মোটিভেশনের গল্প বিক্রি ও শর্টকাটে বড়লোক হওয়ার ফাঁদ

একটি দেশে ধনী উৎপাদনের প্রক্রিয়াগুলো সুষ্ঠু, দীর্ঘ, সুচিন্তিত ও সুপরিকল্পিত হওয়া উচিত। এ জন্য গুণগত শিক্ষা, মানসম্মত অবকাঠামো, কার্যকর অর্থনৈতিক সংস্কার ও উদ্যোক্তাদের বিকশিত করার সমন্বিত পরিকল্পনা দরকার। দরকার বিনিয়োগে নিরাপত্তা, রাষ্ট্রীয় সম্পদে সাধারণের সমান প্রবেশাধিকার, বৈষম্যহীন আর্থিক প্রণোদনা ও প্রশিক্ষণ এবং ব্যাংক ঋণে ন্যায্য প্রবেশাধিকার। প্রতিভা, উদ্ভাবনী ব্যবসায়িক ধারণা ও উদ্যোক্তাদের উৎসাহিতকরণে শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো প্রয়োজন, যা বিশেষ গোষ্ঠীকে বিশেষ সুবিধা দিয়ে সাধারণকে দূরে ঠেলার মতো বৈষম্য রাখবে না। এ কাজে রাজনৈতিক সততা, সঠিক চিন্তা ও দূরদর্শিতা লাগে, লাগে প্রচুর বিনিয়োগও। নিট শূন্য ভ্যালু থেকে নতুন সম্পদ তৈরি হয় না। প্রত্যেক বৈধ কোটিপতি হচ্ছেন রাষ্ট্র, সরকার ও সমাজের সমন্বিত মেধা অবকাঠামো এবং আর্থিক বিনিয়োগের ফসল।

১.
বিকেন্দ্রীভূত পুঁজিবাদী রাষ্ট্র অবকাঠামো পরিষেবা এবং সম্পদে নাগরিকদের সমান প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করে। নিবেদিত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের কর্ম-পরিকল্পনা শোনে, ব্যবসায়িক পরিকল্পনা তৈরিতে সাহায্য করে এবং স্টার্ট-আপ দাঁড় করাতে উৎসাহ দেয়। এ ছাড়া উদ্যোক্তাদের প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ব্যাংকিংসহ অন্যান্য ব্যবসা সহজীকরণ পরিষেবা ও প্রণোদনা নিশ্চিত করে। উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সাধারণ মানুষের সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত ও বিকশিত করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে, এটা দলীয় ক্ষমতার বলয়ে আবদ্ধ থাকে না। চীন কাজটা করে কিছুটা ভিন্নভাবে। বিশেষ বিশেষ নার্সারিং প্রকল্প হাতে নিয়ে, তার হাতে আছে বেইজিং কনসেনসাস। পুঁজিবাদী কিংবা উদারনৈতিক ব্যবস্থা কেন্দ্রীভূত প্রশাসনের চূড়ান্ত বিকেন্দ্রীকরণ করে বলে রাষ্ট্রের সম্পদ ও সুবিধায় সাধারণের অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা তৈরি হয়। রাষ্ট্রীয় রিসোর্স ও ক্ষমতার ভাগাভাগিতে স্বচ্ছতা আনা গেলে নতুন নতুন উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তা তৈরির একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া সচল হয়। এই প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত ফল হচ্ছে, বৈধ নতুন ধনী কিংবা বৈধ কোটিপতির আবির্ভাব।

কিন্তু কেন্দ্রীভূত পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় রাষ্ট্র নিজেই নতুন সম্পদ তৈরিতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, বাংলাদেশে ঠিক তা-ই হয়। ব্যক্তির আর্থিক ও কর্মবিকাশের আইডিয়াগুলো রাজনীতি ও প্রশাসনের নিচের স্তরেই আটকে পড়ে, সচিব ও মন্ত্রী পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না। বিশেষ দলের প্রভাব ছাড়া উদ্যোক্তারা ব্যাংক ঋণ, প্রণোদনা সুবিধা ও ইপিজেডের জায়গা পান না। তথাকথিত সফল উদ্যোক্তাদের ছবি প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক ও সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখা যায় ক্ষমতার শীর্ষে থাকা ব্যক্তিদের সঙ্গে। কারণ রাজনৈতিক ব্যবস্থায় যাঁদের প্রভাব নেই, তাঁদের জন্য কোটিপতি হওয়া অনেকটা দুরূহ হয়ে পড়ে।

ধনী হওয়ার শর্টকাট পথ হলো উন্নয়ন প্রকল্পের নামে সীমাহীন অর্থ অপচয় ও লুট করা, মানহীন কাজ করা, প্রশাসনিক জালিয়াতির মাধ্যমে অতিরিক্ত ব্যয় দেখানো কিংবা উন্নয়ন প্রকল্পের সময়ক্ষেপণ করা। শর্টকাট পথে ধনী হওয়া জবাবদিহিহীন রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য, যেখানে বেপরোয়া দুর্নীতি, লুটপাট ও জালিয়াতির মাধ্যমে একদল কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী রাতারাতি ধনী হন।

অধ্যাপক ডগলাস নর্থের তত্ত্ব দিয়ে বিষয়টি আরও ভালোভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। তাঁর মতে, একটি সমাজ বা রাষ্ট্র দুই ভাবে সমস্যার সমাধান করতে পারে। এক. লিমিটেড অ্যাকসেস অর্ডার, যেখানে রাষ্ট্রীয় সম্পদে নাগরিকের প্রবেশাধিকার সীমিত। দুই. ওপেন অ্যাকসেস অর্ডার, যেখানে রাষ্ট্রীয় সম্পদ সাধারণের জন্য উন্মুক্ত। লিমিটেড অ্যাকসেস অর্ডারের বৈশিষ্ট্য হলো, দেশের রাজনৈতিক অভিজাতেরা নিজেদের মধ্যে অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ ভাগ করে নেন এবং প্রত্যেকে অতিরিক্ত রেন্ট সিকিং করে (দুর্নীতি-লুটপাট)। রাষ্ট্রের ভূমি, শ্রম, পুঁজি, ব্যাংক ঋণ, ব্যবসা, চাকরি, শিক্ষা, রাজনীতি, ক্ষমতা, নির্বাচন ইত্যাদির ওপর নিজেদের প্রভাব তৈরি করে অভিজাত শ্রেণি। ফলে রাষ্ট্রীয় সম্পদ, সেবা ও সুবিধাগুলোতে জনগণের সুযোগ সীমিত হয়ে যায়। বিনিময়ে তাদের সমর্থনের শর্তসাপেক্ষে নাগরিককে নিরাপত্তা দেওয়ার চেষ্টা করে। আর ওপেন অ্যাকসেস অর্ডারে নাগরিক এবং রাজনৈতিক অভিজাতেরা সব সুযোগ নাগরিকদের মধ্যে সমানভাবে বিতরণের জন্য একটি চুক্তিতে পৌঁছান। আর প্রতিষ্ঠানগুলো জনগণের রাজনীতি ও ক্ষমতার অধিকার, সম্পদ অর্জন ও শিক্ষার অধিকারসহ সবকিছু সমতার ভিত্তিতে নিশ্চিত করে।

ধনী হওয়ার যে কোনো শর্টকাট প্রক্রিয়া আদতে ‘অসভ্য’। জালিয়াতি করে মুনাফা বাড়ানোর কৌশল এবং সিস্টেমকে প্রভাবিত করে রেন্ট সিকিং অর্থাৎ দুর্নীতি ও লুটপাটের কাঠামো রাষ্ট্রকে সচেতনভাবে এড়াতে হবে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক, আমলাতান্ত্রিক ও আর্থিক ব্যবস্থায়, মাঝারি ও বড় কোম্পানিগুলোর ব্যবসার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে ক্রোনিজম এবং রেন্ট সিকিং। বাংলাদেশে ধনী হওয়ার শর্টকাট পথ হলো ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে মিলেমিশে ইচ্ছা করে ব্যাংক ঋণ নিয়ে খেলাপি হয়ে যাওয়া এবং পঞ্জি স্কিম তৈরি করা। এখানে ধনী হওয়ার শর্টকাট পথ হলো উন্নয়ন প্রকল্পের নামে সীমাহীন অর্থ অপচয় ও লুট করা, মানহীন কাজ করা, প্রশাসনিক জালিয়াতির মাধ্যমে অতিরিক্ত ব্যয় দেখানো কিংবা উন্নয়ন প্রকল্পের সময়ক্ষেপণ করা। শর্টকাট পথে ধনী হওয়া জবাবদিহিহীন রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য, যেখানে বেপরোয়া দুর্নীতি, লুটপাট ও জালিয়াতির মাধ্যমে একদল কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী রাতারাতি ধনী হন।

২.
বাংলাদেশি মোটিভেশনাল স্পিকার, ইয়ুথ লিডার, থট লিডার, চিন্তক ও বুদ্ধিজীবীদের কথা শুনে মনে হয় যে উদ্যোক্তাবান্ধব অবকাঠামো তৈরি, শিক্ষার মান উন্নত করা, কর্মসংস্থান তৈরি ও শিক্ষিত বেকারত্বের অভিশাপ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সরকারের কিছুই করার দরকার নেই। কর্মহীন প্রবৃদ্ধি থেকে বেরোতে কর্ম সুরক্ষা ও কর্ম-পরিবেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত, আর্থিক জালিয়াতি থেকে মুক্তি, আর্থিক খাতের সংস্কার এবং ব্যবসা সহজীকরণে সবার জন্য সমান প্রবেশাধিকার তৈরিতে সরকারের কিছুই করার নেই। সরকারের কাছে তাঁদের কোনো দাবি নেই, তাঁদের মুখে শুধুই গুণগান, যাকে ‘তৈলমর্দন’ হিসেবেই জানে নাগরিকেরা। তাঁদের মতে তরুণেরা নিজের চেষ্টায় যোগ্য হয়ে উঠবে এবং লাফিয়ে লাফিয়ে বিলিয়নিয়ার হয়ে যাবেন।

বাস্তবে আমাদের দেশের তরুণ বা উদ্যোক্তাদের শর্টকাটে ধনী করার প্রতিটা ভালো কথা শেষ পর্যন্ত প্রতারণায় পরিণত হয়েছে। ক্ষমতাসীনদের প্রভাব বলয়ের লোকজনের হাতে ব্যাংক ঋণ ও বিভিন্ন লাইসেন্স ধরিয়ে দিয়ে শর্টকাটে ধনী বানানোর পঞ্জি প্রকল্পগুলোতে বড় বড় ফাঁদ রয়েছে। মোটিভেশনাল বক্তারা এসব গল্প বেচেন।

মোটিভেশনাল বক্তারা দিনশেষে যেন সরকারের ব্যর্থতা ঢাকতে বদ্ধপরিকর। বহুক্ষেত্রে প্রেরণামূলক বক্তা ও তারকারাই সরকার থেকে অন্যায় সুবিধা নিয়ে বড় বড় উদ্যোক্তা হয়ে উঠেছেন, পঞ্জি মডেলের ই-কমার্সের সঙ্গে নিজেদের নানাভাবে সম্পৃক্ত করেছেন। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্তরা তরুণদের বলেন, চাকরি খুঁজো না; বরং চাকরি দাও।

অধ্যাপক হাইম্যান মিনিস্কির মতে, পঞ্জিঋণের আয় এত কম যে তা দিয়ে ঋণগ্রহীতা তাঁর সুদ বা আসল কোনোটাই পরিশোধ করতে পারবেন না, পঞ্জি আমানত কখনো মূল আমানত ফেরত দিতে পারে না। পঞ্জিঋণ গ্রহীতাকে সুদ-আসলের অর্থ পরিশোধ করতে হলে সব সময়েই নতুন ঋণের প্রয়োজন হয়। পঞ্জি আমানত গ্রহীতাকে নতুন আমানতের সেই ঋণ ও আমানত তাঁর জন্য যথেষ্ট হয় না কারণ, ঋণের সুদ-আসল চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকে, এতে আমানতের ঘোষিত রিটার্ন একেবারেই অবাস্তব। এদের নিট ঋণ ও দেনা সমসময়ই মোট সম্পদের চেয়ে বহুগুণ বেশি থাকে।

মোটিভেশনাল বক্তারা দিনশেষে যেন সরকারের ব্যর্থতা ঢাকতে বদ্ধপরিকর। বহুক্ষেত্রে প্রেরণামূলক বক্তা ও তারকারাই সরকার থেকে অন্যায় সুবিধা নিয়ে বড় বড় উদ্যোক্তা হয়ে উঠেছেন, পঞ্জি মডেলের ই-কমার্সের সঙ্গে নিজেদের নানাভাবে সম্পৃক্ত করেছেন। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্তরা তরুণদের বলেন, চাকরি খুঁজো না; বরং চাকরি দাও। সরকারকে কর্মহীন প্রবৃদ্ধি ও কর্মহীন শিক্ষা থেকে বেরিয়ে আসার দাবি না জানিয়ে তাঁরা যুবকদের বারবার উদ্যোক্তা হতে বলেন।

অথচ সাধারণের উদ্যোক্তা হওয়ার প্রায় সব পথ বন্ধ। আস্থা সংকটের কথা বলে ব্যাংকগুলো সাধারণ মানুষকে ঋণ দিতে গড়িমসি করে, যদিও কোনো কোনো ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের এক-চতুর্থাংশই খেলাপি। বেসরকারি ঋণপ্রবাহ ১০ শতাংশের নিচে। করোনা মহামারির পর ৭০ লাখ এসএমইর অর্ধেকের বেশি ব্যাংক ঋণ পাননি। ব্যবসা সহজীকরণ বা ডুয়িং বিজনেস ইনডেক্সে বাংলাদেশের স্কোর তলানিতে, ১৯০টি দেশের মধ্যে ১৬৮। সম্পত্তি নিবন্ধনে ১০০-তে প্রাপ্তমান ২৯, চুক্তি বাস্তবায়নে ২২, আর্থিক ঝামেলা নিরসনে ২৮, বৈদেশিক বাণিজ্যে ৩২। গত দশকে বিদ্যুৎ খাতে ৫৯ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি সত্ত্বেও বিদ্যুৎ প্রাপ্তিতে স্কোর মাত্র ৩৪। এমতাবস্থায় আমাদের ছেলেমেয়েরা কি হাওয়া খেয়ে উদ্যোক্তা আর কোটিপতি হবে?

পঞ্জি জোচ্চরেরা আমাদের তরুণদের কাজ এবং মূলধন উভয়ই কেড়ে নিয়েছে। কর্ম ও পুঁজি হারানোর পর ক্রমবর্ধমানভাবে হতাশ হয়ে পড়া যুবকেরা মাদকে আসক্ত হচ্ছেন। তাই আমাদের সন্তানদের সৎ পথে সচ্ছল হওয়ার স্বপ্ন দেখান, যে পথ দীর্ঘ হলেও হবে অর্জনযোগ্য। সরকারকে কর্মবিকাশ ও কর্ম সুরক্ষায় বাধ্য করুন। শর্টকাটে ধনী হওয়ার স্বপ্ন থেকে মুক্তি চাই, এটা করতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুট ও পাচার হয়ে যাচ্ছে। ধনবৈষম্য প্রকট হচ্ছে। তাই সরকারকে বলুন ঘুষ ছাড়া ব্যবসা ও শিল্পে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি সংযোগের নিশ্চয়তা দিতে, ব্যবসা ও শিল্পে ব্যবহৃত জ্বালানির দাম ন্যায্য করতে এবং ব্যাংক ঋণে নিয়মতান্ত্রিক বিতরণ নিশ্চিত করতে। শিল্প মন্ত্রণালয় আর রাজউককে বলুন প্লট ব্যবসা করে ধনী তৈরি না করে অফিস ব্যবসা ও শিল্পোৎপাদনের ‘ফ্লোর স্পেস’ তৈরি করতে। কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা ও সম্পদের বিকেন্দ্রীকরণ করে সবার জন্য সমান সুযোগের রাষ্ট্র গড়তে দাবি ওঠান। এ ছাড়া সরকারকে শিক্ষা সংস্কারের মাধ্যমে দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরি করতে বলুন, বাকিটা আমাদের তরুণেরা করবেন।

ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ, বাংলাদেশ: অর্থনীতির ৫০ বছর বইয়ের লেখক। [email protected]