যে কারণে আজ শ্রীলঙ্কার এই মরণদশা

নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় শ্রীলঙ্কায় জনগণের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে
ছবি: রয়টার্স

শ্রীলঙ্কা তার স্বাধীনতা-উত্তর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে। দেশটির নেতারা এ সংকটকে ২০১৯ সালের এপ্রিলের ইস্টার বোমা হামলা ও ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া কোভিড-১৯ মহামারির ফল বলে দাবি করে দায় এড়াতে চাইলেও বাস্তবতা আদতে তা নয়।

নিশ্চিতভাবেই এ দুটি ধাক্কা দেশের পর্যটনশিল্পে উল্লেখযোগ্যভাবে পর্যটনপ্রবাহকে হ্রাস করেছে এবং অর্থনৈতিক খাতে এটি কিছু নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। কিন্তু মনে রাখা দরকার, পর্যটন দেশটির অর্থনীতির একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। পর্যটন খাত থেকে বছরে দেশটির আয় হয় ৪০০ কোটি ডলার। এ অর্থ দেশটির অভ্যন্তরীণ আয়ের মোট অর্থের ২০ থেকে ৩০ শতাংশ। অর্থাৎ প্রকৃত জিডিপিতে পর্যটনের অবদান মাত্র ১.৫ শতাংশ।

তুলনামূলকভাবে কোভিড-১৯ মহামারি দেশটিকে দীর্ঘমেয়াদি লকডাউনের দিকে নিয়ে গিয়েছিল। এর ধাক্কা দেশটির অর্থনীতিকে স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধির পথ থেকে লাইনচ্যুত করেছে। কিন্তু সেটিও যথাযথ নীতির মাধ্যমে দ্রুত সংশোধন করা যেত। কিন্তু শ্রীলঙ্কার এ ঘোর সংকট হঠাৎ করে উদ্ভূত হয়নি বরং ২০১২ সালের দিকে দেশটি যে ক্রমে অবনতি অনুভব করতে শুরু করেছিল, বর্তমান সংকট তারই চূড়ান্ত পরিণতি।

আজকে শ্রীলঙ্কা যে অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে, তাকে মূলত ২০০৫ সালে তৎকালীন সরকারের গৃহীত একটি অনুপযুক্ত অর্থনৈতিক কৌশল দ্বারা চালিত হওয়ার ফল হিসেবেই আমরা দেখতে পাচ্ছি। শ্রীলঙ্কার নেতারা দেশটির যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতির বিকাশের ওপর জোর দিয়ে একটি গার্হস্থ্য অর্থনীতিভিত্তিক অর্থনৈতিক নীতির দিকে ঝুঁকেছেন। দেশটি তিন সহস্রাব্দের বেশি সময় ধরে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে তার সম্পদ ও সমৃদ্ধি অর্জন করেছে—এ বিষয় তাঁরা কৌশলনীতির ভেতরে রাখেননি। ফলে রপ্তানি খাত তার প্রাপ্য স্বীকৃতি পায়নি। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির তুলনায় রপ্তানি হ্রাস থেকে এটি স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়।

শ্রীলঙ্কার ২০০৫ সালের জিডিপির ২৬ শতাংশ এসেছিল রপ্তানি থেকে। ২০১০ সালে সেই হার ১৫ শতাংশে এবং ২০১৫ সালে তা আরও নেমে ১৩ শতাংশে এসে ঠেকে। এ অনুপাত তখন থেকে এ স্তরেই স্থির ছিল এবং ২০২০ সালে তা ১২ শতাংশে নেমে আসে। যেহেতু দেশীয় অর্থনীতি প্রবৃদ্ধিকে উদ্দীপিত করতে পারার মতো চাহিদা তৈরি করতে পারেনি, তাই প্রকৃত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ২০১২ সালের ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ২০১৯ সালে ২ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে আসে।

২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারির আঘাতে অর্থনীতি ৩ দশমিক ৬ শতাংশ পর্যন্ত সংকুচিত হয়। ২০১৯ সালের নভেম্বরে গোতাবায়া রাজাপক্ষে যখন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন, তখন শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক পরিবেশ এমনটাই ছিল। নতুন প্রশাসন ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটাবে বলে আশা করা হয়েছিল, কিন্তু দেখা গেল সরকারের বেশ কয়েকটি নীতিগত ত্রুটির কারণে অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে।

গোতাবায়ার সরকার আয়কর এবং মূল্য সংযোজন করদাতাদের জন্য একটি অযাচিত কর ছাড় দিয়েছিল। এতে ৫০ হাজার কোটি রুপির রাজস্ব কম আদায় হয়েছে। অর্থাৎ এ সিদ্ধান্ত বার্ষিক জিডিপির প্রায় ৪ শতাংশ রাজস্বের ক্ষতি করেছিল। শ্রীলঙ্কার কৃষিকে রাতারাতি জৈব চাষে রূপান্তরিত করার সরকারি প্রচেষ্টার ফলে উৎপাদনে মারাত্মক ক্ষতি হয়। এটি শ্রীলঙ্কাকে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবল সংকটের মধ্যেও তার প্রধান খাদ্য চাল আমদানি করতে বাধ্য করে। সরকার ব্যাংকিং খাত থেকে, অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে অভূতপূর্ব পরিমাণে ঋণ নেয়। এতে রাজস্ব হ্রাসের ষোলোকলা পূর্ণ হয়।

শ্রীলঙ্কায় ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে মুদ্রাস্ফীতি ছিল ৪ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেই হার ১৭ দশমিক ৫ শতাংশে পৌঁছেছে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো সরকারের বিশদ পরিসরে অর্গানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদে কৃষি উৎপাদন ভয়াবহভাবে কমে গেছে। খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি ২৫ শতাংশ বেড়ে গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, ১ মার্কিন ডলার ২০০ শ্রীলঙ্কান রুপির বিনিময়ে পাওয়া যাবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো এ রেটে কোনো ডলার মিলছে না। সেখানে কালোবাজারে ২৫০ থেকে ২৬০ রুপিতে ১ ডলার মিলছে।

২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে পরবর্তী ২৫ মাসে ব্যাংক থেকে সরকারের নেওয়া ঋণের পরিমাণ ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি রুপিতে দাঁড়ায়। অর্থাৎ এ ২৫ মাসে সরকারের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ ১৭৩ শতাংশ বেড়েছে। এর ফলে ব্যাংক নোটের (যেটিকে এখন শ্রীলঙ্কার সাধারণ মানুষ ‘টাকা ছাপানো’ বলে প্রায়ই উল্লেখ করছে) মজুত ৪০ শতাংশ বাড়িয়ে ৩ লাখ কোটি রুপি পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে। এতে একদিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছে, অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ মুদ্রাস্ফীতি অনেক বেড়ে গেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০১৯ ডিসেম্বরে ছিল ৭৬০ কোটি ডলার। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির শেষে তা মাত্র ২৩০ কোটি ডলারে নেমে এসেছে।

এরপরও কথা আছে। এ শেষোক্ত অঙ্কের রিজার্ভের মধ্যে ইললিকুইড ব্যালান্স (যে অর্থ তরল বা নগদ অবস্থায় নেই) এবং চীনের মুদ্রা ইউয়ানের সঙ্গে সোয়াপ সুবিধাভিত্তিক বিনিময়যোগ্য অর্থের পরিমাণ ১৬০ কোটি ডলার। এ অর্থ বাদ দিলে শ্রীলঙ্কার হাতে ব্যবহারযোগ্য বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ আছে মাত্র ৪০ কোটি ডলার, যা দিয়ে এক সপ্তাহের আমদানি কার্যক্রম চালানো সম্ভব।

পরিস্থিতি যে কতটা ভয়াবহ, তা কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। উভয় ব্যাংকই এখন পর্যন্ত স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণের ওপর ভর করে কোনোমতে টিকে আছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মোট বৈদেশিক ঋণ সমন্বয় করলে তার ঋণাত্মক ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ৩২০ কোটি ডলার। এ ছাড়া বাণিজ্যিক ব্যাংকের মোট ঋণাত্মক ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ২৮০ কোটি ডলার।

শ্রীলঙ্কার ঘাড়ে এ ঋণাত্মক ঋণের বোঝা থাকলেও আগামী ১২ মাসের মধ্যে তার ৮৯০ কোটি ডলারের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ কারণে একটি জরুরি ঋণ পুনর্গঠনের কথা বলা হচ্ছে। এ সংকটময় সময়ে ভারত শ্রীলঙ্কাকে আগে থেকে দেওয়া দুটি বাণিজ্যিক ঋণের সম্প্রসারণ হিসেবে জরুরি ভিত্তিতে আরও দেড় শ কোটি ডলারের সহায়তা করতে এসেছিল।

আরও পড়ুন

শ্রীলঙ্কায় ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে মুদ্রাস্ফীতি ছিল ৪ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেই হার ১৭ দশমিক ৫ শতাংশে পৌঁছেছে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো সরকারের বিশদ পরিসরে অর্গানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদে কৃষি উৎপাদন ভয়াবহভাবে কমে গেছে। খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি ২৫ শতাংশ বেড়ে গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, ১ মার্কিন ডলার ২০০ শ্রীলঙ্কান রুপির বিনিময়ে পাওয়া যাবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো এ রেটে কোনো ডলার মিলছে না। সেখানে কালোবাজারে ২৫০ থেকে ২৬০ রুপিতে ১ ডলার মিলছে।

এ অবস্থা থেকে শ্রীলঙ্কাকে বের করে আনতে সরকারের মধ্যে আলোচনা চলছে। তবে মোটাদাগে যা বোঝা যাচ্ছে, এ খাদ থেকে দেশটির বেরিয়ে আসা খুবই কঠিন হবে। এর জন্য কয়েক বছর লেগে যেতে পারে।

ডেকান হেরাল্ড থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

ডব্লিউ জে বিজেওয়ার্ধনা শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর