যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা–সমাচার

র‌্যাবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন বা আছেন, এ রকম সাতজন কর্মকর্তা মার্কিন সরকারের নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়েছেন। তাঁদের মধ্যে যাঁদের পাসপোর্টে মার্কিন ভিসা ছিল, তা বাতিল করা হয়েছে এবং যাঁরা ভিসার জন্য আবেদন করবেন, তাঁরা মার্কিন ভিসা পাবেন না। সাতজনের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে জানাজানি হলেও সংখ্যাটি অনেক বড় বলে কানাঘুষা আছে। প্রতিষ্ঠান হিসেবে র‍্যাবও নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়েছে। আবার র‌্যাবের সঙ্গে কখনো সম্পর্ক ছিল না সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজের। তাঁরও মার্কিন ভিসা বাতিল হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে যে প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে, তাতে বোঝা যায়, সরকার যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপে ক্ষুব্ধ।

যুক্তরাষ্ট্র এই ‘অবরোধ’ বা ‘কালোতালিকা’র কারণ হিসেবে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা বলেছে, যা বাংলাদেশ সরকার বরাবরই অস্বীকার করে এসেছে। সরকারের দাবি, মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে অভিযোগ, তা নাগরিক সংগঠন ও এনজিওগুলোর অপপ্রচার। তারা উল্টাপাল্টা তথ্য দিয়ে মার্কিন সরকারকে ভুল বুঝিয়েছে।

মানবাধিকার লঙ্ঘনের উদাহরণ হিসেবে এসেছে ‘গুম’-এর বিষয়টি এবং ক্রসফায়ারে মানুষ হত্যা। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে বলা হচ্ছে, কেউ গুম হননি। তাঁরা নিজেরা নিজেদের লুকিয়ে রেখেছেন। আর ‘ক্রসফায়ার’ বলে কিছু নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা আত্মরক্ষার জন্য গুলি করেন। সব জায়গায় দেখা যায়, ‘অপরাধী’ পালিয়ে যেতে বা তার সহযোগীরা তাকে ছিনতাই করে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এর ফলে উভয় পক্ষে গোলাগুলি হয়। এতে কেউ কেউ মারা যায়। যারা মারা যায়, তাদের ব্যাপারে সরকারি বয়ান হলো, তারা অমুক–তমুক চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই ও খুনের মামলার এজাহারভুক্ত আসামি। কথাটার অর্থ দাঁড়ায়, আসামি মারা পড়লে কী সমস্যা? আরেকটি বয়ান হলো, সব দেশেই তো এ রকম হয়। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও অনেক ‘অপরাধী’কে ধরতে গিয়ে পুলিশ গুলি করে মারে। সেখানেও মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়। সুতরাং তারা বড় গলায় আমাদের সবক দেয় কেন?

মানবাধিকার লঙ্ঘনের তথ্য বিদেশিরা আসমান থেকে পায় না। এ দেশের সংবাদমাধ্যমে এগুলো ছাপা হয়, সম্প্রচারিত হয়। তা ছাড়া ঢাকার বিদেশি দূতাবাসগুলোয় দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা আছেন। তাঁরা স্বার্থসংশ্লিষ্ট নানান সংবাদ সংগ্রহ করেন। এসব তথ্য তাঁদের দেশে পাঠাতে হয়। এটা তাঁদের নিয়ম। এটা তো বাংলাদেশ নয়। বাংলাদেশের দূতাবাসগুলো এ কাজ করে বলে আমার জানা নেই। তারা প্রায় সময় ব্যতিব্যস্ত থাকে ক্ষমতাবানদের প্রটোকল দিতে।

বিদেশে পড়াশোনার নামে সন্তানদের পাচারে আমলা, রাজনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ী সবাই এককাট্টা। এখানে ডান-বাম কোনো পার্থক্য নেই। এদের মধ্যে কয়জন মেধার জোরে বৃত্তি পেয়ে পড়তে যায় আর কজন ‘বাপের টাকায়’ যায়, এবং সেই টাকা হালাল কি না, তার একটা অনুসন্ধান করলে থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়ত।

এখানে আরেকটি প্রশ্ন জড়িত আছে। মার্কিন ভিসা এমন, অনেকটা আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো। প্রশ্ন উঠতে পারে, আপনি যুক্তরাষ্ট্রে যেতে চান কেন? এখানে কিছু রহস্য থাকতে পারে। আমরা মাঝেমধ্যে অর্থ পাচারের রোমহর্ষ তথ্য সংবাদমাধ্যমে পাই। একদিকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের হুংকার, অন্যদিকে বছর বছর বিদেশে টাকা পাচারের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া। তো ওই টাকায় কী হয়? বিদেশের ব্যাংকে টাকা গচ্ছিত রাখার একটা অর্থ আছে। অনেকেই মনে করেন, দেশের ব্যাংকে টাকা রাখা নিরাপদ নয়। যদি লালবাতি জ্বলে, তাহলে সর্বস্ব খোয়ানোর আশঙ্কা।

দ্বিতীয়ত, বিদেশে অনেকের বাড়িঘর আছে। তাঁদের অনেকের স্পাউস ও সন্তানেরা সেখানে থাকে। গাড়ি হাঁকায়। কেউবা পড়াশোনা করে। বিদেশে যাওয়ার ব্যাপারে সবার প্রথম পছন্দ হলো যুক্তরাষ্ট্র। একবার সেখানে যেতে পারলে ভাগ্য খুলে যাবে। যাঁরা দেশের ‘বিশিষ্টজন’, তাঁরা মনে করেন, দেশ গোল্লায় গেছে। সুযোগ ও সময়মতো দেশ ছেড়ে বিদেশে গিয়ে থিতু হতে হবে। তার আগাম আঞ্জাম করে রাখছেন তাঁরা। সেখানে তাঁদের ‘সেকেন্ড হোম’; একসময় দেখা যাবে, বাংলাদেশ হবে তাঁদের সেকেন্ড হোম।

বিদেশে পড়াশোনার নামে সন্তানদের পাচারে আমলা, রাজনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ী সবাই এককাট্টা। এখানে ডান-বাম কোনো পার্থক্য নেই। এদের মধ্যে কয়জন মেধার জোরে বৃত্তি পেয়ে পড়তে যায় আর কজন ‘বাপের টাকায়’ যায়, এবং সেই টাকা হালাল কি না, তার একটা অনুসন্ধান করলে থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়ত।

ফিরে আসি মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রসঙ্গে। একটি রাজনৈতিক দল যখন ক্ষমতায় থাকে, তখন সে এটাকে ন্যায্য মনে করে। বিরোধীরা মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলে। যখন গণেশ উল্টে যায়, বিরোধীরা সরকার গঠন করে আর সরকারে থাকা দলটি বিরোধী দলে যায়, তখন তারা উল্টো গীত গায়। ৫০ বছর ধরে একই নাটক চলছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনে সরকারি বাহিনীগুলো একচ্ছত্র লাইসেন্স পেয়ে যায়, যখন তাদের ইমিউনিটি বা ইনডেমনিটি দেওয়া হয়। এটা শুরু হয় জাতীয় রক্ষীবাহিনীকে ইমিউনিটি দেওয়ার মধ্য দিয়ে। অনেক বছর আগে পত্রিকায় একটা সংবাদ শিরোনাম প্রায় চোখে পড়ত, ‘সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলিতেছে।’ তো ইমিউনিটি দেওয়াও বন্ধ থাকেনি।

যাঁদের ভিসা বাতিল হয়েছে বা ভবিষ্যতে হতে পারে বলে যাঁরা আশঙ্কা করছেন, তাঁদের ব্যাপারে আমার একটাই বক্তব্য—যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার জন্য এত অস্থির হওয়ার তো কিছু নেই! বাংলাদেশ তো সোনার দেশ হবে। এখানেই থাকুন, দেশের সেবা করুন।

যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক আচরণ নতুন কিছু নয়। তারা মিয়ানমারের কয়েকজন জেনারেলকে যুক্তরাষ্ট্রে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে। মিয়ানমারের ব্যাপারে এই আচরণ সেখানকার জান্তার ভালো না-ও লাগতে পারে। কিন্তু রাখাইন প্রদেশে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে তাঁদের ওপর কড়া অবরোধ আরোপ করলে তো আমাদের খুশি হওয়ার কথা। তাই না?

যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট প্রতিবছর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রসঙ্গ থাকে। এটি আমাদের গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয় বলে আমরা জানতে পারি। কিন্তু সরকারের মন্ত্রীদের একটা জবাবই মুখস্থ আছে, ‘আমরা এই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করছি’। ‘ডিনায়াল কালচার’ বা অস্বীকার করার এই সংস্কৃতির মধ্যে জনসমাজের উদ্বেগকে উপেক্ষা করা হয়। জবাবদিহির বদলে সাফাই গাওয়ার প্রবণতা দেশের মানুষ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ভালোভাবে নেয় না।

সম্প্রতি ১২টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে আবেদন করেছে যে বিদেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনগুলোতে র‌্যাব-পুলিশের কাউকে যেন না নেওয়া হয়। এ ধরনের অভিযোগ পেলে জাতিসংঘ কিন্তু নড়েচড়ে বসে। আমাদের তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, এসব সংগঠনের মধ্যে দুটি ছাড়া বাকিগুলোর মা-বাপ নেই। যাহোক, মানসম্মত একটি সংগঠনও যদি অভিযোগ তোলে, তা জাতিসংঘের বিবেচনায় আসবে। প্রশ্ন হলো, এসবের প্রতিক্রিয়া শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকবে?

জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সদস্য জোগানদাতা দেশ হলো বাংলাদেশ। এক-এগারোর পটভূমিতে এক সাক্ষাৎকারে জেনারেল মইন উ আহমেদ আমাকে বলেছিলেন, একজন সৈনিক একটি মিশনে গিয়ে যদি দুই বছর থাকতে পারে, তাহলে সে যে পরিমাণ টাকা আয় ও সঞ্চয় করতে পারে, তা তার সারা জীবনের কামাইয়ের চেয়ে বেশি। দেশে ফিরে এসে এই টাকা দিয়ে সে বাড়ি বানায়, জমি কেনে, পরিবারের সদস্যদের জন্য আয়-রোজগারের ব্যবস্থা করে। নিষেধাজ্ঞার কারণে সেই প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হলে অনেকেই ক্ষতির মুখোমুখি হবেন। এ রকম কিছু যেন না ঘটে, সেটাই সবার প্রত্যাশা। সে জন্য যে অভিযোগগুলো উঠেছে, সেগুলো ‘প্রত্যাখ্যান’ না করে খতিয়ে দেখা দরকার।

যাঁদের ভিসা বাতিল হয়েছে বা ভবিষ্যতে হতে পারে বলে যাঁরা আশঙ্কা করছেন, তাঁদের ব্যাপারে আমার একটাই বক্তব্য—যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার জন্য এত অস্থির হওয়ার তো কিছু নেই! বাংলাদেশ তো সোনার দেশ হবে। এখানেই থাকুন, দেশের সেবা করুন।

মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক

[email protected]