যৌনস্বাস্থ্য শিক্ষার বিষয়বস্তু কেমন হতে হবে

২০০৮ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিভাগের তিনটি জেলায় কিশোর-কিশোরীদের জীবনযাত্রায় পরিবর্তনবিষয়ক একটি গবেষণায় জড়িত ছিলাম। প্রশ্নমালার একটি অংশ ছিল প্রজননস্বাস্থ্য–সম্পর্কিত। পাঠ্যক্রমেও বয়ঃসন্ধিকালীন সমস্যাগুলো কীভাবে উতরানো যাবে, সেই পাঠ ছিল। উত্তরদাতা কিশোর-কিশোরীরা জানাল, শিক্ষক-শিক্ষিকারা বিষয়টি পড়াতে অপ্রস্তুত বোধ করেন। তাঁরা অধ্যায়টি বাদ দিয়ে অন্য অধ্যায় পড়ান। ছাত্রছাত্রীদের নির্দেশ দেন, তারা যেন নিজেরা অধ্যায়টি পড়ে নেয়। অনেকে বিব্রত ও বিরক্তভাব দেখান যে এই সব বিষয় পাঠ্যপুস্তকে থাকা ঠিক নয়।
শিক্ষকদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় তাঁরাও জানালেন, পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কোনো বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার আগে তাঁদের মতামত নেয় না। পাঠ্যে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর কীভাবে পড়াতে হবে, সেই নির্দেশনা দেয়। বিষয়টি বিজ্ঞানসম্মত, তাতে তাঁদের দ্বিমত নেই। কিন্তু আপত্তি এই যে পড়ানোর সময় ছাত্রছাত্রীরা ক্লাসে যে অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরি করে, তা অনেক সময় শিক্ষাদানে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

আমরা সমতলেও ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের একই রকম মতামতই পেলাম। বিশেষত মফস্বলের ও গ্রামের স্কুলগুলোতে। এমনকি তাঁরা বললেন, ‘সৃজনশীল শিক্ষা’ এবং ‘শ্রেণিকক্ষের বাইরে হাতেকলমে’ শিক্ষার যে বাধ্যবাধকতা, সেগুলোও আসলে কোনো কাজে আসে না।

শিক্ষকেরা বললেন, ক্লাসের বাইরে ছাত্রছাত্রীদের নিলে অভিভাবকেরা নাখোশ হন এবং শিক্ষকেরা ক্লাস ফাঁকি দিয়ে তাঁদের সন্তানদের দিয়ে কাজ করিয়ে নিচ্ছে ইত্যাদি নানা রকমের অভিযোগ তোলেন। তাঁদের বক্তব্য, ছাত্রছাত্রীদের আগে অবশ্যই তাদের অভিভাবকদের এবং শিক্ষকদের বিশ্বাস করাতে হবে যে যা কিছু হচ্ছে ভালোর জন্য হচ্ছে, তবেই শুধু পাঠ্যপুস্তকে নতুন বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।

আমরা অভিভাবকদের অনেককেও পেলাম, যাঁদের ধারণা, বিষয়টি সন্তানদের লাজ-লজ্জা উঠিয়ে নিয়ে যাবে, এবং তাদের যৌনতায় আগ্রহী করে তুলবে।

আমাদের গবেষণাটির সময়টি ছিল জাতিসংঘের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য (এমডিজি) অর্জনের সময়সীমার শেষের দিক। এমডিজির একটি শর্ত ছিল শতভাগ স্বাস্থ্যকর পয়োনিষ্কাশন ও পানি ব্যবহারের লক্ষ্য অর্জন। সেই লক্ষ্য অর্জনের অন্যতম দিক ছিল কিশোরীদের শেখানো যে ঋতুকাল ও গর্ভাবস্থায় সুস্বাস্থ্য রক্ষার জন্য অতীত কাল থেকে চলে আসা অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বাদ দিয়ে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি মানতে হবে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যকর খাবার ও যথার্থ ক্যালরি গ্রহণ করতে হবে। শতাব্দীকাল ধরে চলে আসা কুসংস্কার ছাড়তে হবে। তারা নিজেরা শিখে প্রয়োজনে মা-খালা বা অন্যদেরও শেখাবে। এই শেখা শেখানো লজ্জার নয়, লজ্জা কাটানোর। সামাজিক দায়িত্ব পালনের।

এ রকম ইতিবাচক পাঠ্যসূচিও গ্রামে-গঞ্জে মফস্বলে আদৃত না হওয়ার কারণটি আমরা সবাই বুঝি। তখন পর্যন্ত সমাজে বিষয়টি একান্তই ব্যক্তিগত ও গোপনীয় বিষয় বিবেচিত হয়ে আসছিল। ফলে সাধারণ মানুষ বিষয়টিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছিল না। মানতেই হবে, একটা সময়ে এসে লুকোছাপা ছাড়তেই হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সত্যরে লও সহজে’ কথাটিই মানতে হয়।

দুই
বাংলাদেশের স্কুল পাঠ্যক্রমগুলোতে যৌন শিক্ষাদানের একটি আরোপিত চেষ্টা আছে। কী কী আছে সেই সব পাঠ্যক্রমে? আছে বয়ঃসন্ধিকালে কী রকম শারীরিক মানসিক পরিবর্তন ও প্রতিক্রিয়া হয় এবং যৌনতা ভাবনা ও আচরণে কী ধরনের পরিবর্তন আসে। এ বিষয়গুলো কে না জানে? যারা জীববিজ্ঞান পড়বে, অ্যানাটমিতে আরও গভীরভাবেই জানবে। যে বিষয়গুলোর উল্লেখ আছে, সেসব যারা স্কুলে-কলেজে যায়নি, তারাও প্রাকৃতিকভাবেই জানে, শেখে, বোঝে এবং অনুভব করে। এগুলো না জানাই কি কিশোর-কিশোরীদের বা বয়স্কদের যৌন অপরাধের কারণ? মোটেই নয়। এগুলো জানার পর কি যৌন অপরাধ কমেছে? মোটেই কমেনি।

তাহলে আসলে কী কী পাঠ্যভুক্ত হওয়া প্রয়োজন ছিল? প্রয়োজন ছিল নারী-পুরুষের পারস্পরিক সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধের প্রশিক্ষণ, লৈঙ্গিক সম্পর্কের দায়িত্ব-কর্তব্য ও শৃঙ্খলাপাঠ, যৌন-নৈতিকতা, ধর্মের চোখে ও আইনের চোখে যৌন-আচরণের সীমা, অসংগত সম্পর্কের বিপদ ও বিপর্যয়, ফ্যান্টাসির বিপদ, অনুকরণের ও নির্বিচারে ভিন্ন সংস্কৃতি ও সংস্কারের প্রতি নির্ভরশীলতার বিপদ ইত্যাদি।

সমাজবিজ্ঞানকে সবার জন্য অবশ্যপাঠ্য বিষয় করা হলে আলাদাভাবে সেক্স এডুকেশন নামে কোনো অধ্যায়েরই আর প্রয়োজন হয় না। নিয়মিত কারিকুলাম সংস্কার প্রয়োজন। বাংলাদেশের বেলায়ও এই দরকারটি ভাবনায় রাখতেই হবে।

তিন
যৌনশিক্ষা ও সম্মতি নিয়ে সম্প্রতি বেশ আলোচনা হচ্ছে। স্পষ্টই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন আলোচকেরা। একদল বিষয়টিকে ‘যৌনতা’ (কামকলা) শিক্ষা ধরে নিয়ে ‘সব গেল’ আওয়াজ তুলেছেন, অন্য দলও বিষয়টিকে দুঃখজনকভাবে ‘সম্মতি-অসম্মতি’, ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’, ‘সম্মতির বয়স’ ইত্যাদি নিছক যৌন কর্মসংশ্লিষ্ট আলোচনার পর্যায়ে নামিয়ে নিয়ে এসেছেন। অথচ বিষয়টি আসলে স্বাস্থ্যশিক্ষা।

যাঁরা এসব আলোচনা করছেন তাঁরা প্রথমত, শহুরে শিক্ষিত আলোকপ্রাপ্ত সচ্ছল জন। দ্বিতীয়ত, শহুরে শিক্ষিত হলেও রক্ষণশীল অংশ নন। তৃতীয়ত, তাঁরা নারীবাদী চিন্তা ও প্রাগ্রসর রাজনীতি-সমাজনীতির চিন্তাসংশ্লিষ্ট। চতুর্থত, অনেকের পশ্চিমা বা উন্নত দেশে থাকার বা দেখার অভিজ্ঞতা রয়েছে। দেখেছেন, শুনেছেন অথবা পড়েছেন। অনেকে ভেবেও দেখেন না যে কোনো পশ্চিমা মডেলকে উদাহরণ দেখিয়ে বাংলাদেশে প্রয়োগের কথা বলতে গেলে দেখতে হয় বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থা সেই পর্যায়ে পৌঁছেছে কি না, অথবা সামাজিক স্তরবিন্যাসে সব মানুষই তাঁদের কাতারে উঠে গেছেন কি না!

আশ্চর্য শোনালেও সত্য যে পশ্চিম যথেষ্ট উদার এবং খোলামেলা হওয়ার পরও শিক্ষাকার্যক্রমে যৌনতা–সম্পর্কিত আলোচনা চান না বেশির ভাগ অভিভাবক এবং প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিরা। এই বিষয়ে অসংখ্য গবেষণা আছে। কানাডা একটি উদাহরণ। অন্টারিও প্রদেশে ২০১৫ সালে পাঠ্যক্রমে ব্যাপক সংস্কার হয়। তারপরও কয়েক বছর ধরেই স্কুল সিলেবাসে যৌনতাসংক্রান্ত আলোচনার সংস্কারের দাবি উঠে আসছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে কানাডার একদল গবেষক ২০২০ সাল পর্যন্ত সামাজিক মাধ্যমে লিখে রাখা অভিভাবকদের মতামত ও মনোভাব সংগ্রহ করেন এবং গভীরভাবে নিরীক্ষণ করেন। বিখ্যাত গবেষণা জার্নাল অ্যাডলেসেন্স অ্যান্ড ইয়ুথ-এ তাঁদের ছাপা হওয়া গবেষণা প্রবন্ধের শিরোনাম, ‘ইট গোজ বিয়ন্ড দ্য ফান্ডামেন্টালস অব সেক্স এডুকেশন’।

অর্থাৎ, যৌনশিক্ষার মূল প্রতিপাদ্য ছাড়িয়ে এটি আরও বহু দূরে যাওয়া বিষয়।
কী সেই বহু দূরে চলে যাওয়া? এই সব ক্ষুদ্র তাত্ত্বিক বিষয় ছাড়িয়ে প্রকৃত বাস্তবতাকে পাঠ্যক্রমের আওতায় আনা। তাহলে বাংলাদেশের পাঠ্যক্রমে আসলে কী প্রয়োজন? প্রয়োজন সাম্প্রতিক সমস্যাগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া। যেমন পর্নোগ্রাফি সত্য নয়, ফ্যান্টাসি। সিনেমা বাস্তব নয়। এটি বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা-শিল্প। থাকবে বিভিন্ন ধর্মের, আইনের এবং নীতিশাস্ত্রের অনুশাসনের আলোকে যৌন-নৈতিকতার পাঠ। শেখানো হবে ড্রাগ শক্তিবর্ধক নয়, জীবননাশক। আরও থাকবে রাস্তাঘাটে বা যত্রতত্র যৌনতাসংক্রান্ত রমরমা বিজ্ঞাপন যে মিথ্যা, সেই সত্যের আলোচনা।

কারিকুলামে সেক্স এডুকেশন সংশ্লিষ্টই থাকবে সেলফোন—নেশাসক্তির বিপদ আলোচনা—কীভাবে বিশ্বময় ইন্টারনেটের মাধ্যমে একদল অপরাধী শিকার খুঁজে বেড়াচ্ছে, যাতে বলি হয় অসংখ্য কিশোর-কিশোরী। সাইবার-বুলিং, মুক্তিপণ আদায়কারীদের ফাঁদ, প্রেমের নামে প্রতারণা, গোপন ক্যামেরায় ছবি ও ভিডিওকারী চক্র, নারী ও শিশু পাচারকারী চক্রের চক্রান্ত, জঙ্গিদের শিকারে পরিণত হওয়ার বিপদ ইত্যাদি সাম্প্রতিক সমস্যার চুলচেরা বিশ্লেষণের পাঠ থাকবে।

মূলত সমাজবিজ্ঞানকে সবার জন্য অবশ্যপাঠ্য বিষয় করা হলে আলাদাভাবে সেক্স এডুকেশন নামে কোনো অধ্যায়েরই আর প্রয়োজন হয় না। নিয়মিত কারিকুলাম সংস্কার প্রয়োজন। বাংলাদেশের বেলায়ও এই দরকারটি ভাবনায় রাখতেই হবে। সংস্কার হতে হবে বাংলাদেশের সমাজ-বাস্তবতার সঙ্গে সংগতি রেখেই।

হেলাল মহিউদ্দীন অধ্যাপক, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ, পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড সোসিওলজি; নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।