যে কারণে স্বাস্থ্য নিয়ে বাণিজ্য হতে পারে না

মুক্তবাজার অর্থনীতির দোহাই দিয়ে কেউ কেউ বলে থাকেন, স্বাস্থ্যে কেন মুক্তবাজার অর্থনীতির চর্চা থাকবে না? যেকোনো প্রশ্নই যথার্থ, যতক্ষণ না এর একটি গ্রহণযোগ্য উত্তর আমরা খুঁজে পাই। স্বাস্থ্য নিয়ে বাংলাদেশে যে তুলকালাম কাণ্ড চলছে, এমন প্রশ্ন আসাটাই স্বাভাবিক। এর উত্তর খুঁজতে গেলে তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক প্রেক্ষাপটটা তুলে ধরা জরুরি। এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য নয়, বরং স্বাস্থ্যসেবাকেই সামনে রেখে আলোচনা এগিয়ে নিতে হয়। কেননা, আমরা স্বাস্থ্য বাজার থেকে কিনতে পারি না, বরং স্বাস্থ্যসেবা কিনে থাকি। যেমন করে আমরা চাল, ডাল, লবণ, তেল, জামাকাপড়, টেলিভিশন, গাড়ি, বাড়ি ইত্যাদি কিনি, ঠিক তেমনই।

একটি বিষয় স্পষ্ট করা জরুরি, যেকোনো পণ্যের ক্ষেত্রে বাণিজ্য বিভিন্ন স্তরে হয়ে থাকে। যেমন ধরুন, কৃষকের কাছ থেকে মজুতদার ধান বা চাল কিনে তা বিক্রি করেন শহর থেকে আসা ব্যবসায়ীদের কাছে, যাঁরা সেটা শহরের পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন। এই পাইকারি ব্যবসায়ীরা খুচরা বিক্রেতার কাছে বিক্রি করলে সেটা আমরা সাধারণ মানুষ কিনে নিই। অর্থাৎ মুক্তবাজার অর্থনীতি চর্চা করার ভিন্ন ভিন্ন ধাপ রয়েছে এবং পূর্ণ চর্চা হয় তখনই, যখন প্রতিটি ধাপেই আমরা তা করতে পারি।

মনে রাখা জরুরি, সব বাণিজ্যের পেছনে বাজারপ্রক্রিয়ার পাশাপাশি জনকল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য সরকারি নীতিমালা ও আইনের প্রয়োগ অপরিহার্য।

আমাদের মূল আপত্তিটা সেখানেই, যেখানে রোগীর সঙ্গে স্বাস্থ্যসেবাদানকারীরা ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে তোলেন। যেখানে স্বাস্থ্যসেবাসংক্রান্ত পণ্য (যেমন ওষুধ, এক্স-রে মেশিন, ব্লাড প্রেশার মাপার মেশিন) নিয়ে এদের প্রস্তুতকারক কোম্পানি, পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা নিজেদের মধ্যে বাণিজ্য করেন, তা নিয়ে আমাদের আপত্তি নেই। তবে মনে রাখা জরুরি, সব বাণিজ্যের পেছনে বাজারপ্রক্রিয়ার পাশাপাশি জনকল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য সরকারি নীতিমালা ও আইনের প্রয়োগ অপরিহার্য। স্বাস্থ্যসেবাকে নিয়ে মুক্তভাবে বাণিজ্য করা কেন উচিত নয়, তা বোঝার জন্য কয়েকটি বিষয়ের ওপর আলোকপাত করছি।

মুক্তবাজার হলো একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, যা সরবরাহ বা চাহিদার ওপর ভিত্তি করে সরকারের সামান্য বা কোনো নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই নির্ধারিত হয়। বেশ কিছু শর্ত মুক্তবাজারের বৈশিষ্ট্য রচনা করে থাকে। এমন একটি হলো মুক্তবাজারে ক্রেতা ও বিক্রেতার সংখ্যা অনির্ধারিত এবং যেকোনো বিক্রেতা বাধাহীনভাবে বাজারে অংশগ্রহণ বা বাজার পরিত্যাগ করতে পারে। অর্থাৎ কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় বা অন্য কোনোভাবে কাউকে ব্যবসা করা থেকে বিরত রাখা যাবে না। কেবল প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা বা না থাকার ওপর নির্ভর করবে কোনো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বাজারে অবস্থান করবে কি না।

দ্বিতীয়ত, তথ্যের অবাধ প্রবাহ থাকতে হবে। অর্থাৎ ক্রেতার পক্ষে পণ্যটির গুণগত মান, পণ্য প্রস্তুতকারক ইত্যাদি সম্পর্কে সব তথ্য পাওয়ার সুযোগ থাকতে হবে, যাতে ক্রেতা ভুল পণ্য বা ভুল পরিমাণ পণ্য না কেনেন। তৃতীয়ত, পণ্য ক্রয় বা উৎপাদন করার সময় ক্রেতা ও উৎপাদনকারী সর্বদা যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে (যেমন সর্বোত্তম মূল্যে কেনা এবং যুক্তিসংগত পরিমাণ পণ্য উৎপাদন করা)।

আমরা ব্যক্তিমালিকানাধীন চিকিৎসাকেন্দ্রের দিকে তাকালে দেখতে পাই, ওষুধ ও রোগনির্ণয় পরীক্ষা, সন্তান জন্মের ক্ষেত্রে সিজারিয়ান করা ইত্যাদির পরিমাণ নির্ধারণের ক্ষেত্রে রোগীর মতামত দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই

বাস্তবতার নিরিখে স্বাস্থ্যসেবাকে পর্যালোচনা করতে গেলে বলতে হয়, যখন রোগী চিকিৎসাসেবা কিনতে যায়, তখন উপরিউক্ত শর্তগুলো কতটুকু প্রযোজ্য হয়ে থাকে, তা বিবেচনায় নিতে হবে। যে কেউই সামর্থ্য থাকলে চিকিৎসাকেন্দ্র খুলে রোগীদের সেবা দিতে পারেন। দেশজুড়ে ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠা ফার্মেসি, ক্লিনিক, হাসপাতাল থেকে সহজেই বোঝা যায়, প্রথম শর্তটি বেশ কার্যকর আমাদের দেশে। সমস্যাটি শুরু হয় যখন দ্বিতীয় শর্তটির ওপর আলোকপাত করি। দ্বিতীয় শর্তটি হলো, তথ্যের অবাধ প্রবাহ, যা রোগীদের ‘সঠিক চিকিৎসা’ নিতে এবং ‘সঠিক পরিমাণ’ চিকিৎসা নিতে সাহায্য করবে।

আমরা ব্যক্তিমালিকানাধীন চিকিৎসাকেন্দ্রের দিকে তাকালে দেখতে পাই, ওষুধ ও রোগনির্ণয় পরীক্ষা, সন্তান জন্মের ক্ষেত্রে সিজারিয়ান করা ইত্যাদির পরিমাণ নির্ধারণের ক্ষেত্রে রোগীর মতামত দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই (স্বাভাবিকভাবেই)। কিন্তু অন্যদিকে যেহেতু রোগী যত বেশি সেবা নেবে, চিকিৎসাকেন্দ্রের মালিকদের তত বেশি মুনাফা হয়। সেবাদানকারীরা তাই অনেক ক্ষেত্রেই প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি সেবা নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এটাকে স্বাস্থ্য অর্থনীতির ভাষায় ‘সরবরাহকারী-প্ররোচিত-চাহিদা’ বলা হয়ে থাকে। এতে মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রধান একটি কাঠামো (স্বাস্থ্যসেবার চাহিদা) প্রকৃত চাহিদার তুলনায় অনেক বেড়ে যায়। অত্যন্ত ভুল পরিমাণ চিকিৎসাসেবা উৎপাদিত হয়, যা মুক্তবাজার অর্থনীতির সম্পূর্ণ পরিপন্থী।

তৃতীয় শর্ত, অর্থাৎ পণ্য ক্রয় বা উৎপাদন করার সময় ক্রেতার ও উৎপাদনকারীর সর্বদা যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাটা সম্ভবপর হয় না। কেননা, ক্রেতা ও সেবাদানকারীর মধ্যে জ্ঞানগত পার্থক্য ব্যাপক। তথ্য প্রবাহের পার্থক্যের পাশাপাশি জ্ঞানের পার্থক্য মিলে বিশেষত ক্রেতারা যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হন। অন্যদিকে সেবাদানকারীরা এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজেদের মুনাফাকে (অসাধু চর্চা) সর্বোচ্চ পরিমাণে বৃদ্ধি করাতেই জোর দিয়ে থাকেন।

স্বাস্থ্যসেবার চাহিদা অনেক ক্ষেত্রেই অপ্রত্যাশিত। পরিবারের যে কেউই যেকোনো সময় সংক্রামক রোগ, দুর্ঘটনার শিকার হতে পারে। বাংলাদেশে এমন পরিবার পাওয়া কঠিন, যাদের কোনো সদস্য বিগত তিন-ছয় মাসে কোনো প্রকার চিকিৎসাসেবা নেয়নি (এমনকি কোভিড-১৯ বিস্তার লাভের আগেও)। এ ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি রোগ, যেমন ক্যানসার, ডায়াবেটিস, হৃদ্‌রোগ দিন দিন বেড়েই চলেছে। স্বাস্থ্যসেবাকে পণ্য হিসেবে দেখতে গেলে এটা সুস্পষ্ট, অনেক ক্ষেত্রেই তা অপ্রত্যাশিত ও অত্যাবশ্যকীয়, যা টেলিভিশন, গাড়ি, চকলেট ইত্যাদির সঙ্গে তুলনীয় নয়।

এ ছাড়া স্বাস্থ্যসেবা ক্রয় করলেই এটা শতভাগ নিশ্চিত নয় যে রোগীর স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে। যেমন ধরুন, অনেক রোগী অপারেশনের পরও পুরোপুরি সুস্থ হয় না, এমনকি কখনো মৃত্যুবরণও করে থাকে। ওষুধ খেলেই রোগী সেরে উঠবে, এটা সব সময় বলা যায় না। টিকা নিলেই আপনার কলেরা হবে না, এটাও নিশ্চিত নয়। আপনি টেলিভিশন, চাল, জামাকাপড় ইত্যাদি পূর্ণ নিশ্চয়তার সঙ্গে কিনতে পারেন, অর্থাৎ এতে আপনার কাঙ্ক্ষিত সেবাটি বহুলাংশে বা পুরোপুরি পেতে পারেন, যা স্বাস্থ্যসেবা ক্রয়ের ক্ষেত্রে অনুরূপ নয়। কাঙ্ক্ষিত সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে যে অনিশ্চয়তা রয়েছে, তা স্বাস্থ্যসেবা ক্রয়কে অন্য অনেক পণ্য বাজারের চেয়ে ভিন্ন করে তুলেছে।

ড. জাহাঙ্গীর এ এম খান: সহযোগী অধ্যাপক (স্বাস্থ্য অর্থনীতি ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা), গোথেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় ও ক্যারোলিন্সকা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, সুইডেন ও আইসিডিডিআরবির স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের সাবেক প্রধান