মেয়েটির কী হবে

মাঝবয়সী মহিলা। বিকেলে গুলশান লেকের পাশের ভাঙাচোরা ওয়াকওয়েতে নিয়মিত হাঁটেন। পথের পাশেই গাছে হেলান দিয়ে একটা কম বয়সী মেয়ে বসে থাকে। চুপচাপ। কখনো কখনো আপন মনে কী যেন বলে। একদিন দেখলেন নানা বয়সী কয়েকজন তাকে উত্ত্যক্ত করছে। মেয়েটা মাঝেমধ্যে ফাঁকা চোখে তাকিয়ে দেখছে, কিছু বলছে না। সমাজ এ ধরনের মেয়ে (বা ছেলে)কে ‘পাগল’ বলে। গ্রামে–গঞ্জে, শহরে–বন্দরে, রাস্তাঘাটে এদের একসময় অনেক দেখা যেত। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে বাচ্চাকাচ্চারা এদের উত্ত্যক্ত করছে, এমনটা ছিল খুবই সাধারণ একটা দৃশ্য। কিছু যুগান্তকারী ওষুধ এবং মানসিক চিকিৎসার উন্নতিতে এ সংখ্যা এখন অনেক হ্রাস পেয়েছে।

দৃশ্যটি মহিলাকে বিচলিত করল। ঘিরে থাকা মানুষগুলোকে বললেন, কেন মেয়েটাকে উত্ত্যক্ত করছেন? আপনাদেরও তো মা আছে, বোন আছে, কারও কারও হয়তো মেয়েও আছে। আপনার বোন বা মেয়েকে এমন করলে আপনার কেমন লাগত? শুনে কেউ কেউ অধোবদন হলেন। আস্তে কেটে পড়লেন দুজন। দুটো ছেলে এগিয়ে এসে মাফ চেয়ে বলল, আন্টি, আপনি খুব সুন্দর করে কথাটা বললেন। জানাল, মেয়েটি গুলশানের ভেতরের রাস্তায় এক বাড়ির গেটের সামনে বসেছিল কিছুদিন। বাড়ির বিব্রত বাসিন্দাদের অনুরোধে পুলিশ তাকে এখানে রেখে গেছে।

দুদিন পর গভীর রাতে মহিলার ঘুম ভেঙে গেল। গগনবিদারী চিৎকারে ‘পাগল’ মেয়েটি কাউকে অকথ্য ভাষায় গাল দিচ্ছে। কোনো ‘মানুষ’ সম্ভবত তার গায়ে হাত দিয়েছিল।

আমার বাসায় যে মেয়েটি খণ্ডকালীন কাজ করে, জানাল তাদের বস্তিতেও এমন একটা মেয়ে আছে। গর্ভবতী হয়েছিল, একটি বাচ্চারও জন্ম দিয়েছে। বাচ্চাটাকে নিয়ে পথেই থাকত। কিছুদিন আগে বাচ্চাটা চুরি হয়ে গেছে। মেয়েটি উদ্‌ভ্রান্তের মতো সন্তানকে খুঁজেছে, পায়নি। সাত বছর আগে, আমি তখন বেইলি রোডে সরকারি বাসায় থাকি, হাঁটতে যেতাম রমনা পার্কে। একদিন দেখলাম ২০-২২ বছরের একটি মেয়ে, সম্পূর্ণ বিবস্ত্র, উত্তেজিত স্বরে কী যেন বলতে বলতে হেঁটে যাচ্ছে ‘ভিআইপি’ রাস্তা ধরে।

সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শেখ রফিকুল ইসলাম সজ্জন ব্যক্তি। চৌকস কর্মকর্তা, সংবেদনশীল। রাজারহাটের ইউএনও থাকাকালে অসহায় মেয়েদের সহায়তায় একটি প্রতিষ্ঠান দাঁড় করিয়েছিলেন। কী করা যায় জানতে তাঁকে ফোন করেছিলাম। বিব্রতভাবে জানালেন তাঁর অধিদপ্তরের সীমাবদ্ধতার কথা। ভবঘুরে নিবাস আছে, তবে ধারণক্ষমতা সীমিত। দীর্ঘ মেয়াদে রাখাও যায় না। তা ছাড়া যাদের মানসিক সমস্যা আছে, যেমন এই মেয়েটি, তাদের জন্য কিছুই করার সুযোগ তাঁদের নেই। এদের যে চিকিৎসা লাগবে, সেটা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ার। ৩৩ বছরের চাকরিজীবনের অভিজ্ঞতায় তাঁর অসহায়ত্ব বুঝতে পারলাম।

মানসিক চিকিৎসক অধ্যাপক আহসানুল হাবিবের সঙ্গে কথা বললাম। একসময় হিমাইতপুরের পাবনা মানসিক হাসপাতালের পরিচালক ছিলেন, এখন একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে অধ্যাপনা করেন। তিনিও কোনো সমাধান দিতে পারলেন না। হিমাইতপুরে ভর্তি করতে হলে পরিচয় লাগবে, অভিভাবক লাগবে, চিকিৎসায় সুস্থ হলে যিনি এসে নিয়ে যাবেন। চিরদিন থাকার ব্যবস্থা কোথাও নেই। এই মেয়ের কোনো অভিভাবক নেই, সম্ভবত পুরো সুস্থও হবে না কোনো দিন। তার জন্য বাকি জীবন থাকা-খাওয়াসহ সহায়তার প্রয়োজন হবে।

সারা দেশে এমন কত মানুষ আছে? এক হাজার? ১০ হাজার? ৫০ হাজার? তার মধ্যে কতজন মেয়ে? এ কথা বলছি এ জন্য যে এই অসহায় মানুষের মধ্যে মেয়েটি আরও বেশি অসহায়, আরও বেশি দুর্বল, নিরাপত্তাহীন। এই মেয়েগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে তাদের একটি ন্যূনতম মানবিক জীবনযাপনের সুযোগ করে দেওয়ার সামর্থ্য কি মধ্যম আয়ের বাংলাদেশের নেই?

এই মেয়ে এবং তার মতো আরও যারা আছে (ছেলেগুলোও), তাদের মানুষের মতো বাঁচতে হলে কিছু প্রতিষ্ঠান লাগবে, যেখানে তারা আশ্রয় পাবে, খাদ্য, বস্ত্র ও চিকিৎসা পাবে। কত টাকা লাগবে? হাজার হাজার কোটি টাকার কত প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে, অথচ ছোট আকারের একটি প্রকল্প অসহায় এ মানুষগুলোর জীবন বদলে দিতে পারে।

প্রকল্পের প্রসঙ্গ এলেই এসে যায় কোন মন্ত্রণালয় করবে, এ প্রশ্ন। এরপর সম্ভাব্যতা যাচাই, বিদেশি সহায়তা, ভূমি অধিগ্রহণ । প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি, পাস এবং অর্থ বরাদ্দ করাতে লাগে পাঁচ বছর, বাস্তবায়নে আরও পাঁচ। অসহায় এই মানুষগুলোকে সহনীয় জীবন দিতে হলে এ চক্র থেকে বেরোতে হবে। খুব তাড়াতাড়ি একটি পাইলট প্রকল্প নিয়ে ১০টি শহরে ১০টি হোম বানিয়ে তাতে এক হাজার মেয়ের আশ্রয় সৃষ্টি করা সম্ভব। ভুলভ্রান্তি কিছু হলে তা থেকে শিক্ষা নিয়ে বিস্তৃত পরিসরে ছড়িয়ে দেওয়া যায়। সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরই কাজটা করতে পারে, প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে পারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ছাড়া এ দেশে কেউ কোনো কাজ করেন না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত পৌঁছার সুযোগ যাঁদের আছে, তাঁদের কেউ কি দয়া করে প্রথম পদক্ষেপটি নেবেন?

আরেকটি প্রস্তাব দিয়ে লেখাটি শেষ করছি। বিভিন্ন উপায়ে বাংলাদেশের অনেকেই এখন বিপুল অর্থবিত্তের মালিক। পশ্চিমের, এমনকি ভারতেরও, কোনো কোনো বিলিয়নিয়ার তাঁদের জীবদ্দশায়ই নিজেদের সম্পদের একটা বড় অংশ মানবকল্যাণে দান করে গেছেন। হয়তো তাঁরা উপলব্ধি করেছেন, প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি এ অর্থ তাঁরা মৃত্যুর সময় সঙ্গে করে নিতে পারবেন না, উত্তরসূরিরাও ভোগ করে শেষ করতে পারবে না। বাংলাদেশে এমন উদাহরণ এখনো দেখিনি। এ উদ্যোগ দিয়েই কেউ একজন শুরু করুন না। আমরা কেউ তো এ পৃথিবীতে স্থায়ী নই। সৃষ্টিকর্তার আনুকূল্য লাভের জন্যই না হয় করুন কাজ।

মো. তৌহিদ হোসেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব