মেলায় গিয়ে কী দেখলাম

বিরামপুরের মণ্ডপের মেলা এবার জমেনি
বিরামপুরের মণ্ডপের মেলা এবার জমেনি

গত সপ্তাহে একটা মেলা দেখতে ঢাকা থেকে গিয়েছিলাম দিনাজপুর জেলার বিরামপুরে। ব্যক্তিগত দেখা নয়, প্রথম আলোর পাঠকদের হয়ে দেখা। আমার সঙ্গে গিয়েছিলেন প্রথম আলোর আলোকচিত্রী সাহাদাত পারভেজ। কথা ছিল, আমি ওই মেলার বিবরণ লিখব, সেই লেখার সঙ্গে ছাপা হবে সাহাদাতের তোলা রঙিন ছবি।
এবার পয়লা বৈশাখের অন্তত দুই সপ্তাহ আগে থেকে আমরা এমন একটা মেলার খোঁজ শুরু করেছিলাম, যেটা সবচেয়ে বর্ণাঢ্য, বড় ও প্রাচীন। বিরামপুর সদর থেকে মাইল খানেক দূরে মির্জাপুর গ্রামের ওই মেলাটি আমরা বেছে নিয়েছিলাম এ জন্য যে সেটা তিন শ বছরেরও বেশি পুরোনো, প্রায় কুড়ি-পঁচিশ হাজার মানুষের এক বিপুল-বর্ণাঢ্য আনন্দ-সমাবেশ। রংপুর, গোবিন্দগঞ্জ, গাইবান্ধা, জয়পুরহাট ও নওগাঁ জেলার নানা প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মানুষ সেখানে আসে। এমনকি সীমান্ত পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গ থেকেও অনেক মানুষ এসে যোগ দেয়। মির্জাপুর জামলেশ্বর শিবমন্দির ঘিরে চৈত্রসংক্রান্তির দিন সকাল থেকে শুরু হয় মেলাটি, লোকজনের মুখে ওটা ‘মণ্ডপের মেলা’।
বিরামপুরে পৌঁছেই লোকজনের মুখে শুনতে পেলাম, আগেকার দিনে চৈত্রের শেষে যখন আকাশে শিমুলতুলা উড়তে শুরু করত, তখন তাদের মনে পড়ত, এখন মণ্ডপের মেলা বসবে। মেলার সঙ্গে শিমুলতুলার এই যোগ বহু প্রাচীন: উত্তরবঙ্গের বিরাট এক অংশের মানুষ নাকি লেপ-তোশক তৈরির জন্য শিমুলতুলা সংগ্রহ করতে আসত এই মেলায়। শিমুলতুলার সংবৎসরের পাইকারি কেনাবেচারও অন্যতম প্রধান কেন্দ্র ছিল এই মেলা। আরও বিক্রি হতো উত্তরবঙ্গের বিখ্যাত মিষ্টিআলু, হলুদ, মরিচ, রসুন, মৌরি। মাটির তৈরি তৈজসপত্র: হাঁড়ি-পাতিল, ঘড়া, মটকা, সানকি, কলস ইত্যাদি। লোহার তৈরি গৃহস্থালি সামগ্রী: ছুরি, কাঁচি, দা, কোদাল, কাস্তে, লাঙলের ফলা ইত্যাদি। কাঠের আসবাব যুক্ত হয়েছে অনেক পরে।
এসব কথা মানুষের মুখে মুখে শোনা। চৈত্রসংক্রান্তির দিন সকালে মির্জাপুরের ওই মণ্ডপের মেলায় সশরীরে গিয়ে আমি এসবের সামান্যই দেখতে পেলাম। মাত্র হাজার দুয়েক মানুষ জড়ো হয়েছে মেলার প্রাঙ্গণে, সামান্য কিছু দোকানপাট বসেছে, কিছু বসার আয়োজন চলছে। দোকানিরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছেন, ‘মেলা বলে হোবে না রে!’ জিজ্ঞাসা করলাম, মেলা হবে না কেন? একজন বললেন, ‘পুলিশ দাবড়াদাবড়ি করিচ্ছে।’ পাশ থেকে আরেকজন বললেন, ‘বিকাল পাঁচটার মদ্যে বলে ব্যাক গুটে লিয়ে চলে যাওয়া লাগবে।’
লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, পুলিশ কিছু দোকানিকে তাড়িয়ে দিয়েছে, আবার এ–ও বলেছে, বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত বেচাকেনা করা যাবে, তবে কোনো খুঁটি পোঁতা চলবে না, শামিয়ানা টাঙানো নিষেধ। শিবেশ চন্দ্র কুণ্ডু নামে এক বর্ষীয়ান মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন, ‘তিন শ বছরের পুরোনো এই মেলা, নিরাপত্তার অজুহাতে এবার সেই মেলা বসতে দেওয়া হচ্ছে না, কী শুরু হলো এসব?’
কী শুরু হলো? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানতে পেলাম, গত বছরের ডিসেম্বর মাসে দিনাজপুরের কাহারোলে কান্তজিউর মন্দিরে রাসমেলা উপলক্ষে আয়োজিত যাত্রাপালায় সন্ত্রাসী বোমা হামলার ঘটনায় যে ভীতি সৃষ্টি হয়েছে, পয়লা বৈশাখে তা যেন বেড়ে গিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে গোটা দিনাজপুর জেলায়। কিন্তু ভীতিটা সাধারণ মানুষের নয়, সরকারি প্রশাসনের, বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের। আবারও অঘটন ঘটতে পারে—এ রকম আশঙ্কা থেকে সরকারি প্রশাসন এবার মেলা বসতে দেবে না—এই ধারণা সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। ঢাকার পয়লা বৈশাখের সব অনুষ্ঠান বিকেল পাঁচটার মধ্যে শেষ করতে হবে—এ রকম সরকারি ঘোষণা টেলিভিশনের মাধ্যমে গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়ার কারণে সাধারণ মানুষ বলাবলি করছিল, ‘দেশের অবস্থা বলে ভালো লয়।’
নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি ঢাকার জন্য প্রযোজ্য হলেও সরকারি সতর্কতায় এই ধারণা ছড়িয়ে পড়ে যে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো নয়, কখন কোথায় কী ঘটে যায়, সরকার তা নিয়ে শঙ্কিত।
পূজা উদ্যাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক রতন কুমার মহন্তকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পেলাম, স্থানীয় প্রশাসন চৈত্রসংক্রান্তির দিনে পূজার অনুমতি দিয়েছে, কিন্তু মেলার অনুমতি দেয়নি। মেলা উদ্যাপন কমিটির আহ্বায়ক মো. ইউসুফ আলী বললেন, তাঁরা এবার মেলার অনুমতি চেয়ে আবেদনপত্র জমাই দেননি। কেন? আমার এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বললেন, ‘আবেদন করার আগে আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করি। সবাই বলল, এবার প্রশাসন অনুমতি দিবে না, তাই আবেদন করা হয়নি।’
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনারা কেন আগেভাগেই ভেবে নিলেন প্রশাসন অনুমতি দেবে না?’ উত্তরে তিনি একের পর এক দিনাজপুর জেলার বিভিন্ন মেলার নাম বলতে শুরু করলেন, ‘ঘোড়াঘাটের চৌধুরী গোপালপুর মেলা, ফুলবাড়ী কলেজ মেলা, বিরামপুরের কাটলা মেলা, হিলির মংলা মেলা, আমতলির মেলা, গোয়ালহাট মেলা...দিনাজপুর জেলার মধ্যে কোনো মেলাই এবার হয়নি। আমাদের এখানেও যে মেলা হোবে না, তা তো বুঝাই যায়!’
এ বছর চৈত্রসংক্রান্তি ও পয়লা বৈশাখের দিনে পুরো দিনাজপুর জেলার কোথাও কোনো মেলা হয়নি। লোকজনকে বলতে শুনলাম, ‘যেটে সেটে বলে খালি বোমা ফুটিচ্ছে!’ তাঁদের কণ্ঠে ভীতি নয়, পরিহাস। সন্ধ্যায় বিরামপুর রেলস্টেশনে গরম হুড়ুমভাজা বিক্রি করতে করতে গোলজার নামের এক মেলাপাগল ফেরিওয়ালা হতাশ কণ্ঠে আমাকে বললেন, কেউ কোনোটে এডা বোম ফুটালেই সরকার যুদি মেলা নিষেধ করে দেয়, তালে একদিন কোনো মেলাই আর হোবে না। মেলা উটে যাবে ভাই, মেলা থাকপে না!’
দিনাজপুর জেলার এই হতাশা অবশ্য সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার কারণ এখনো ঘটেনি। পাশের জেলা জয়পুরহাটে গিয়েই দেখতে পেলাম, মহাসমারোহে চলছে শত বছরের ঐতিহ্যবাহী তেঘরের মেলা। ধর্মীয় উগ্রপন্থা ও সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের দিক থেকে জয়পুরহাট জেলা দিনাজপুর জেলার তুলনায় নমনীয়—এমন কোনো তথ্য নেই। বরং জয়পুরহাটে শহরের অদূরেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদীদের রীতিমতো বন্দুকযুদ্ধের দৃষ্টান্ত আছে। সেই জয়পুরহাটে চৈত্রসংক্রান্তিতে তেঘরের মেলা বসতে
পেরেছে, কিন্তু দিনাজপুরের বিরামপুরে তিন শ বছরের ঐতিহ্যবাহী মণ্ডপের মেলা বসতে পারেনি—এই পার্থক্যের আপাতত কারণ মাস চারেক আগে কান্তজিউর মন্দিরে বোমা হামলার ঘটনা। পরের ঘটনার স্মৃতি এখনো জ্বলজ্বলে, আগের ঘটনার স্মৃতি নিষ্প্রভ।
আমাদের সরকার জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে মানুষের সমাবেশ ও চলাচল সীমাবদ্ধ করে ফেলে, কখনো কখনো, কোথাও কোথাও তা বন্ধও করে দেয়। যেসব অশুভ শক্তি ভয় দেখিয়ে সমাজের স্বাভাবিক জীবনযাপন বিঘ্নিত করতে চায়, তাদের জন্য সরকারের, বিশেষত শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষের এই মানসিকতা বেশ সুবিধাজনক। উগ্রপন্থীরা এক কান্তজিউর মন্দিরে কয়েকটি বোমা ফাটিয়েই যদি পুরো দিনাজপুর জেলার সব ঐতিহ্যবাহী মেলা হওয়ার পথ বন্ধ করে দিতে পারে, তাহলে আগামী বছর সারা দেশেই যে এমন চেষ্টা তারা করবে না, তা কে বলতে পারে?
ধর্মীয় উগ্রপন্থার শক্তি বাংলাদেশের হাজার বছরের সামাজিক-সাংস্কৃতিক শক্তিকে ভীতসন্ত্রস্ত করতে পারেনি বলে মণ্ডপের মেলায় অনেক মানুষ এসেছিল, তাদের মধ্যে কোনো ভয়ভীতির আভাস আমি পাইনি। তাদের তাড়িয়ে দিয়েছে সরকারের পুলিশ, কখন কী ঘটে যায় এই আশঙ্কায়। অর্থাৎ উগ্রপন্থীদের ছড়ানো ভয় সরকারি প্রশাসনকে বেশ স্পর্শ করেছে।
এবার সরকারি প্রশাসন প্রতিটি জেলায় বর্ষবরণের অনুষ্ঠান করে বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি সরকারের অঙ্গীকার স্পষ্ট করেছে—এটা বেশ ভালো কথা। কিন্তু বিকেল পাঁচটার মধ্যে সব অনুষ্ঠান শেষ করাসহ যেসব বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল, সেগুলো খারাপ দৃষ্টান্ত। ভবিষ্যতে এ ধরনের পদক্ষেপ না নিলেই ভালো হবে।
২০০১ সালের এপ্রিলে রমনার বটমূলে বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে বোমা ফাটিয়ে যারা বাংলাদেশে পয়লা বৈশাখ উদ্যাপনের ঐতিহ্য চিরতরে বন্ধ করে দিতে চেয়েছিল, তারা জয়ী হতে পারেনি এ কারণে যে পরের পয়লা বৈশাখে সেখানে আরও বেশি সমারোহে, আরও বেশিসংখ্যক মানুষের অংশগ্রহণে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান হয়েছিল। সারা দেশের জন্যই এ দৃষ্টান্ত অনুসরণীয়।
মশিউল আলম: সাংবাদিক
[email protected]