যারা যুদ্ধ বাধিয়েছে শরণার্থীদের দায় তাদেরই

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর যুদ্ধে ইউরোপ ও আমেরিকার হাত রয়েছে
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর যুদ্ধে ইউরোপ ও আমেরিকার হাত রয়েছে

চলতি বছর এ পর্যন্ত ‘প্রায় আড়াই লাখ মানুষ ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে গিয়েছে’। ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশনকে উদ্ধৃত করে এ খবর দিয়েছে আল-জাজিরার ইনসাইড স্টোরি। পরিস্থিতিটা হতাশাব্যঞ্জক। না, শুধু শরণার্থীদের সংখ্যা বাড়ার জন্য নয়, ইউরোপ যে সংকটের মূল কারণটা আমলে নিচ্ছে না, সেটাও এই হতাশার একটি কারণ।
‘ইনসাইড স্টোরি’তে যে অতিথিরা এসেছিলেন, তাঁরা সবাই খুবই স্পষ্টভাষী ও জানাশোনা মানুষ। কিন্তু সেই তিনজন অতিথির একজনও ক্ষণিকের জন্য বললেন না যে এই শরণার্থী-সংকটের ব্যাপারে ইউরোপের নৈতিক দায়িত্ব আছে, কারণ তারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট ঘনীভূত করেছে। বস্তুত, অনুষ্ঠানের উপস্থাপক একটি যৌক্তিক প্রশ্ন তুলেছিলেন, শরণার্থীদের ব্যাপারে ইউরোপের এই নির্লিপ্ততার পেছনে তাদের সুগভীর বর্ণবাদ দায়ী কি না। কিন্তু একজন অতিথি এই কথাকে অসত্য বলে উড়িয়ে দেন।
ব্রিটেনের দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান-এর একটি নিবন্ধে এলি মায়ে ও’হাগান সিরিয়া সংকটের কারণ-বিষয়ক একটি পুরোনো যুক্তির সাফাই গেয়েছেন। বলা হতো যে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের কারণ হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন, তিনি এই যুক্তির পক্ষেই বলেছেন। নিবন্ধটির সারসংক্ষেপ এ রকম: ‘ভূমধ্যসাগর ও আরব বসন্তে শরণার্থীদের মারা যাওয়ার অভিন্ন কারণ কী? বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে সৃষ্ট খাদ্যস্বল্পতা।’
অর্থাৎ পশ্চিমা বিশ্ব যে মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধের অন্যতম কারণ, সে বিষয়টি তিনি এড়িয়ে গেছেন। হ্যাঁ, সিরিয়ার যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে ‘শরণার্থীদের করুণ মৃত্যুর’ একটি কারণ হচ্ছে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি, যুদ্ধের আগে এ কারণে সিরিয়ার সমাজে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু আজ যে শরণার্থীরা ভাসতে ভাসতে গ্রিসের উপকূলে হাজির হচ্ছে, তারা আফগানিস্তান, ইরাক ও সিরিয়া থেকে এসেছে—সেই বুদ্ধিজীবীরা কীভাবে এই সত্যটির প্রতি উদাসীন থাকেন, তা দেখে সত্যিই ধাঁধায় পড়ে যেতে হয়।
কেউ প্রশ্ন তুলতে পারে, যুদ্ধ ছাড়া এই দেশগুলোর মধ্যে আর কী মিল দেখা যায়? এই দেশগুলোর যুদ্ধে ইউরোপ ও আমেরিকার হাত রয়েছে, এই বাস্তবতাটা একরকম অলক্ষ্যেই থেকে যায়। আরও একটি ব্যাপার দৃষ্টির বাইরে থেকে যায়: যে শরণার্থীরা বিপৎসংকুল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ইতালির উপকূলে যাচ্ছে, তারা আসছে লিবিয়া থেকে। এই সংকটের সঙ্গে ইতালির সম্পর্কের ব্যাপারটা বেশ কৌতূহলোদ্দীপক ও মর্মভেদীরূপে তাৎপর্যপূর্ণ।
২০১১ সালের ২৬ এপ্রিল ইতালির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বেরলুসকোনি ও তৎকালীন ফরাসি প্রেসিডেন্ট নিকোলা সারকোজির মধ্যে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, যেটাকে অশুভ তৎপরতা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। রোমে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচিত বিষয়টি ছিল, উত্তর আফ্রিকার অভিবাসীদের কীভাবে মোকাবিলা করা হবে। সারকোজির ওপর ডানপন্থীদের চাপ ছিল, উত্তর আফ্রিকার (তিউনিসিয়া বিদ্রোহের কারণে এটা শুরু হয়েছিল) অভিবাসীদের ঠেকাতে হবে। তিনি ইতালির সুবিধাবাদী এক নেতার সঙ্গে একটা সমঝোতায় যেতে চেয়েছিলেন। ইতালির বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, দেশটি অভিবাসীদের তার সীমান্ত ব্যবহার করার সুযোগ দিচ্ছে, সেই সীমান্ত দিয়ে অভিবাসীরা ইউরোপের অন্যান্য জায়গায় যাচ্ছে। এভাবে সীমান্ত নিয়ন্ত্রণে ফরাসি উদ্যোগে ইতালির সমর্থনের বিনিময়ে ফ্রান্স কিছু ফরাসি ও ইতালীয় কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিতর্কের অবসান ঘটাবে, এমন কথাই হয়েছিল। তদুপরি ইতালির অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকার মারিও দ্রাঘি ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনে দাঁড়ালে ইতালি ফ্রান্সের সমর্থন পাবে।
ফরাসি এজেন্ডার আরেকটি বিষয় ছিল লিবিয়ার যুদ্ধে ইতালির সক্রিয় অংশগ্রহণ। শুরুতে এর নেতৃত্ব দিয়েছে ফ্রান্স, ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র, পরবর্তীকালে এই যুদ্ধের নেতৃত্ব যায় ন্যাটোর হাতে। প্রথম দিকে বেরলুসকোনি যুদ্ধে অংশ নিতে কিছুটা ইতস্তত করেছেন, সেটা কোনো নৈতিক কারণে নয়। তিনি মনে করেছিলেন, এই যুদ্ধ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ২০১১ সালের ১৭ মার্চ গৃহীত ১৯৭৩ নম্বর প্রস্তাবের ইচ্ছাকৃত ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে শুরু করা হয়েছে। ওই প্রস্তাবে বেসামরিক মানুষকে রক্ষা করার প্রসঙ্গে বলা হয়েছিল, ‘তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি’, ‘নো ফ্লাই জোন’ প্রতিষ্ঠাসহ সব ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে, বিদেশি শক্তির দখলদারি ছাড়া। এই প্রস্তাবে যা বলা হয়েছে, ওই যুদ্ধে তার চেয়ে ভিন্ন কিছু লক্ষ্যই অর্জিত হয়েছিল: ক্ষমতার পটপরিবর্তন, লিবিয়ার নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে আটক ও হত্যা, হাজার হাজার বেসামরিক মানুষের হত্যায় রক্তগঙ্গা বয়ে যাওয়া, যারা এখনো মরছে, তারপর থেকে লিবিয়ায় বিশৃঙ্খলা ও গৃহযুদ্ধ চলছেই। কিন্তু বেরলুসকোনির মত পরিবর্তনের আসল কারণ ছিল তেল ও গ্যাস, এর সঙ্গে সাধারণ জ্ঞান ও নৈতিক অখণ্ডতার তেমন সম্পর্ক নেই। তিনি এক বিপজ্জনক পথে হাঁটছিলেন। ইতালির এক-চতুর্থাংশ তেল ও ১০ ভাগ গ্যাস আসত লিবিয়া থেকে। ফলে, লিবিয়া টালমাটাল হয়ে পড়লে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ইতালির তেল-গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যেতে পারে, সে সময় ইতালি এক গভীর অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত ছিল।
ফ্রান্স তার কথা রেখেছিল, দ্রাঘি ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন, আর ইতালিও যুদ্ধে গিয়েছিল। হ্যাঁ, দুটি দেশই উপকৃত হয়েছে, কিন্তু লিবিয়া ধ্বংস হয়ে গেছে। এমনকি গ্রিসও (তুরস্ক হয়ে আসা সিরিয়া, ইরাক ও আফগানিস্তানের শরণার্থীদের ব্যাপারে তারা মানবিক আইনের তোয়াক্কা একরকম করেইনি) ২০১১ সালে লিবিয়ার যুদ্ধে তেল-জল জুগিয়েছে, ২০০৩ সালের মার্কিন নেতৃত্বাধীন ইরাক যুদ্ধেও তারা সমর্থন দিয়েছিল।
একদিকে যুদ্ধ, অন্যদিকে ক্রমবর্ধমান শরণার্থী, অভিবাসী ও আশ্রয়প্রত্যাশীদের সংকট—এ দুয়ের সম্পর্ককে অতিরঞ্জিত করা যাবে না। এটা একই সঙ্গে বিপরীতধর্মী ও বিয়োগান্ত ব্যাপার যে এই হাজার হাজার শরণার্থী সেসব ইউরোপীয় ও ন্যাটো দেশেই আশ্রয় চাইছে, যে দেশগুলো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তাদের দেশগুলোকে ধ্বংস করেছে বা অস্থিতিশীল করে তুলেছে। যে দেশগুলো এই যুদ্ধ লাগিয়েছে, তাদেরই এর নৈতিক দায়িত্বের জন্য কাঠগড়ায় দাঁড় করানো দরকার। লিবিয়া তো বিশৃঙ্খলায় ডুবে যাচ্ছে, ওদিকে সিরিয়া ও ইরাক পাগলাগারদে পরিণত হয়েছে। ফ্রান্স ও ব্রিটেন শরণার্থী সমস্যা নিয়ে এমনভাবে আলোচনা করে, যেন এই মানুষেরা পঙ্গপাল, নিরীহ মানুষ নয়, যারা মার্কিন-ইউরোপীয় যুদ্ধের কারণে ভুক্তভোগী হয়েছে।
যুদ্ধের বীভৎসতা ও ধ্বংসের কারণে বেসামরিক নাগরিকদের জীবন জেরবার হয়ে যায়। যারা যুদ্ধ লাগায়, তাদের অন্তত এসব মানুষের কিছু নৈতিক দায়িত্ব নেওয়া উচিত।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন; রামজি বারুদ ডট নেট থেকে নেওয়া
ড. রামজি বারুদ: মার্কিন-আরব সাংবাদিক ও লেখক।