মেয়ের বাপ হওয়া কি পাপ?
এই দেশে মেয়ের বাবা হওয়া কি পাপ? গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোর প্রথম পাতায় পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শাহানূর বিশ্বাসের ছবি দেখে মনে এ প্রশ্ন জাগল? মেয়েকে উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রতিপক্ষের লোকজনের হামলায় দুই পা হারিয়েছেন তিনি। এরপরও তাঁর রেহাই নেই। এখন ভিটেছাড়া হওয়ার ভয় তাড়া করছে।
সংবাদমাধ্যমে খবরটি এসেছে বলেই আমরা ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার নলডাঙ্গা গ্রামের শাহানূর বিশ্বাসের এই দুর্গতির কথা জানতে পারছি। বাস্তবে কিশোরী বা তরুণী মেয়ে নিয়ে বিপাকে পড়া বাবার সংখ্যা কম নয়। শাহানূর কোনো দিন আর প্রতিকূলতার প্রবল স্রোতের মুখে অদম্য বাঁধ হয়ে মেয়ের সামনে দাঁড়াতে পারবেন না। নিশ্চল পড়ে থেকে আশঙ্কায় ধুঁকবেন আর পরাস্ত সেনার মতো নতজানু হয়ে সৃষ্টিকর্তার কৃপা কামনা করবেন। তা ছাড়া কীই-বা করার আছে তাঁর?
কিন্তু এমন অনেক বাবা আছেন, দুটি সবল পা থাকা সত্ত্বেও শক্ত হয়ে দাঁড়ানোর মতো মাটি খুঁজে পাচ্ছেন না। বখাটে বা উত্ত্যক্তকারীর নিপীড়নে মেয়ে যখন তার পরম নির্ভরতার দ্বারে ফিরে আসে, এই বাবা তখন অক্ষমতার লাজে নিজেকেই ধিক্কার দিতে থাকেন। কারণ, তাঁর করার তো কিছু নেই। যে সমাজের কাছে তিনি প্রতিকার চাইবেন, সে সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি আগে তাঁর মেয়েরই শত দোষ বের করার তালে থাকবে। কেউ বলবে, ‘ছেলেমানুষ, বয়েসের দোষে এমন করেছে, ছেড়ে দাও।’
কেউ বলবে, ‘মেয়ের বাপ হয়েছ, এমন দু-একটা ঝামেলা যাবেই। বেশি নাড়াচাড়া কোরো না। কলঙ্ক রটবে।’
আবার কেউ কেউ পরামর্শ দেবে, ‘মেয়েটাকেই আগলে রাখো না। বাড়ির বাইরে যাওয়ার দরকারটা কী? পড়াশোনা বন্ধ হবে? হোক না, মেয়ে মানুষের এত পড়াশোনা দিয়ে হবেটা কী?’
একজন মাবিয়ার বেলায় আবার দেখা যায় অন্য রকম চিত্র। মাবিয়া যখন নিজ কৃতিত্বে দেশের পতাকাকে সম্মানের আসনে নিয়ে যান, ঠিকই আবেগপ্রবণ হয়ে গুণগান করি। মেয়েদের ফুটবল দল শিরোপা জয় করলে গলা ফাটিয়ে জয়ধ্বনি দিই। তখন পুরোমাত্রায় তাঁদের কৃতিত্বের ভাগীদার হই। তাই বলে পেছন থেকে লাথি মারার সুযোগটা কিন্তু ছাড়ি না। ফুটবলে শিরোপা জয় শেষে কলসিন্দুরের মেয়েরা বাসে করে বাড়ি ফেরার সময় সে নমুনা কিন্তু দেখিয়েছি।
এই সমাজে একটি মেয়েশিশু জন্ম নেওয়ার পর তাকে নিয়ে সচেতন প্রতিটি মা ও বাবার যে উদ্বেগ শুরু হয়, তা থাকে আজীবন। প্রথমত, তার প্রতি সমাজের একটি গৎবাঁধা দৃষ্টিভঙ্গি থাকে যে সে মেয়ে। মেয়েটি যত বড় হয়, তাকে ঘিরে নানা দুশ্চিন্তার একটা বলয় যেন ঘুরপাক খায়। মেয়ে কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে, কী পরিবেশে আছে—এসব নিয়ে মা-বাবারা প্রায় সারাক্ষণ উদ্বেগের মধ্যে থাকেন। আর আমাদের সমাজের ধরনটাই এমন, এখানে নারীর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সহাবস্থান ও তাঁর প্রতি সহানুভূতিশীল মানসিকতার চেয়ে ভোগের স্পৃহাটাই বেশি। নারীর প্রতি পুরুষের আচরণ কেমন হওয়া উচিত, এ ব্যাপারে পারিবারিক বা প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষার প্রচলন আমাদের দেশে নেই বললেই চলে। আমরা দেখে দেখে শুনে শুনে যে যা বুঝি, সে অনুযায়ী নারীর প্রতি আচরণ করে থাকি।
বুদ্ধিশুদ্ধি একটু বিকশিত হওয়ার পর বেশির ভাগ ছেলে পারিবারিকভাবে নারীর প্রতি পুরুষদের আচরণ দেখে প্রথমে যা বুঝতে পারে, তা হলো, এখানে নারীরা পুরুষের অধীনে। তারপর বড়দের আলোচনা থেকে ছিটকে আসা কথা এবং অন্যদের কানাঘুষা থেকে একটু একটু করে সে বুঝতে পারে, নারী যতটা সম্মানের, এর চেয়ে বেশি হচ্ছে ভোগের। তারপর বয়সের পোকা যখন মাথায় নড়াচড়া করে, আকাশ সংস্কৃতির উদারতায় নানা কিছু দেখে, সামাজিক যোগাযোগর ওয়েবসাইটে সাঁতরে বেড়ায়, তখন নারীকে পীড়ন করার একটা মানসিকতা ছাইচাপা আগুনের মতো ধিকি ধিকি জ্বলে। নারীর জন্য এই পুরুষ তখন আর মানুষ নয়, বহুরূপী আদম। যেসব মা-বাবার ঘরে মেয়ে আছে, তাঁরা কিন্তু কন্যাটি একটু বড় হওয়ার পরই এই শ্বাপদসংকুল বনভূমির অস্তিত্ব টের পেয়ে যান। বিশেষ করে বাবারা। কারণ, মায়েদের চেয়ে তুলনামূলকভাবে তাঁরাই বাইরে বেশি ঘোরাফেরা করেন। বাবারা বোঝেন, মেয়ে ঘরের বাইরে পা দিয়েই এমন এক অরণ্যে প্রবেশ করবে, যেখানে রয়েছে কিছু হিংস্র পশু। তাদের কেউবা সিংহ, কেউবা বাঘ, কেউবা শিয়াল, কেউ হায়েনা বা বিষধর সাপ। কিন্তু বাইরে থেকে কাউকে চেনার উপায় নেই। এই চিন্তা একজন বাবাকে পলে পলে অস্থির করে তোলে। কেউ তা টের পায় না।
এতক্ষণ এত কথা বলার কারণ হচ্ছে, আমারও একটি শিশুকন্যা আছে। অন্যান্য বাবার মতো তাকে নিয়ে আমিও চিন্তা করি। তবে আমি হতাশাবাদী নই। তাই আশা আছে, আমার এই চিন্তা থাকবে ঠিকই, তবে তা কখনো দুশ্চিন্তা হবে না। একই সঙ্গে এই প্রত্যাশা করি, সে যখন বড় হবে, তখন তার চারপাশের সবই থাকবে নারীবান্ধব। তখন কোনো নারীকে আর দোকানের লোভনীয় খাবার ভাববে না কোনো পুরুষ। পুরুষের মনোভাব হবে, নারীকে রক্ষা করা তার নৈতিক কর্তব্য। তখন কোনো কিশোরীর পথ রুদ্ধ করবে না কোনো বখাটে। কোনো উত্ত্যক্তকারীর নিপীড়নে বন্ধ হবে না কোনো তরুণীর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়া। বন্ধুত্বের ছলে কোনো ছেলে অন্য বন্ধুদের নিয়ে সর্বনাশ করবে না কোনো মেয়ের। রাতবিরেতে একটি তরুণী একাই নিশ্চিন্তে রাস্তা দিয়ে হাঁটবে। ঝড়ঝঞ্ঝার মতো বিপদে নিঃসঙ্গ নারীর মাথায় ছাতা ধরবে কোনো পুরুষ। বন্ধুর মতো বলবে, ‘চলুন, আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি!’
শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া: সাংবাদিক, সাহিত্যিক
[email protected]