যাদবের ভাগ্য অনিশ্চিত

কুলদীপ নায়ার
কুলদীপ নায়ার

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কোনো কিছুই যেন কাজ করে না। পাকিস্তানি কারাগারে আটক ভারতীয় বন্দী কুলভূষণ যাদবের সঙ্গে তাঁর স্ত্রী ও সন্তানের বৈঠক দুই দেশের বোঝাপড়ায় উন্নতির অনুঘটক হিসেবে কাজ করতে পারত। কিন্তু উভয় দেশের আমলাতন্ত্র এতটা বিষিয়ে গেছে যে তারা সম্পর্কোন্নয়নের যেকোনো চেষ্টা পণ্ড করে দেয়।

২১ মাস কারাগারে থাকার পর আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসহ আরও অনেকের চাপে কুলভূষণ যাদবের পরিবারবর্গকে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয়। কিন্তু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ এটা নিশ্চিত করেছে যে তাদের মধ্যকার বৈঠকটা যেন ভালো না হয়।

পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের কোনো একজনের মাথায় এমন বুদ্ধি এল যে তারা কুলভূষণ ও তাঁর পরিবারের মধ্যে একটি কাচের দেয়াল দাঁড় করিয়ে দিলেন। এমনকি তাঁর স্ত্রীর গলার মঙ্গলসূত্র, যা বিবাহিত নারীদের প্রতীক, হাতের বালা ও বিন্দি খুলে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। যদিও মঙ্গলসূত্র ও বালা কোনোভাবেই অস্ত্র হতে পারে না। এসব বিবাহিত হিন্দু নারীদের প্রতীক।

পাকিস্তানের আমলারা এটা জানেন, কারণ এই কদিন আগে পর্যন্ত তঁারাও এই ব্যবস্থার অঙ্গ ছিলেন। তঁাদের এই কাজ ভারতের প্রতি বৈরিতার বহিঃপ্রকাশ। কেউ তঁাদের এ রকম আচরণ করতে বলেনি।

দেশভাগের পর তঁাদের মধ্যে এই অভ্যাস গড়ে ওঠে। হেগের আন্তর্জাতিক আদালত কুলভূষণের মৃত্যুদণ্ডের রায় স্থগিত করেছেন, পাকিস্তানি আমলারা হয়তো রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে আছেন।

২০১৬ সালের মার্চ মাসে বেলুচিস্তানে ইতস্তত ঘোরাফেরা করার সময় গোয়েন্দাগিরি ও সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে কুলভূষণ যাদবকে গ্রেপ্তার করা হয়। অল্প কিছুদিন পর এক সামরিক আদালত গোয়েন্দাগিরি ও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেন। ভারত বলার চেষ্টা করেছে যে তাঁকে ইরানের চাবাহার বন্দর থেকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে আর তাঁর বিচারটা এক প্রহসন।

ভারত আন্তর্জাতিক আদালতে আবেদন করে বলেছে, যাদবের এই রায় ‘বিচারের গুরুতর ভুল প্রয়োগ’। কারণ, ভারতীয় কূটনীতিকদের তাঁর কাছে যেতে দেওয়া হয়নি। তাঁকে নিজের আইনজীবী ঠিক করতেও দেওয়া হয়নি।

নয়াদিল্লির যুক্তি হচ্ছে পাকিস্তান এ ক্ষেত্রে যে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে, তা ১৯৬৩ সালের কনস্যুলার সম্পর্কজনিত ভিয়েনা কনভেনশনের লঙ্ঘন।

যদিও পাকিস্তান দাবি করেছে, এটা যেহেতু ‘জাতীয় নিরাপত্তার’ ব্যাপার, তাই আন্তর্জাতিক আদালতের এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার এখতিয়ার নেই। আর তাঁর ফাঁসি আসন্ন নয় বলে আন্তর্জাতিক আদালতের তা স্থগিত করার নির্দেশ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা ছিল না।

এর জবাবে আন্তর্জাতিক আদালত বলেছেন, এ ব্যাপারে ‘আপাতদৃষ্টিতে তাঁর এখতিয়ার আছে’। কারণ, ইসলামাবাদ যাদবের গ্রেপ্তারের ব্যাপারে ‘প্রয়োজনীয় কূটনৈতিক নোটিশ দিতে পারেনি’ এবং ‘অভিযোগ আছে, তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেওয়া হয়নি’—এসব ভিয়েনা কনভেনশনের আওতায় পড়ে।

হেগে অবস্থিত জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালতের সভাপতি রনি আব্রাহাম বলেছেন, ‘পাকিস্তানের হাতে যত ব্যবস্থা আছে, তাকে এর সবগুলো প্রয়োগ করে এটা নিশ্চিত করতে হবে, যেন যাদবের ফাঁসি না হয়। আর এই আদেশ বাস্তবায়নে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সে ব্যাপারে আদালতকে অবহিত করতে হবে।’

১২ জন বিচারক সর্বসম্মতিক্রমে যে ‘সাময়িক পদক্ষেপ’ নিয়েছেন, তাতে বলা হয়েছে যে চূড়ান্ত রায় না দেওয়া পর্যন্ত তাঁকে ‘বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত’ করতে হবে। যাদবের ব্যাপারে ভারত ও পাকিস্তান নিজেদের যুক্তি-তর্ক পেশ করার পর এই আদেশ এসেছে। এতে দুই দেশের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে আরও উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে।

পাকিস্তানের গণতন্ত্র একভাবে টিকে আছে। দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ভালোই ছিল। সম্ভবত অটল বিহারি বাজপেয়ির সঙ্গে নৈকট্যের কথা তিনি এখনো স্মরণ করেন। জানা যায়, তাঁরা দুজন সম্ভবত কাশ্মীর সমস্যার সমাধান করে ফেলেছিলেন। তবে এই সূত্র কখনো জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি।

শেষমেশ সবকিছু দুই দেশের সম্পর্কের ওপর নির্ভর করে। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের বাতাবরণে কাশ্মীরের সমস্যা সত্ত্বেও তাঁরা দুজন এগিয়ে যেতে পারতেন। এই সম্পর্ক বন্ধুত্বসুলভ হলে যাদবের সঙ্গে তাঁর পরিবারের মিলন উদ্‌যাপনের বিষয় হতো। সে ক্ষেত্রে পাকিস্তান হয়তো নিরাপত্তার অজুহাত দিত না আর যাদবের পরিবারের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হতো। এমনকি ওই সময় যাদবের মাকে তাঁর মাতৃভাষা মারাঠিতে কথা বলতে দেওয়া হয়নি, যদিও সেই পরিস্থিতিতে মাতৃভাষায় কথা বলাই স্বাভাবিক।

পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শহীদ খাকান আব্বাসিও হয়তো এটা অস্বীকার করবেন না, যিনি নাকি ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছেন। এখানে হয়তো পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দেশটির সুপ্রিম কোর্ট নওয়াজ শরিফের বিরুদ্ধে রায় দেওয়ায় সেখানে রাজনীতিকদের ভাবমূর্তি নিম্নমুখী। তাঁরা নিজেদের পায়ের নিচের মাটি হারিয়েছেন।

কিন্তু ভারতের পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। এখানে এক নরেন্দ্র মোদি প্রশাসনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, যদিও তাঁর সিদ্ধান্তে স্বৈরাচারী মনোভাব আছে। তাঁর সরকারকে এটা দেখতে হবে যে যাদবের ভাগ্য দুই রাষ্ট্রের ঝগড়া-বিবাদের মধ্যে ছেড়ে দেওয়া যেন না হয়। নয়াদিল্লিকে বিকল্প পথে হস্তক্ষেপের পথ খুঁজতে হবে।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে মোদির লক্ষ্য হচ্ছে পেছনের দরজা দিয়ে হিন্দুত্ববাদ নিয়ে আসা এবং যাদবের মতো মানুষের সমস্যা নিয়ে সময় ব্যয় করার খুব কম সময়ই তাঁর হাতে আছে।

পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য ভারত আরও একটি শর্ত দিয়েছে। ইসলামাবাদকে আশ্বস্ত করতে হবে যে পাকিস্তান সন্ত্রাসের আশ্রয়দাতা হবে না। সব অংশীদার ইসলামাবাদের কাছে বাধিত নয় বলে এটা বাস্তবায়ন করা কঠিন। বেলুচিস্তান পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চাইছে। আর জানা যায়, সেখান থেকেই যাদবকে গ্রেপ্তার করা হয়।

নয়াদিল্লি অনেকবার আশ্বস্ত করেছে যে তারা ভারতের মতো পাকিস্তানের অখণ্ডতার ব্যাপারটাও ভাবে। হাফিজ মোহাম্মদ সাঈদকে যখন জাতিসংঘ সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যা দেয়, তখন এটা পরিষ্কার যে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের রাশ টেনে ধরার ক্ষেত্রে পাকিস্তান অসহায়। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের যেকোনো চেষ্টার ক্ষেত্রে মুম্বাই হামলার হোতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা করতে হবে।

কিন্তু ইসলামাবাদের এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার শক্তি নেই। আর দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি এমন যে কুলভূষণ যাদবের ভাগ্যে কী আছে তা বলা মুশকিল।

অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন

কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় সাংবাদিক।