যত দোষ ‘জলবায়ু’ ঘোষ

দিন যত যাচ্ছে, আবহাওয়ার বৈরিতা তত প্রকট হচ্ছে। এর ফলাফল পৃথিবীর সব প্রান্তেই কমবেশি দৃশ্যমান। সাধারণত তিনটি স্কেলে বিষয়টি আলোচিত হয়—বৈশ্বিক (পুরো পৃথিবী), আঞ্চলিক (দক্ষিণ এশিয়া/বাংলাদেশ) ও স্থানীয় (ঢাকা মেট্রো) অর্থাৎ যদি তাপমাত্রার বৃদ্ধির কথা বলা হয়, তবে আমরা বলি প্রাক্-শিল্পযুগের তুলনায় বৈশ্বিক তাপমাত্রা এক ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপর বেড়েছে। কিন্তু আঞ্চলিক বা স্থানীয় পর্যায়ে এই মাত্রা কি একই রকম, না আরও বেশি। আঞ্চলিক বা স্থানীয় পর্যায়ে উষ্ণায়নের বিষয়টি অপেক্ষাকৃত কম আলোচিত অথচ বিশ্বের অত্যধিক জনঘনত্বপূর্ণ অঞ্চলগুলোর উষ্ণতা প্রাক্‌-শিল্পযুগের তুলনায় দুই ডিগ্রির ওপর বেড়েছে মানে বৈশ্বিক বৃদ্ধির তুলনায় বেশি।

অন্যদিকে স্থানীয় উষ্ণায়ন (নগর এলাকায়) কোথাও কোথাও ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি পরিলক্ষিত হয়। কেন এমনটি হয়? মোটা দাগে কারণ হলো, অঞ্চলভেদে মনুষ্য কর্মকাণ্ডের পার্থক্য। যাক, ২০০০ সালের পর থেকে প্রায় প্রতিবছরই বৈশ্বিক উষ্ণতার নতুন রেকর্ড তৈরি হচ্ছে। ফলে সামনের বিশ্ব কেমন হবে, বিজ্ঞানীরা সেটা বলতে না পারলেও একটা বিষয় নিশ্চিত যে জলবায়ু পরিবর্তনের চিত্রটা হবে ‘ধ্বংসাত্মক’।

২০১৫ সালে প্যারিস জলবায়ু চুক্তির আগপর্যন্ত উন্নত দেশগুলোর বৈশ্বিক উষ্ণায়ন মোকাবিলার কৌশল ছিল বাংলার জনপ্রিয় প্রবাদ, ‘চোরকে বল চুরি কর আর গৃহস্থকে বল সজাগ থাক’। অর্থাৎ নিজেদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বজায় রাখার স্বার্থে একদিকে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার সচল রাখা ও বহির্বিশ্বের অনুরূপ কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক ফোরামে পৃথিবী রক্ষায় মায়াকান্না। এখনো এই অবস্থা কমবেশি বিরাজমান, ফলে ২০১৯ সালে বিশ্বে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ ছিল সাম্প্রতিক কালে সর্বোচ্চ। অবস্থা বেগতিক দেখে এবং জলবায়ু পরিবর্তনকে এক প্রকার অনিবার্য ধরে ২০১০-এর প্রথম থেকে অদ্যাবধি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জলবায়ুর ‘ক্ষত নিরাময়ের’ উদ্দেশ্যে বাস্তুতন্ত্র বা ইকোসিস্টেমকে পুনরুদ্ধারের নামে হাজার হাজার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়।

বেশির ভাগ প্রকল্পের সাফল্য পায় বলে পুনঃকল্পনা, পুনঃ তৈরি ও পুনঃপ্রতিষ্ঠা—এই তিনটি ধারণার সমন্বয়ে মার্চ ২০১৯ সালে রাষ্ট্রগুলোর সংস্থা জাতিসংঘ বর্তমান দশককে (২০২১-২০৩০) বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার দশক হিসেবে ঘোষণা করে। বিজ্ঞানীরা একে ‘পরিবর্তনের তত্ত্ব’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। ধারণা করা হচ্ছে, এই ঘোষণার মাধ্যমে যেকোনো প্রতিবেশের বা বাস্তুতন্ত্রের (বনাঞ্চল, নগর, জলাভূমি, সমুদ্র, সুপেয় পানি প্রতিবেশ ইত্যাদি) পুনরুদ্ধার পুরোপুরি না হলেও বহুলাংশে সম্ভব।

জাতিসংঘ মনে করছে, এই দশকে (২০২১-২০৩০) পৃথিবীর ৩৫০ মিলিয়ন অধঃপতিত ভূমি ও জলজ প্রতিবেশ পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ৯ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের বাস্তুতন্ত্র পরিষেবার উৎপাদন এবং একই সঙ্গে ১৩-২৬ গিগাটন গ্রিনহাউস গ্যাস বায়ুমণ্ডল থেকে দূরীভূত করা সম্ভব। বাংলাদেশও এই ঘোষণার বাইরে নয়, কেননা আমরা জাতিসংঘের সদস্য। প্রশ্ন হচ্ছে যেখানে রাজনৈতিক সংস্কৃতি সামাজিক-বাস্তুবিদ্যার সংস্কৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করে, সেখানে কি আদৌ বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার সম্ভব? একটা উদাহরণ দেওয়া যাক।

দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩২ শতাংশ মানুষ ঢাকায় বাস করে। মোহনীয় প্রাকৃতিক পরিবেশের এমন উদাহরণ পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে ছিল কি না জানা নেই, বাস্তুতন্ত্রের সব উপাদান ঢাকায় একদা বিদ্যমান ছিল। গুলিস্তান পর্যন্ত ছিল এর সীমা। নগরের বিভিন্ন স্থানের নাম (যেমন হাতিরপুল) দেখে এখনো বোঝা যায় শহরটি একসময় বনভূমি, নদীনালা, বন্য সম্পদ, খাল-বিল, স্বাদু পানির মাছ এবং জীববৈচিত্র্যে ভরপুর ছিল।

এখনো মনে পড়ে, ছোটবেলায় স্কুল ছুটির সময় আশুলিয়ায় নানার বাড়িতে গিয়ে মাছ ধরার কথা, উৎসব ও বিভিন্ন পার্বণের কথা। প্রকৃতি প্রদত্ত সম্পদ আমরা বিনষ্ট করে তৈরি করেছি কংক্রিটের জঙ্গল। জঙ্গলটা যদি পরিকল্পনা মোতাবেক হতো, তাও কথা! পরিবেশ ও প্রতিবেশের ওপর এমন খবরদারি বিশ্বের অন্য কোনো নগরে আছে কি না, জানা নেই। ফলে অল্প বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। আন্তর্জাতিক এক গবেষণায় দেখা যায়, নগরে উষ্ণতা দুই দশকে উচ্চ হারে বৃদ্ধির দরুন জীবনযাপন অসহনীয় হয়ে উঠছে, জনস্বাস্থ্য হুমকির সম্মুখীন।

এক বিল্ডিংয়ে বাস করছে পুরো দু-তিন গ্রামের মানুষ, ফলে জন-উপযোগমূলক সেবা পেতে নগরবাসী নাকাল। কংক্রিটের নগরীতে সব সমস্যার মূলে হচ্ছে নগরটি নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে ভয়াবহ সমন্বয়হীনতা এবং দুর্বল পারিবেশিক শাসনব্যবস্থা। বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় দেখা যায়, বিশাল জনগোষ্ঠীর এই নগরে সবুজের পরিমাণ মোট ভূমির ২ দশমিক ৪১ শতাংশ অথচ ঢাকার ফুসফুস নামে খ্যাত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উন্নয়নের নামে কিছুদিন পরপর যা হয়, তাতে পারিবেশিক শাসনব্যবস্থার দৈন্য যে তলানিতে, সেটা কি ভুল বলা হবে?

খণ্ডিত পরিকল্পনায় নগরটি চলে বলে জলাবদ্ধতাকালে বা অন্যান্য আপত্কালে কর্তাব্যক্তিদের গালভরা বক্তৃতা ও উন্নয়নের রঙিন খোয়াব চোখে পড়ার মতো। আমাদের দেশসহ বিশ্বের অনেক দেশে যেকোনো ইস্যুকে জলবায়ু পরিবর্তন নামক প্রপঞ্চের মাধ্যমে মুড়িয়ে দিতে অনেকে আরাম বোধ করে, কিন্তু গবেষণায় দেখা যায় স্থানীয় জলবায়ু বা ঢাকার ক্ষেত্রে পারিবেশিক সমস্যাগুলোর মূল হচ্ছে ভঙ্গুর পারিবেশিক শাসনব্যবস্থা, খণ্ডিত ও অপরিকল্পিত নগরায়ণ।

দেশের অন্যত্র কোনো সমস্যা হলেই প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ঢাকামুখী হয়ে পড়ে। কিন্তু ঢাকার অধিবাসীদের যাওয়ার জায়গা নেই, সব আপদ-বিপদের মধ্যেও ঢাকা তাদের প্রিয় আবাসস্থল। এখন কথা হচ্ছে, বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দশকে আমরা কি পারব ঢাকা নগরের হারিয়ে যাওয়া প্রাতিবেশিক ব্যবস্থাকে ফিরিয়ে আনতে? ভিন্নমত থাকতে পারে, তবে আমি মনে করি সময় এখনো ফুরিয়ে যায়নি। তবে হ্যাঁ, একবারে আদি অবস্থায় হয়তো সম্ভব নয়, তবে প্রতিবেশের উন্নয়ন বহুলাংশে সম্ভব। কীভাবে?

ঢাকা মহানগরের বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধারে দুটি বিষয়ে বিনিয়োগ দরকার এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত সবুজ ও নীল অবকাঠামোতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ। জাতিসংঘের একুশ শতকের সবুজ অর্থনীতির আলোচ্যসূচির অন্যতম একটা হচ্ছে সবুজ অবকাঠামো বিনির্মাণ, যা নগরকে নতুন রূপ দেবে ফলে আর্থিক এবং অ-আর্থিক দুই উপকারই আসবে।

যেমন নগরে সবুজ ও নীল অবকাঠামোর বিনিয়োগে বাস্তুতন্ত্রের সেবাগুলো হলো: (ক) মাইক্রো-ক্লাইমেট নিয়ন্ত্রণ (এনার্জি বাঁচানো, নগরীয় তাপমাত্রা হ্রাস এবং কার্বন নিঃসরণ রোধ); (খ) পানির প্রবিধান (বনভূমি বা নগর বন অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত অভিগ্রহণে অত্যন্ত কার্যকর); (গ) বহুবিধ উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের আবাসস্থল তৈরি; (ঘ) পারিবেশিক দূষণ ও জনস্বাস্থ্য (মানসিক ও শারীরিক সুরক্ষা, বায়ুর মানোন্নয়ন); এবং (ঙ) সাংস্কৃতিক সেবা (মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে জীববৈচিত্র্যের ভূমিকা প্রমাণিত, বা ইকো-ডিজাইন)। অ-আর্থিক সেবাগুলোর মধ্যে নগরবাসীর দীর্ঘায়ু, আবেগ-অনুভূতি, দুর্যোগের ঝুঁকি প্রশমন উল্লেখযোগ্য।

দ্বিতীয় বিনিয়োগটি হতে হবে পারিবেশিক সুশাসনে। যেকোনো বিষয়ে সুশাসন যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তার একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ফ্রেঞ্চ শাসক নেপোলিয়ান বোনাপার্ট ওয়াটারলুর যুদ্ধে হেরে গেলে বন্দী করে তাঁকে ব্রিটেনে নিয়ে আসা হয় এবং নির্বাসনে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। অস্ট্রিয়ার রাজা নির্বাসনের কথা জানতে পেরে নেপোলিয়ানকে অস্ট্রিয়া বেছে নিতে বললে তিনি তাতে রাজি হননি। নেপোলিয়ান কিছুদিন ভেবে ব্রিটেনের অধীনে সেন্ট হেলেনা দ্বীপে নির্বাসনে সম্মত হন এবং ১৮২১ সালে এখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। পরবর্তী সময়ে তিনি কেন অস্ট্রিয়ায় যেতে রাজি হননি জিজ্ঞাসা করলে নেপোলিয়ান বলেন, ব্রিটেনের শাসনব্যবস্থা ভালো, তাই তিনি অস্ট্রিয়ায় যাননি। তিনি ভেবেছিলেন সুশাসনের আওতায় নির্বাসনে থাকা শ্রেয়।

প্রশ্ন হতে পারে আমরা তো আর ব্রিটেন না, হ্যাঁ সেটা ঠিক। কিন্তু ঢাকায় কি হাতিরঝিল হয়নি? বসুন্ধরায় বর্তমানে কি লেক করা হচ্ছে না? রাষ্ট্র চাইলে পারে না এমন কিছু নেই, দরকার শুধু রাজনৈতিক সদিচ্ছা। সুতরাং, স্থানীয় বা ঢাকার ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনকে দোষারোপ না করে বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস রোধে মানুষের খবরদারি নিয়ন্ত্রণ জরুরি। তবে সুশাসন একমাত্র ও অনন্য সমাধান।

আশরাফ দেওয়ান অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব আর্থ অ্যান্ড প্ল্যানেটারি সায়েন্সের গবেষক।