মোবারক খালাস, 'আসনে গিয়ে বসুন'

হোসনি মোবারক
হোসনি মোবারক

সাবেক মিসরীয় প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক, তাঁর ছেলে ও সহযোগীরা আর্থিক দুর্নীতি ও ২৫ জানুয়ারির বিপ্লবে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের হত্যার অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পর অনেকেই এখন তাঁদের রাজনৈতিক বিচারের দাবি তুলেছেন। বিশিষ্ট মিসরীয় লেখক মোহামেদ হাসানেইন হেইকালও এ দলে যোগ দিয়েছেন।
সম্প্রতি টিভি চ্যানেল সিবিসিকে দেওয়া এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘আমরা যদি মোবারকের প্রণীত আইনেই তাঁর বিচার করি, তাহলে বুঝতে হবে কিছুই পরিবর্তিত হয়নি। এটাই ভুল হয়েছে। শুরুতেই উচিত ছিল তাঁর রাজনৈতিক বিচারের দাবি তোলা।’
উপর্যুক্ত মামলার বিচারের সময় বিচারক মাহমুদ কামাল আল রশিদি যে উক্তি করেছেন, তা এখন রীতিমতো বিখ্যাত: বেকসুর খালাস...আসনে গিয়ে বসুন। রায় ঘোষণার পর মোবারকের সমর্থকেরা নানা স্লোগানে আদালত প্রাঙ্গণ মুখরিত করে তোলেন। তাঁরা বলেন, আল্লাহ মহান, ন্যায়বিচার পুনরুদ্ধার হয়েছে, মুসলিম ব্রাদারহুডের বিচার হোক প্রভৃতি।
নারী সমর্থকেরা আবেগে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন। অন্যরা তাঁর ছবি উঁচিয়ে তাতে চুমু খান। মোবারকের সমর্থকদের উচ্ছ্বাস এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে তাঁরা মোবারকের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের ভবিষ্যদ্বাণীও করে ফেলেছেন। মোবারকের ছেলেদের, বিশেষ করে গামালের, প্রত্যাবর্তনের কথাও তাঁরা বলেছেন। তাঁরা প্রত্যাশা করছেন, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডলি তাঁর ছয় সহযোগীসহ আবার আগের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন। অথচ তাঁদের বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতি ও ২৫ জানুয়ারি বিপ্লবের দিন নিরীহ প্রতিবাদকারীদের হত্যার অভিযোগ আছে।
বিপ্লবের শহীদদের পরিবারের কাছে এ রায় অবশ্য অপ্রত্যাশিত ছিল না। কারণ, বিচারের সময় বিচারক রুলিংয়ের বিরুদ্ধে আদালত কক্ষে কেউ কিছু বললে তাঁকে এক বছর কারাদণ্ডের হুমকি দিয়েছিলেন।
এ রায় নিয়ে দুনিয়ার নানা স্থানেই আলোচনা হচ্ছে। মার্কিন গণমাধ্যমের অভিমত, এ রায়ের সঙ্গে ২৫ জানুয়ারির বিপ্লবের পরিণতির মিল রয়েছে। এ দুটোর ভাগ্য এক সূত্রে গাঁথা। দ্য নিউইয়র্ক টাইমস বলেছে, মোবারককে খালাস দেওয়া আসলে ২৫ জানুয়ারির বিপ্লবকেই অস্বীকার করা। টাইম ম্যাগাজিন বলেছে, এটা আরব বসন্ত ও ২৫ জানুয়ারির বিপ্লবের প্রতি তীব্র আঘাতের শামিল।
দ্য ইকোনমিস্ট-এর একটি নিবন্ধের শিরোনাম ছিল এ রকম: ‘মিসরীয়দের মতো বিচার করুন’। এটা খুবই পরিষ্কার যে এই মন্তব্য মিসরীয় বিচারব্যবস্থার প্রতি তামাশা। এই সূত্র ধরে ব্রিটিশ গণমাধ্যম বলেছে, এই রায়ে একটা ব্যাপার নিশ্চিত যে ২৫ জানুয়ারির বিপ্লব শেষ হয়ে গেছে। আর পুরোনো জামানা ও গভীর রাষ্ট্র আবার ফিরে এসেছে।
হেইকাল এ রায়ের আইনি বৈধতা নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, বিচারক এই মামলা পরিচালনা করেছেন মোবারকের প্রণীত আইন অনুসারেই। বিচারক সঠিকভাবে বিচার করেননি। সঠিকভাবে করতে হলে তাঁর ব্যক্তিগত অভিমত প্রয়োগ করতে হতো।
মিসরীয় দৈনিক আল শুরক-এ মিসরীয় বিপ্লবী চরিত্র জিয়াদ বাহা এলদিন বলেছেন, মোবারককে খালাস দেওয়ায় জনগণের বিশাল এক অংশের মধ্যে একধরনের নেতিবাচক বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়েছে, বিশেষত তরুণদের মধ্যে। তার কারণগুলো নিম্নরূপ:
প্রথমত, ২৫ জানুয়ারির বিপ্লব ও তাতে অংশগ্রহণকারীদের প্রতি বৈরীভাবাপন্ন মানুষ এই বিচার করেছে। বিচারের সঙ্গে সাবেক প্রেসিডেন্ট, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও তাঁর সহযোগীদের সম্পৃক্ততা থাকলে বিচারটা আসলে বিপ্লব ও বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে যায়। মিসর যে ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসের আগের অবস্থায় ফেরত যাচ্ছে, এটা তারই লক্ষণ।
তরুণেরা শুধু বিচারের কারণেই ক্ষুব্ধ নন, বিপ্লব নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ও তামাশাই তাঁদের ত্রোধের প্রধান কারণ।
দ্বিতীয়ত, সম্প্রতি শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ ও মিছিল নিষিদ্ধে জারি হওয়া কিছু আইন ও সিদ্ধান্ত হয়েছে। কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সাহায্য গ্রহণের ওপর অপরাধের সিল লাগানো, এনজিওর কাজে ঝামেলা সৃষ্টি, সামরিক আদালতের ক্ষমতা বৃদ্ধি, বিশ্ববিদ্যালয়ে উত্তেজনা হ্রাসে ব্যর্থতা, নিরাপত্তা কর্মসূচি ছাড়া অন্য কোনো মাধ্যমে সমাজের বিভক্তি, টালমাটাল অবস্থা নিরসন প্রভৃতি।
এসব কারণে তরুণদের শান্তিপূর্ণ ও বৈধ উপায়ে প্রতিবাদ জানানোরও উপায় আর নেই।
তৃতীয়ত, মোবারক ও তাঁর সহযোগীদের বিপ্লবীদের খুনের অভিযোগ থেকে খালাস দেওয়ায় তা এক গুরুতর প্রশ্নের জবাব দিতে ব্যর্থ হয়েছে: এই খুন-জখম আসলে কারা ঘটিয়েছে।
মিসরের বর্তমান সরকারকে ২৫ জানুয়ারির বিপ্লব সম্পর্কে অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে। কারণ, এই বিপ্লবই তাদের ক্ষমতায় আরোহণের পথ করে দিয়েছে, যে সংবিধানের ওপর ভিত্তি করে তারা কাজ চালাচ্ছে, সেটার ভিত্তিও এই বিপ্লব। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পথও করে দিয়েছে এই বিপ্লব।
সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা কি ২৫ জানুয়ারির বিপ্লবকে স্বীকৃতি দেবে এবং সেটা জনগণের ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ধরে নেবে, নাকি এটাকে কোনো বিদেশি ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যা দেবে। সরকার যদি শেষোক্ত অবস্থান নেয়, তাহলে তাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা পেছনে ফিরে যাবে কি না।
সরকারকে স্বীকার করতে হবে, পরিবর্তনমূলক বিচারই একমাত্র পথ, যার মাধ্যমে জানুয়ারি ও জুন বিপ্লবের আগে-পরে যেসব অপরাধ হয়েছে, তার সত্যতা প্রকাশিত হতে পারে।
বাহা এল-দিন তাঁর নিবন্ধের শেষে বলেছেন, এসব পদক্ষেপ না নিলেও সরকার হয়তো মোবারকের বিচার নিয়ে সৃষ্ট সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবে। সংসদ নির্বাচন করতে পারে বা অর্থনৈতিক সম্মেলন আয়োজন করতে পারে।
এই রায়ের পর প্রেসিডেন্টের কার্যালয় থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি বলেছেন, এই রায়ের দুটি ভিত রয়েছে। প্রথমত, তা বিচারিক রায়ের প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত, যার ওপর তিনি মন্তব্য করতে পারেন না। আল-সিসি মিসরের বিচারকদের সততা, অখণ্ডতা ও পেশাদারির ওপর পূর্ণাঙ্গ আস্থা রাখেন বলে জানিয়েছেন।
দ্বিতীয় ভিতটি আদালত তাঁর রায়ের ব্যাখ্যায় যা বলেছেন, তার সঙ্গে সম্পর্কিত। কারণ, যাঁরা বিপ্লবের আগে-পরে খুন বা জখম হয়েছেন বা দেশের ভালোর জন্য জীবন দান করেছেন, তাঁদের পরিবারবর্গকে ক্ষতিপূরণ ও দেখভালের জন্য প্রধনমন্ত্রীকে দায়িত্ব দিয়েছেন।
আল-সিসি আইন সংস্কার কমিটিকে দায়িত্ব দিয়েছেন, ফৌজদারি কার্যবিধির সংশোধনী পাঠ করে এ বিষয়ে তাঁকে প্রতিবেদন পেশ করতে হবে। আদালত বলেছেন, এটা অবশ্যই করতে হবে।
২৫ জানুয়ারি ও ৩০ জুনের বিপ্লবের পর এক নতুন মিসরের জন্ম হয়েছে। ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা, সমতা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে মিসর একটি নতুন রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠবে। মিসর সামনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে, সে আর পেছন ফিরে তাকাতে পারে না।
কিছু সংবাদ সংস্থা আল-সিসি ও তরুণ সাংবাদিকদের মধ্যে অনুষ্ঠিত একটি বৈঠকের খবর ফাঁস করে দিয়েছে। তিনি নাকি বলেছেন, মিসর ৪০ বছর পিছিয়ে আছে। আর ২৫ জানুয়ারিও আসলে ১৫ বছর পরে হয়েছে। যাঁরা মোবারকের আমলে সন্তুষ্ট ছিলেন, তাঁরা ভুল ছিলেন। পেছনে ফেরত যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এ দুটি বিপ্লবকে অবমাননা করার শাস্তির জন্য আইন করা হবে।
প্রেসিডেন্টের বিবৃতি বা উপর্যুক্ত উক্তি জনমনে শঙ্কা দূর করতে যথেষ্ট নয়। প্রতিবিপ্লবের সফলতা নিয়ে বিরাজমান শঙ্কাও এতে দূর হবে না। মোহামেদ হাসানেইন হেইকাল সম্প্রতি টেলিভিশনে বলেছেন, ‘আল-সিসির বিবৃতি আমি পড়েছি। কেউই বলতে পারে না, মোবরাককে ফৌজদারি বিচার থেকে সরিয়ে রাজনৈতিক বিচারের মুখোমুখি করা হোক। এটা প্রধান বিচারপতি ও রাষ্ট্রের এখতিয়ারে পড়ে। বিচার হয়তো স্বচ্ছ হয়েছে, কিন্তু এখানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যাপার রয়েছে। এ নিয়ে কথা বলার এখতিয়ার আমার নেই।’
হেইকাল আরও বলেছেন, মোবারকের লোকজন অনেকেই ফিরতে শুরু করেছেন। সিসিকে মোবারকের আমলের বিরুদ্ধে বিপ্লব ঘটাতে হবে। ২৫ জানুয়ারির বিপ্লবকে যদি আমরা ষড়যন্ত্র বা স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন হিসেবে আখ্যা দিই, তাহলে এর পরের সময়ে যা যা ঘটেছে, সেগুলোর আসলে কোনো দরকার নেই। আর আমরা তখন তার আগের সময়ে ফিরে যেতে পারি।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
কামাল গাবালা: মিসরের আল-আহরাম পত্রিকাগোষ্ঠীর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক।