায়। মেডিকেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় একাডেমিক মানোন্নয়ন তাই অনুপস্থিত।
মেডিকেল শিক্ষকদের পেশার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে কোনো সুপরিকল্পিত উদ্যোগ নেই। মেডিকেল শিক্ষার মতো কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ হলেও তা কার্যত শূন্যের কোঠায়। বিশেষত, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক প্রদত্ত সহায়তা শিক্ষকদের পেশাগত মান বৃদ্ধির অনুকূলে কার্যকর ভূমিকা পালন করে না। নিয়োগ থেকে শুরু করে বদলি, পদোন্নতি প্রতিটি পর্যায় যেমন অনিশ্চয়তায় ভরপুর, ঠিক তেমনি প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের বিষয়টি উপেক্ষিত। প্রতিষ্ঠানপ্রধান শিক্ষার সার্বিক পরিবেশের মানোন্নয়নের দিকে দৃষ্টিপাত করেন না। শিক্ষকদের সঙ্গে তাঁর রয়েছে একধরনের দূরত্ব। তিনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সার্বিক মানোন্নয়নের লক্ষ্যে শিক্ষকদের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনায় মিলিত হওয়ার চেয়ে ওপর থেকে আরোপিত (যা শিক্ষার উন্নয়নের লক্ষ্যে নয়), প্রশাসনিক সিদ্ধান্তবলি বাস্তবায়নেই তৎপর বেশি।

৫.
আমরা এক নষ্ট সময়ের ভেতর দিয়ে পথ চলছি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পবিত্র অঙ্গন ‘রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি’র শিকার। শিক্ষার জগৎটা থাকা উচিত রাজনীতির ঊর্ধ্বে। শিক্ষক তাঁর পেশার মহত্ত্বকে রাখবেন সর্বোচ্চ পর্যায়ে রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকবে আপন বিশ্বাসের ভেতর। তাকে কখনোই পেশার ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া উচিত নয়। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য যে বেশ কিছুকাল ধরে আমাদের শিক্ষা খাত মেধাকে গুরুত্বহীন করে রাজনৈতিক বিশ্বাসটাকে ওপরে ঠাঁই দেওয়া হয়েছে। আমরা যাঁরা একাত্তরে যুদ্ধ করেছিলাম, তাঁদের অধিকাংশই এ রকমটি চাইনি। আমরা একটা নতুন দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলাম। নিজের বিশ্বাসের জগৎটায় ধস নেমেছে। এমন এক নিদানকালে আমরা পথ চলছি।
মেডিকেল শিক্ষার সুষ্ঠু বিকাশের লক্ষ্যে এ অবস্থার নিরসন হওয়া প্রয়োজন।
অধ্যাপক ডা. মো. শফিকুল ইসলাম: বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।