রংপুর বিভাগে কি মেগা প্রকল্প হবে না

রংপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের প্রবেশমুখে সরকারের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগের ছবি চোখে পড়ল। সেখানে আছে সরকারের ১০টি মেগা প্রকল্পের নাম। প্রকল্পগুলো পদ্মা বহুমুখী সেতু, দোহাজারী রামু-কক্সবাজার-ঘুমধুম রেলপথ, পদ্মা রেলসেতু সংযোগ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মেট্রোরেল, সোনাদিয়া ও পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর, রামপাল ও মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং মহেশখালী এলএনজি টার্মিনাল। সোনাদিয়া ও পায়রা সমুদ্রবন্দর বাদ দিলেও অন্য প্রকল্পগুলোতে প্রায় তিন লাখ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে টাকার পরিমাণ। বিদেশের টাকার সঙ্গে আছে নিজস্ব অর্থায়ন। এই টাকা সারা দেশের এক বছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির ব্যয়ের চেয়ে অনেক বেশি। বাংলাদেশ যে অর্থনৈতিকভাবে অনেকটা এগিয়েছে, তা এই প্রকল্পগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যায়।

বৈষম্যহীন একটি দেশ গড়ার লক্ষ্য নিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের সেই চেতনা আমরা কতটুকু ধরে রাখতে পেরেছি। আয়তন বিবেচনায় ছোট একটি দেশ হলেও এত বৈষম্যপূর্ণ উন্নয়ন কোনো অবস্থাতেই মেনে নেওয়া যায় না

উল্লিখিত ১০টি মেগা প্রকল্পের একটিও রংপুর বিভাগে নেই। এটি হয়তো ভাবার জন্য বিশেষ কিছু নয়। কারণ, বিভাগ ধরে তো আর মেগা প্রকল্প নেওয়া হয়নি। আবার দেশের যেকোনো প্রান্তে উন্নয়ন হোক না কেন, তা তো সবার উন্নয়ন। কিন্তু এরপরও সবচেয়ে বঞ্চিত-অবহেলিত-উপেক্ষিত রংপুর বিভাগে কোনো মেগা প্রকল্প না হওয়াটি ভাবনার উদ্রেক করে। রংপুরের সঙ্গে এমন বিমাতাসুলভ আচরণের অগণিত দৃষ্টান্ত রয়েছে। বলা যায়, সরকার যখন বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করে, তার ১ শতাংশের কম বরাদ্দ থাকে রংপুর বিভাগের দুই কোটি মানুষের জন্য।

দেশের উন্নয়ন তরতর করে বৃদ্ধি পাচ্ছে আর রংপুর বিভাগের গড় দারিদ্র্য তরতর করে নিম্নমুখী হয়েছে। দেশের সবচেয়ে গরিব ১০টি জেলার ৫টি জেলাই এই বিভাগে। রংপুর থেকেই দেশের সবচেয়ে কম জনশক্তি বিদেশে পাঠানো হয়েছে। রংপুরে দুই কোটি মানুষ হলেও এখানে খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয় প্রায় চার কোটি মানুষের। রংপুর বিভাগ এখন দেশের খাদ্যের জোগানদাতা আর উন্নয়নের সুফল ভোগকারী অন্যান্য বিভাগের মানুষ। ফলে রংপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে যে মেগা প্রকল্পের চিত্র প্রদর্শনী, তা অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। হয়তো এই প্রদর্শনী সব জেলাতেই আছে। প্রদর্শন করাটা দোষের নয়। বৈষম্য কেবল অন্যায়ই নয়, অমানবিকও।

দেশের ভেতরে উন্নয়ন কখনোই সুষম হয়নি। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যা করার পর ১৯৯১ সাল পর্যন্ত দেশে গণতান্ত্রিক সরকার ছিল না। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসে। রংপুরে তখন জাতীয় পার্টির দাপট। বিএনপি তাই এখানে কোনো উন্নয়ন করেনি। এরপর ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ সরকার। তখনো জাতীয় পার্টিরই আধিপত্য, সেবারও উন্নয়ন হয়নি। ২০০১ সালে আবার বিএনপি ক্ষমতায় আসে। তখনো রংপুরে বিএনপির করুণ দশা। ফলে এই পাঁচ বছরেও কোনো মনোযোগ ছিল না সরকারটির। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে রংপুর বিভাগ সব সময়ই উন্নয়নবৈষম্যের শিকার হয়ে আসছে। ২০০৮ সাল থেকে মহাজোট সরকার ক্ষমতায়। এই সরকারের সময়ে দেশে প্রভূত উন্নয়ন সাধিত হলেও তা চরম বৈষম্যপূর্ণ।

রংপুর বিভাগের রাজনৈতিক ব্যক্তিদের কখনোই ঐক্যবদ্ধ হয়ে এখানকার উন্নয়নে নেমে পড়তে দেখা যায়নি। উন্নয়নের প্রশ্নে দেশের অনেক অঞ্চলে রাজনৈতিক ব্যক্তিরা মতাদর্শ ভুলে ঐকমত্যে এলেও রংপুরে তেমনটি দেখা যায়নি। রংপুরের জন্য চাওয়ার ক্ষেত্রেও দীনতা আছে।

দেশের উন্নয়ন যদি সুষম হতো, তাহলে আলাদা করে চাওয়ার প্রয়োজন হতো না। বাংলাদেশের সবচেয়ে গরিব জেলার নাম কুড়িগ্রাম। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী কুড়িগ্রামে গড় দারিদ্র্য ৭০ দশমিক ৮ শতাংশ। সারা দেশে গড় দারিদ্র্য ২০ শতাংশ হলেও এই জেলা তথা এ অঞ্চলের সঙ্গে দেশের অন্যান্য জেলার বৈষম্য দূর করার জন্য সরকার কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। বৈষম্য দূর করতে কি এ অঞ্চলের মানুষকে আন্দোলন করে, লিখিত দাবি করে কিংবা গলা ফাটিয়ে মঞ্চ কাঁপিয়ে চাইতে হবে?

রংপুরের মানুষের কল্যাণের কথা সরকার বিবেচনা করলে এখানে সবার আগে সরকার মেগা প্রকল্প গ্রহণ করত। এ অঞ্চলে মেগা প্রকল্প হলে জাতীয় ও আঞ্চলিকভাবে এর প্রভাব পড়ত। এখানে যদি উন্নয়ন হয়, তাহলে দেশের গড় দারিদ্র্য দ্রুতই অনেক কমে যাবে। রংপুর অঞ্চলের মানুষের গরিব হয়ে থাকার সবচেয়ে বড় কারণ এখানকার নদীভাঙন আর বন্যা। এই অঞ্চলের নদীভাঙন আর বন্যা রোধে বিশ্বের উন্নত প্রযুক্তির আলোকে একটি মেগা প্রকল্প গ্রহণ করা যেত। এ অঞ্চলে আছে হাজার হাজার চর। চরকেন্দ্রিক উন্নয়ন মেগা প্রকল্প অনায়াসে হতে পারত। ব্রহ্মপুত্রের ওপরে অনায়াসে রেল ও সড়ক যোগাযোগ স্থাপনের জন্য একটি মেগা প্রকল্প নেওয়া যেত। রংপুর অঞ্চলের রেল ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন করা যেত। কৃষিভিত্তিক শিল্পকারখানা গড়ে তোলায় সরকার বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করতে পারত। এমনকি যেকোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়তে প্রণোদনাভিত্তিক মেগা প্রকল্প গ্রহণ করা যেত।

বৈষম্যহীন একটি দেশ গড়ার লক্ষ্য নিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের সেই চেতনা আমরা কতটুকু ধরে রাখতে পেরেছি। আয়তন বিবেচনাতে ছোট একটি দেশ হলেও এত বৈষম্যপূর্ণ উন্নয়ন কোনো অবস্থাতেই মেনে নেওয়া যায় না। সরকারের উচিত রংপুর অঞ্চলের গণমানুষের উন্নয়নে মেগা প্রকল্প গ্রহণ করা। তিস্তা নদীকে ঘিরে একটি মহাপরিকল্পনার কথা আমরা দীর্ঘদিন ধরে শুনে আসছি। ওই পরিকল্পনায় নদী ও নদীপারের মানুষের কৃষি-অর্থনীতি-জীবনের নিরাপত্তা আছে কি না, আমরা জানি না। তবে মহাপরিকল্পনা হোক কিংবা অন্য কোনো প্রকল্প হোক, বিজ্ঞানসম্মতভাবে নদী, নদীপারের মানুষের স্বার্থে তা গ্রহণ করা জরুরি। তিস্তার সুরক্ষায় সাড়ে আট হাজার কোটি টাকার কথা বলা হয়েছে। এই টাকায় কিংবা তার বেশি টাকায় যদি নদীটির বিজ্ঞানসম্মতভাবে পরিচর্যা করা যায়, তাহলে রংপুর অঞ্চলের গড় দারিদ্র্যের হার দ্রুতই কমিয়ে আনবে। কিন্তু এ কাজই-বা কে করবে! সরকারই তো আমাদের ভরসার জায়গা।

তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক

[email protected]