যুক্তরাষ্ট্রের করপোরেশনগুলো কি আইনের ঊর্ধ্বে

আধুনিক অর্থনীতির প্রতিষ্ঠাতা অ্যাডাম স্মিথ যুক্তি দিয়েছিলেন, ব্যক্তিগত স্বার্থ, তথা মুনাফা সব সময়ই সর্বসাধারণের মঙ্গলকে ত্বরান্বিত করে। তাঁর এই কথা কিছু ক্ষেত্রে সত্য হতে পারে, কিন্তু সব সময় সব ক্ষেত্রে কিছুতেই নয়। যেমন বলা যায়, ব্যাংকগুলোর মুনাফা অর্জনের বেপরোয়া নেশা ২০০৮ সালে বৈশ্বিক আর্থিক সংকট ডেকে এনেছিল। পারডিউ এবং অন্য ওষুধ কোম্পানিগুলোর মুনাফার লোভ বিশ্ববাসীকে অপিওইড সংকটে ফেলে দিয়েছিল। স্পেনের গৃহযুদ্ধে জেনারেল ফ্রাঙ্কোর সরকারকে গ্যাস কোম্পানি টেক্সাকো সমর্থন দেওয়ায় ফ্রাঙ্কো সেই যুদ্ধে জিতেছিলেন এবং এর মধ্য দিয়ে সেখানে ফ্যাসিস্ট শাসন কায়েম হয়েছিল।

এই ধরনের উদাহরণ দিতে থাকলে তালিকা লম্বা হবে। কিন্তু এর মধ্যে লোভী করপোরেশনগুলোর সবচেয়ে নিকৃষ্ট আচরণ হচ্ছে শিশুদের দাস বানিয়ে তাদের দিয়ে জোর করিয়ে কাজ করানো।

সারা বিশ্বের চকলেটপ্রেমীরা হয়তো জানেন না, তাঁদের এই আনন্দদায়ক আস্বাদনের জোগান দিয়ে থাকে প্রধানত শিশু শ্রমদাসেরা।

নেসলে, কারগিল এবং অন্য খাদ্য কোম্পানিগুলো তাদের বিরুদ্ধে ওঠা এই ভয়ানক অভিযোগের জবাব প্রকাশ্য আদালতে বরাবরই এড়িয়ে গেছে। এসব কোম্পানি ও তাদের সহযোগীদের সদর দপ্তর হলো যুক্তরাষ্ট্রে। আর এর সুবাদেই তারা আদালতে যুক্তি দিতে পেরেছে, সুদূর আফ্রিকায় শিশুদের দাস হিসেবে ব্যবহার করে চকলেট আহরণের দায় তাদের ওপর বর্তায় না। তারা ভালো করেই জানে, শিশুদের জোর করে কাজ করানো ওই দেশগুলোতে শিশুশ্রম বন্ধের কার্যকর কোনো আইনই নেই।

উপরন্তু, বাইরের দেশে যদিও কখনো কখনো এসব কোম্পানির বিরুদ্ধে আদালতের রায় গেছে, কিন্তু তার জন্য তাদের খুব কমই ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছে। আইনি বাধার মুখে পড়লে খুব বেশি হলে তারা তাদের পণ্য উৎপাদনের জায়গা বদল করেছে।

এ বছর যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টে দায়ের করা একটি মামলায় এই বিষয়গুলো উঠে এসেছে। মালির ছয়জন নাগরিক নেসলে ইউএসএ এবং কারগিল ইনকরপোরেশনের বিরুদ্ধে মামলা করে অভিযোগ করেন, শৈশবে তাঁদের নিজের দেশ মালিতে দাস হিসেবে কাজ করানো হতো। যারা তাঁদের দিয়ে জোর করে করাত, তারা ওই দুটি মার্কিন কোম্পানির স্থানীয় সরবরাহকারী ছিলেন। তাঁরা মামলা করে এ জন্য কোম্পানি দুটির কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করেছিলেন। আদালত তাঁদের অভিযোগ খারিজ করে দিয়েছেন। আদালত রায়ে বলেছেন, বাইরের কোনো দেশে কাউকে নির্যাতন করা হলে আমেরিকান প্রতিষ্ঠান তার দায় নিতে পারে না। আদালত বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের ভূখণ্ডে কোনো ঘটনার বিষয়ে রায় দেওয়ার এখতিয়ার আদালতের নেই; কারণ, এই এখতিয়ার অর্জনে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের ভূখণ্ডে মার্কিন আইন কার্যকর থাকতে হবে।

আদালতের এই রায় সমীচীন হয়নি। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র সব সময়ই তার ভূখণ্ডের বাইরে সক্রিয় থেকেছে। যেমন ইরানের ওপর আরোপিত অবরোধ বিদেশি কোনো কোম্পানি লঙ্ঘন করে ইরানের কোনো কোম্পানির সঙ্গে ব্যবসা করলেই যুক্তরাষ্ট্র ওই সব বিদেশি কোম্পানিকে নানাভাবে সাজা দিয়ে থাকে। এখানে ঘটনার ভিন্নতা হলো, যে কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে বিদেশের মাটিতে পরোক্ষভাবে শিশুপীড়নের অভিযোগ উঠেছে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি। এখানে আদালত ওই কোম্পানিগুলোর পক্ষ নিয়েছেন এবং বাইরের দেশে ওই কোম্পানিগুলোর কার্যক্রম পরিচালনায় কী কী বেআইনি বিষয় থাকতে পারে, তা নিয়ে আশ্চর্যজনকভাবে আদালত কোনো প্রশ্ন তোলেননি। যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে যদি তাদের বিচার না হয়, তাহলে পৃথিবীর আর কোন আদালতে বিচার হওয়া সম্ভব?

কোনো জবাবদিহি না থাকার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের এই সব করপোরেশন বাইরের দেশে তাদের নিষ্ঠুর আচরণ বাধাহীনভাবে চালিয়ে যায়। সর্বনিম্ন খরচ করে সুপারশপের শেলফ চকলেট দিয়ে ভরিয়ে ফেলতে তারা আফ্রিকার গরিব দেশগুলোতে হাত বাড়ায়। অল্প পয়সা খরচ করলেই সেখানকার এমন অনেক স্থানীয় সরবরাহকারী পেয়ে যায়, যারা শিশুদের স্রেফ ক্রীতদাস বানিয়ে চকলেট উৎপাদনের কাজ করায়। যখনই এ নিয়ে কেউ অভিযোগ তোলে, তখনই মার্কিন কোম্পানিগুলো তার দায় নিতে অস্বীকৃতি জানায়।

তাহলে এই শিশুদের কে রক্ষা করবে? এ ক্ষেত্রে আমেরিকার মূল মূল্যবোধ মানবাধিকারই সবচেয়ে বড় সুরক্ষা হিসেবে কাজ করতে পারে।

অক্সফামের সঙ্গে আমরা যৌথভাবে সুপ্রিম কোর্টে একটি মত পেশ করেছি এবং সেখানে বলেছি, যেকোনো আমেরিকান প্রতিষ্ঠানের মানবাধিকার ইস্যুতে জবাবদিহি নিশ্চিত করা যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক স্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়।

কিন্তু নেসলে ও কারগিলের মতো কোম্পানি স্বল্পমেয়াদি মুনাফার জন্য সেই মূল্যবোধ থেকে সরে আছে। এই অবস্থায় এসব কোম্পানিকে যুক্তরাষ্ট্রের সেই মূল্যবোধের কথা স্মরণ করিয়ে তাদের আইনি বাধ্যবাধকতার মধ্যে নিয়ে আসা দরকার।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

জোসেফ ই. স্টিগলিৎস অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী ও কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এবং

জিওফ্রে হিল কলাম্বিয়া বিজনেস স্কুলের সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজ বিষয়ের অধ্যাপক