মোদির অবস্থান বদল, সঠিক পথে ভারত

সম্প্রতি ভারতের জাতীয়তাবাদী সরকার দেশের পশ্চিমাঞ্চলে যেসব সমঝোতামূলক পদক্ষেপ নিয়েছে, সেগুলো বিশ্বব্যাপী আগ্রহ জাগিয়ে তুলেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হিসাব–নিকাশ তুলনামূলক সহজ। ভারতের উত্তর সীমান্তে চীনাদের ক্রমাগত আগ্রাসন এবং আফগানিস্তানে সম্ভাব্য তালেবানের পুনরুত্থানের মুখোমুখি হয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের পশ্চিমাঞ্চলের সম্পর্কের উন্নতি নিঃসন্দেহে বিচক্ষণতার পরিচায়ক। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ভারত ও পাকিস্তানের নিরাপত্তা কর্মকর্তারা গোপনে আলোচনায় বসেছিলেন বলে খবর পাওয়া গেছে। আলোচনার লক্ষ্য ছিল দ্বিপক্ষীয় উত্তেজনা প্রশমন এবং এ আলোচনাগুলো হয়েছিল সংযুক্ত আরব আমিরাতের মধ্যস্থতায়।

বিতর্কিত কাশ্মীর অঞ্চল নিয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে ভারত ও পাকিস্তানকে বিভক্তকারী নিয়ন্ত্রণরেখায় দুই দেশের সেনাবাহিনীর যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে। এরই মধ্যে ভারত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সমর্থনপুষ্ট হিসেবে বিবেচিত তালেবানের সঙ্গেও কথা বলেছে। মার্কিন সরকার আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করায় তালেবানের আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আরও অবাক করা বিষয়, এই জুনের শেষে মোদি সরকার কাশ্মীরে মূল ধারার রাজনীতি করেন এমন ১৪ জন নেতার সঙ্গে খুবই আকস্মিকভাবে সৌহার্দ্যপূর্ণ আলোচনা করেছে। ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যে শুরু হওয়া ভারত সরকারের অভিযানের সময় তাঁরা সবাই গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। সুতরাং বোঝা যায় ভারতের উত্তর সীমান্তের ওপর চাপ বিষয়ে সরকার সচেতনভাবে তার নীতি পরিবর্তন করছে।

কোন পক্ষ জয়ী হবে তা আসলে অজানা। তবে আপাতত মনে হচ্ছে ভারত সঠিক পদক্ষেপই নিয়েছে

চীনা সৈন্যরা বিতর্কিত লাদাখ অঞ্চলের দিকে একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছিল এবং পরে তারা সেখানে একটি মুখোমুখি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এবং অন্তত ২০ জন ভারতীয় সৈন্য এতে প্রাণ হারায়। এরপর ১১ দফা আলোচনা হয়েছে, তবু চীন সেখান থেকে সরে যেতে রাজি হয়নি। একটি স্থিতিশীল অবস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য ভারতকে তখন খুব অসহায় দেখাচ্ছিল।

চীনের সঙ্গে শত্রুতা না হয় সহ্য করা যায়। কিন্তু পশ্চিমের সঙ্গে যে উত্তেজনা ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে, তা তো জিইয়ে রাখতে পারে না ভারত। ২০০৮ সালের নভেম্বরে মুম্বাইয়ে সন্ত্রাসী হামলা থেকে শুরু করে ২০১৯ সালে পাকিস্তানের বালাকোটে ভারতীয় বিমান হামলাসহ বেশ কয়েকটি ঘটনার কারণে সাম্প্রতিক সময়ে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। শুধু তা–ই নয়, ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে ভারত জম্মু ও কাশ্মীরকে সাংবিধানিকভাবে দেওয়া স্বায়ত্তশাসন বাতিল এবং ‘কেন্দ্রশাসিত’ অঞ্চলে পরিণত করায় পাকিস্তান ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছে। পাকিস্তান এ নিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী প্রচারণা চালায় এবং ইসলামি দেশগুলোসহ ও জাতিসংঘের মাধ্যমে ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করে।

কিছুদিন আগে পর্যন্ত মোদি নিজ নীতিতে অটল ছিলেন। তাই কাশ্মীরি নেতাদের সঙ্গে তাঁর সাড়ে তিন ঘণ্টার বৈঠকটি ছিল একটি বিস্ময়কর ঘটনা। মোদি সরকার আগে এই নেতাদের কয়েকজন ও তাঁদের পরিবারকে দুর্নীতিগ্রস্ত বলে নিন্দাও করেছিলেন। এখন সেই মোদি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ (ভারতের দ্বিতীয় ক্ষমতাধর রাজনীতিবিদ) এবং অন্য উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা মিষ্টি মিষ্টি কথা বলছেন এবং অবনত মস্তকে প্রটোকল দিয়ে ওই নেতাদেরই স্বাগত জানাচ্ছেন। শান্তি ও উন্নয়নের নবযুগের সূচনা, সন্ত্রাসবাদ নির্মূল, পারিবারিক রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ভেঙে দেওয়া ও দেশের বাকি অংশের সঙ্গে জম্মু ও কাশ্মীরকে এক করার ঘোষণা দিয়ে সরকার সেখানে যে অভিযান পরিচালনা করেছিল, তা সফল হয়নি। কিন্তু তারপরও কাশ্মীরি নেতাদের সঙ্গে ভারত সরকারের সাম্প্রতিক আলোচনাকে পরাজয় স্বীকার হিসেবে দেখাটা ভুল হবে।

আলোচনা হয়েছে তিনটি বিষয় ঘিরে। প্রথমত, কাশ্মীরি দলগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা, দ্বিতীয়ত, রাজ্যের রাজনৈতিক নির্বাচনী এলাকার একটি নতুন সীমানা নির্ধারণ এবং তৃতীয়ত, জম্মু ও কাশ্মীরজুড়ে নির্বাচন এবং এই রাজ্যের মর্যাদা পুনরুদ্ধার। সুতরাং ভারত সরকার পরাজয়ের পরিবর্তে আলোচনার মাধ্যমে কার্য হাসিল করতে চাইছে বলে মনে হচ্ছে। কাশ্মীরি নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় জম্মু–কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন তথা সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল বিষয়ে কোনো কথা হয়নি, কারণ বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন। এখন যদি রাজ্যের নেতারা ৩৭০ অনুচ্ছেদের ব্যাপারে চুপ থাকেন এবং বিষয়টি বিচার বিভাগের ওপর ছেড়ে দেন, তাহলে জম্মু ও কাশ্মীর একসময় রাজ্যের মর্যাদা পাবে এবং এ নিয়ে রাজনৈতিক ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

এই সাম্প্রতিক অগ্রগতিগুলো আসলে আঞ্চলিক দাবা খেলার প্রথম পদক্ষেপ। আফগানিস্তানের পরিস্থিতি, সেখানে পাকিস্তানের সমর্থনে তালেবানের ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা, বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের মাধ্যমে পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্কের প্রভাব—এসব বিষয় নিয়ে এখনো নিজেদের খেলতে হবে।

কোন পক্ষ জয়ী হবে তা আসলে অজানা। তবে আপাতত মনে হচ্ছে ভারত সঠিক পদক্ষেপই নিয়েছে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

শশী থারুর জাতিসংঘের সাবেক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল ও ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী