যুক্তরাষ্ট্রের দোষ নেই!

সামান্থা পাওয়ার জাতিসংঘে নিজেকে কিছুটা ‘লজ্জা’ দিলেন। জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত সামান্থা পাওয়ার রাশিয়া, সিরিয়া ও ইরানকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘বেসামরিক লোকজনের সঙ্গে কি বর্বর আচরণ করা হয়নি, শিশুদের হত্যা করা হয়নি? যার কারণে আপনারা বিব্রত হতে পারেন, আপনাদের শরীর ভয়ে কাঁটা দিয়ে উঠতে পারে?’। তিনি হালাবজা, রুয়ান্ডা ও স্রেব্রেনিৎসা সম্পর্কে বলেছেন, আর তিনি এখন ‘আলেপ্পো’ সম্পর্কে বলছেন।
ব্যাপারটা অদ্ভুত। বিষয়টা হচ্ছে, সামান্থা যখন আলেপ্পোয় ‘বেসামরিক লোকজনের বিরুদ্ধে বর্বরতার’ কথা বলেন, তখন আমার সাবরা ও শাতিলা শরণার্থীশিবিরে মৃতদেহের স্তূপ পেরিয়ে এগোনোর কথা মনে পড়ে যায়। ১৯৮২ সালে বৈরুতের এই শিবিরে ইসরায়েলের বন্ধুস্থানীয় লেবানিজ বাহিনীর সদস্যরা ফিলিস্তিনের বেসামরিক মানুষকে কতল করেছিল, যেখানে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখেছে, যারা মধ্যপ্রাচ্যে ওয়াশিংটনের সবচেয়ে শক্তিশালী বন্ধু। কিন্তু সামান্থা এসব ঘটনা উল্লেখ করেননি। সম্ভবত, সেদিন খুব বেশি ফিলিস্তিনি মারা যায়নি, তাই না? মাত্র ১ হাজার ৭০০, যাদের মধ্যে নারী ও শিশুও ছিল। ওদিকে হালাবজায় মারা গিয়েছিল পাঁচ হাজার মানুষ। কিন্তু সাবরা ও শাতিলার ঘটনায় তখন আমার শরীর ‘শিউরে উঠেছিল’।
এরপর যুক্তরাষ্ট্রের সেই দানবীয় ইরাক অভিযানের কথা স্মরণ করতে পারি। সম্ভবত, সেই যুদ্ধে পাঁচ লাখ লোক মারা গিয়েছিল। এক হিসাব অনুসারে, রুয়ান্ডায়ও পাঁচ লাখ লোক মারা গিয়েছিল, যেটা স্রেব্রেনিৎসায় মারা যাওয়া নয় হাজার লোকের চেয়ে অনেক বেশি। এ কথা বলতে পারি, ইরাক যুদ্ধে পাঁচ লাখ লোক মারা যাওয়ার ঘটনায়ও আমি যথেষ্টই শিউরে উঠেছিলাম, অন্যদিকে ইরাক ও আফগানিস্তানে সিআইএর জিজ্ঞাসাবাদ কেন্দ্রের কথা আর না-ইবা বললাম। এ কথা শুনেও আমি শিউরে উঠেছিলাম, যখন জানতে পারলাম, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিরীহ বন্দীদের জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য আসাদের সিরিয়ায় পাঠাতেন। সামান্থা এখন যাকে সিরিয়ার ‘গুলাগ’ বলছেন, ওয়াশিংটন বন্দীদের ঠিক সেখানেই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঠাত।
সেই হাস্যকর পুরোনো পৃথিবী। সামান্থার ওপর ঈশ্বরের আশীর্বাদ বর্ষিত হোক। তিনি গাজার কথাও মুখে আনেননি, যেখানে ইসরায়েলিরা কয়েক হাজার শিশুকে হত্যা করেছিল। ইয়েমেনের কথাও নয়, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের শিরশ্ছেদকারী বন্ধুরা এখন শিয়াদের মুখে চুনকালি মাখছে, যারা সেখানে ইতিমধ্যে চার হাজার বেসামরিক লোকজনকে হত্যা করেছে। মসুলের আইএসের গণহত্যার কথাও তিনি বলেননি। তবে সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, সামান্থা ৯/১১-এর কথাও বলেননি। নিঃসন্দেহে এটাও ছিল মানবতার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ, যেটা সামান্থার রোল কলে আসা উচিত ছিল, যেখানে ৩ হাজার ৯৯৬ জন নিরীহ লোক মারা গিয়েছিল।

>এ কথা শুনেও আমি শিউরে উঠেছিলাম, যখন জানতে পারলাম, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিরীহ বন্দীদের জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য আসাদের সিরিয়ায় পাঠাতেন

কিন্তু তিনি সেটা করেননি। এখানে ছোট একটি সমস্যা আছে। কারণ, আল-কায়েদা ৯/১১-এর রক্তস্নান ঘটিয়েছিল। সেই আল-কায়েদাই সিরিয়ায় গিয়ে আল-নুসরা এরপর জাবাত-ফতেহ আল-শাম ও পরবর্তীকালে আল-শাম নাম ধারণ করে পূর্ব আলেপ্পোয় সিরিয়া সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। হ্যাঁ, নিজ দেশে পরিচালিত সবচেয়ে মারাত্মক হামলার কথা সামান্থার মুখ দিয়ে বেরোল না, যখন সেই একই জিহাদি অপরাধী সংগঠন পূর্ব আলেপ্পোয় সিরিয়ার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করছে।
সামান্থা ৯/১১-এর মৃতদের ময়লার ভাগাড়ে ফেলে দিলেন আমাদের এটা বলার জন্য যে আলেপ্পোয় আল-কায়েদার ব্যবহারে তার শত্রুদের কেমন ‘শিউরে ওঠা’ উচিত। মসুলে আইএসের হাতে খ্রিষ্টানদের মৃত্যু ও তাদের অন্যত্র সরিয়ে দেওয়া এবং সংগঠনটির হাতে নির্যাতিত ইয়াজিদিরা যে তাদের প্রজা হয়ে গেছে—এসব কথা সামান্থার বক্তব্যে নেই। বস্তুত, তাঁর বক্তব্যে আইএসের নামও উচ্চারিত হয়নি। ব্যাপারটা যেন এমন, তারা ঠিক কাজটিই করছে। আমরা সাংবাদিকেরাও এসব মেনে নিচ্ছি।
আমরা সেই একই কথা বলে যাচ্ছি, সিরিয়ার সব শত্রুর যে পথে হাঁটা উচিত। মানে হলো, বাশার একজন একনায়ক, তিনি প্রহসনের নির্বাচনে ক্ষমতায় এসেছেন, তাঁর রক্ষীবাহিনী খুনি, তাঁর সেনাবাহিনী নির্মম; আর তাঁর কারাগার এত বর্বর যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বন্দীদের পাশবিক কায়দায় জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য সেখানে পাঠায়। আমি সে রকম একটি জিজ্ঞাসাবাদ অধিবেশন দেখেছি, যেখানে সিরিয়ার জিজ্ঞাসাবাদকারীরা শেষমেশ এ সিদ্ধান্তে আসেন যে লোকটি একেবারেই নিরীহ। কথাটা গুরুত্বসহকারে বলছি, আমার সবাই যদি সামান্থার মতো ‘শিউরে উঠতাম’, তাহলে আমরা কি সিরিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপ করতাম বা সিরিয়ার বিরোধীদের উদ্ধার করতে আসতাম?
কিন্তু পশ্চিমাদের নিষ্ঠুরতার আরও একটি অদ্ভুত উপাদান আছে, যার যোগসূত্র নিহিত আছে সামান্থা পাওয়ারের নৃশংসতার ধরন বেছে নেওয়ার মধ্যে। সাদ্দাম হোসেনের বিমানবাহিনী হালাবজার কুর্দিদের ওপর গ্যাস দিয়েছিল, যারা জাতিতে ছিল আরব। রুয়ান্ডায় গণহত্যাও চালিয়েছিল রুয়ান্ডার মানুষেরা। ওদিকে স্রেব্রেনিৎসার হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল মিলোসোভিচের রক্ষী সেনারা, যারা জাতিতে ছিল সার্ব। আমরা শুধু ‘চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখেছি’, এত কিছু সত্ত্বেও আলেপ্পোর বেলায়ও আমরা একই কাজ করতে যাচ্ছি। কিন্তু আমরা বা আমাদের মিত্রদের কেউ এই নৃশংসতা চালায়নি। সামান্থা নিরাপদ অবস্থান নিয়েছিলেন, তাই নয় কি?
কিন্তু ইউরোপে আমরা একই কাজ করছি। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ও ব্রিটিশ পার্লামেন্ট—সবাই বিলাপ করছে এই ভেবে যে আলেপ্পোর মানুষের দুঃখ-কষ্টের ব্যাপারে তারা কিছুই করতে পারেনি। তাদের কিছু করার ইচ্ছাও নেই, সে কারণে ওয়েস্ট মিনস্টারের বিতর্কে বহু আসনই ফাঁকা ছিল।
মনে হয়, কারণটা আমি জানি। কারণ, খুবই অল্প কিছু দৃষ্টান্তের মতো এবারও আমাদের আঙুল রক্তে ভেজেনি। একবারের জন্য হলেও আমরা বা আমাদের মিত্রেরা স্রেফ নির্বিকার থাকা ছাড়া আর কোনো অন্যায় করিনি, আল-নুসরাকে কাতারের সমর্থন ও অন্যান্য উপসাগরীয় বন্ধুস্থানীয় সংগঠনকে সহায়তা করা ছাড়া। হালবাজা, রুয়ান্ডা ও স্রেব্রেনিৎসার ক্ষেত্রেও একই সমস্যা। আমরা ওই কাজ করিনি, এবারও আমরা সেই কাজ করিনি।
তাই সিরিয়া, রুশ ও ইরানিদের লজ্জিত হওয়া দরকার, তাদের শিউরে ওঠা উচিত, তাই নয় কি?
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, দ্য ইনডিপেনডেন্ট থেকে নেওয়া।
রবার্ট ফিস্ক: দ্য ইনডিপেনডেন্টের মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি।