চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী ছিলেন মোহাম্মদ নূর হোসেন। চট্টগ্রাম বেতারের কথক ও খেলাধুলার ভাষ্যকার এবং সমাজসেবী হিসেবেও তাঁর পরিচিতি ছিল।
একাত্তরের ২২ মে সকালে তিনি বাসা থেকে অফিসে রওনা হয়েছিলেন। কিন্তু অফিসে আর যেতে পারেননি।
সকাল আটটার দিকে তাঁর গাড়ি দুজন পাকিস্তানি সেনাসহ দেওয়ানহাট থেকে উত্তর দিকে যেতে দেখা গেছে।
তখন থেকেই শুরু হয় ব্যাপক খোঁজখবর। কিন্তু সবই ছিল বৃথা। কোথাও তাঁকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এ ঘটনা সম্পর্কে জানা যায় তাঁর ভাই ফজল হোসেনের ‘আমার ভাই’ রচনা থেকে। তিনি লিখেছেন, ‘দাদা সপরিবারে থাকতেন বন্দরের অফিসার্স কলোনির ৩০ নং বাংলোয়।
’৭১-এর মার্চের পর থেকেই তাঁরা ছিলেন একরকম বন্দী, কারণ এলাকাটি ছিল পাকবাহিনীর কঠোর নিয়ন্ত্রণে এবং সে মুহূর্তে সেখান থেকে সরে আসা সম্ভবও ছিল না।
তাই ধীরে ধীরে ব্যবস্থা নিলেন শহরের দিকে বাসা বদলের। মে মাসের মাঝামাঝি বাসা বদলের ব্যবস্থা হয়ে গেলে সাময়িকভাবে সপরিবারে উঠলেন আমাদের নিজস্ব বাসায় “হোসেন মঞ্জিল”—রেয়াজুদ্দীন রোডে।
উদ্দেশ্য ছিল সুযোগ বুঝে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান এবং আমার কাছে গচ্ছিত রেখেছিলেন বন্দর সম্পর্কিত বেশ কিছু মূল্যবান বইপত্র ও নকশা, যেগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের বন্দর অপারেশনে অত্যন্ত প্রয়োজন।
‘কয়েক দিন তিনি বাসা থেকেই অফিস করছিলেন, আর সেদিনও যথারীতি রওনা দিয়েছিলেন অফিসের উদ্দেশে।
দিনটি ছিল শনিবার, ২২ মে ১৯৭১। সেদিনের কোনো একটি ক্ষণ আমার ভাইকে বিচ্ছিন্ন করল আমার কাছ থেকে, বাবা-মার কাছ থেকে, তাঁর স্ত্রী ও ছেলেমেয়ের কাছ থেকে। আমাদের পুরো পরিবারকে পঙ্গু করে দিয়ে গেল সেই ক্ষণটি।
‘দাদার সঙ্গে আমার শেষ দেখা একুশে মে রাত ১০টার দিকে, যখন তিনি বাসার পেছন দিকে খালি জায়গাটুকুতে পায়চারি করছিলেন।
ওই দিনই বন্দরের প্রধান প্রকৌশলী শামসুজ্জামানকে পাকসেনারা সুকৌশলে সরিয়ে ফেলেছিল (যিনি আর ফিরে আসেননি)।
আমাকে দেখেই বললেন, “দেখ তো আজ আকাশে এত মেঘ কেন?” আমি বললাম, “হয়তো বৃষ্টি হবে।” অথচ তখন ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি পরদিন সকালেই নিষ্ঠুর পাকসেনারা মেঘ হয়ে আমার ভাইকে আড়াল করে দিবে।
দাদা নির্ধারিত সময়ে বাবা-মা, ভাবি ও ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে প্রতিদিনের মতো বিদায় নিয়ে জামান সাহেবের বাসা হয়ে অফিসে রওনা দিয়েছিলেন তাঁর নিজস্ব গাড়ি ও ড্রাইভারসহ।
সাড়ে নয়টার পর ভাবি কান্নায় ভেঙে পড়ে জানালেন, তোমার দাদার তো খবর পাওয়া যাচ্ছে না।
বিচলিত হলাম আমি। এদিক-ওদিক খোঁজ নিতে গিয়ে দেখলাম দাদার গাড়িটি বাটালী রোডে তৎকালীন আলী ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের সামনে পড়ে আছে দরজা বন্ধ অবস্থায়।
গাড়ি কে বা কারা রেখে গেছে কেউ বলতে পারল না সঠিকভাবে। দুপুর ১২টার দিকে পাড়ার ইউসুফ ভাই আমাদের বাসায় এসে জানালেন, সকাল আটটার দিকে দাদার গাড়িকে দাদা, ড্রাইভার ও দুজন পাকসেনাসহ দেওয়ানহাট থেকে উত্তর দিকে আসতে দেখেছেন।
এ কথা শুনে আমাদের ধারণা হয়ে গেল যে দাদাকে পাকসেনারা ধরে নিয়ে গেছে। তারপর শুরু হলো দাদাকে ফিরিয়ে আনার নিষ্ফল প্রচেষ্টা।
এভাবে দিনের পর দিন শুধু খোঁজাই হলো সার।’ (স্মৃতি: ১৯৭১, দ্বিতীয় খণ্ড, সম্পাদনা রশীদ হায়দার, প্রকাশ ১৯৮৯)।
মোহাম্মদ নূর হোসেনের জন্ম ১৯৩৬ সালের ২৩ এপ্রিল, চট্টগ্রামে। বাবা মোহাম্মদ জাকির হোসেন। কৃতী ছাত্র ছিলেন।
১৯৫১ সালে ম্যাট্রিকে সাধারণ অঙ্ক ও অতিরিক্ত অঙ্কে লেটার পান; চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে অঙ্ক ও রসায়নে লেটারসহ আইএসসি পাস করেন।
এ পরীক্ষায় দ্বাদশ হয়েছিলেন। আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে ১৯৫৭ সালে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে তৃতীয় স্থান অধিকার করে পাস করেন।
এর পরই তাঁর চাকরি হয় কর্ণফুলী হাইড্রলিক প্রজেক্টে। ১৯৫৯ সালে যোগ দেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষে (তখন পোর্ট কমিশনার্স)।
১৯৬৪ সালে হল্যান্ডের ডেল্ফট্ টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটি থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নেন।
দেশে ফিরে তিনি আইন বিষয়ে পড়েছিলেন। পরীক্ষা দিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। ১৯৬৮ সালে জাতিসংঘের ফেলোশিপের অধীনে বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাজ্য ও উপমহাদেশের বিভিন্ন এলাকায় শিক্ষাসফর করেন।
মোহাম্মদ নূর হোসেন তিন ছেলে ও এক মেয়ের জনক। ছেলে আবিদ হোসেন (বিদ্যুৎ প্রকৌশলী, যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী), জাহিদ হোসেন (চিকিৎসক) ও শাকিল হোসেন (অর্থনীতিতে মাস্টার্স)। মেয়ে উইলি। স্ত্রী খুরশিদ জাহান বেগম।
প্রতিকৃতি: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (ষষ্ঠ পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৭) থেকে।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
[email protected]