রইজ-হামজাদের চিনতে ভুল হয় কেন?

এই তো বছর দুই আগের কথা। ২০২০ সালে স্বাধীনতা পুরস্কারের তালিকায় নাম উঠেছিল এম রইজ উদ্দিন আহম্মদের। সাহিত্যে অবদানের জন্য সাবেক সরকারি এই কর্মকর্তাকে রাষ্ট্রীয় এই পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা এসেছিল। তখন বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন এভাবে, ‘এবার সাহিত্যে স্বাধীনতা পুরস্কার পেলেন রইজউদ্দীন, ইনি কে? চিনি না তো।’

চরম ক্ষোভের মুখে রইজ উদ্দিনের পুরস্কার বাতিল হলেও দুই বছর পর শামসুজ্জামান খান বেঁচে থাকলে তিনি হয়তো আবারও লিখতেন ‘সাহিত্যে স্বাধীনতা পুরস্কার পেলেন আমির হামজা, ইনি কে? চিনি না তো।’ শামসুজ্জামান খান এই পৃথিবীতে না থাকলেও এবারও আমাদের লিখতে হয়েছে, ‘আমির হামজা কে?’ আর তাঁকে জানতে পত্রিকাগুলোর বিশেষ প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে।

বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ঘোষণার পর প্রতিবছর পুরস্কারপ্রাপ্ত কাউকে না কাউকে নিয়ে এ বিদঘুটে প্রশ্ন আমাদের স্বরূপকে চিনিয়ে দেয়। রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত অনেককে চিনতে না পারা আমাদের মতো সাধারণদের নতুন কিছু নয়। আবার অখ্যাত-কুখ্যাত কাউকে কাউকে টেনে এনে রাষ্ট্রীয় পুরস্কারকে বারবার কলঙ্কিত করা হয়। যোগ্যদের চিনতে না পারা কিংবা অযোগ্যদের টেনেহিঁচড়ে মঞ্চে তোলার সংস্কৃতি আমাদের শুধু লজ্জায় দিচ্ছে না, আমাদের জাতি অস্তিত্বেও টান পড়ছে।

কিন্তু তা হওয়ার কথা ছিল না, গুণীদের গুণের সম্মান দিয়ে জাতিকে এগিয়ে নেওয়ার যে প্রত্যয় তা আমাদের কর্মস্পৃহাকে বাড়িয়ে তুলত। জাতি বিনির্মাণে নবপ্রজন্মকে পথ বাতলে দিত। সেটি না করে, প্রতিবছর এই সব পুরস্কার নিয়ে বিতর্ক ছড়িয়ে আমরা হতাশ হয়ে পড়ছি। আমির হামজাদের চিনতে আতশি কাচ লাগছে। আসলেই কি তা হওয়ার কথা ছিল? পত্রিকার খবর দেখেই–বা আমাদের কেন আমির হামজাদের গল্প শুনতে হচ্ছে? তাঁদের সংবাদ সংগ্রহ করতে সাংবাদিকদেরই–বা কেন বেগ পেতে হচ্ছে?
এই যে তামাম দুনিয়ার সম্মানিত পুরস্কার ‘নোবেল’–এর কথাই ধরুন না কেন। ১২০ বছর ধরে তারা যে পুরস্কার দিয়ে আসছে, তা নিয়ে আমাদের প্রশ্ন করার শক্তি বা সাহসই–বা কতটুকু থাকছে? আমির হামজা যদি সাহিত্যে নোবেল পেতেন, তাহলে নোবেল কমিটি সংবাদ সম্মেলনে এসে কী বলত জানেন? তারা বলত, এই আমির হামজা সাহিত্যের ঠিক কোন জায়গায় অবদান রেখেছেন, কোন বই তাঁকে স্মরণীয় করে তুলেছে? তারা কখনোই খোঁজ নিতে যেত না আমির হামজার ছেলে কোন মুল্লুকের চাকুরে। নিজের কৃতকর্মেই প্রস্ফুটিত হওয়ার সুযোগ পেতেন আমির হামজা।

শুধু নোবেল পুরস্কার নয়, পৃথিবীর সব বড় বড় রাষ্ট্রীয় পুরস্কার দেওয়ার আগে পদকগ্রহীতার বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানাশোনার রেওয়াজ রয়েছে। প্রতিবেশী ভারতের কথায় বিবেচনাও যদি করেন, তাহলে দেখবেন ভারতরত্ন, পদ্মবিভূষণ, পদ্মভূষণ ও পদ্মশ্রীপ্রাপ্তদের বিষয়ে তাঁরা সংক্ষিপ্ত পরিসরে কী ধরনের পরিচয় তুলে ধরেছে। অথচ আমাদের দেশে পুরস্কারপ্রাপ্তদের ছবি তো দূরে থাক, তাঁদের বিষয়ে জানতেই আমাদের কাঠখড় পোড়াতে হয় অনেক সময়। ঠিক কী কারণে প্রযুক্তির এই যুগেও এই সেকেলে সংস্কৃতি আমাদের নীতিনির্ধারকেরা বহন করে আসছে, তা সত্যি আমার বোধগম্য হয়নি।

অথচ প্রথম আলোয় প্রকাশিত খবরটি দেখেন, আমির হামজাকে সাহিত্যিক বানাতে কী সব হাস্যকর কর্মকাণ্ডই না করেছে তাঁর সন্তানেরা। একটি বই ভেঙে দুইটি বই করা হয়েছে, যার একটিতে শিরোনাম করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। পুরস্কার সংশ্লিষ্ট দায়িত্বে থাকাদের সহানুভূতি আদায়ে শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছেন তাঁরা। আমির হামজাকে যে সচিব মনোনীত করেছেন, সহকর্মীর বাবা হিসেবে ‘সরল বিশ্বাসে’ কাজটি করে দিয়েছেন তিনি। আজকাল তো এই কৌশলে আমাদের যাবতীয় পুরস্কার বাগিয়ে নেওয়া যাচ্ছে!

দীর্ঘদিন ধরে, মূলত যাঁরা রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পান, পুরস্কার কমিটি তাঁদের কেবল নামের তালিকা সংবাদমাধ্যমে পাঠিয়ে দায়িত্ব সমাপ্ত করে। আর নামের তালিকাগুলো যখনই পত্রপত্রিকায় আসে, তখন আমরা জানতে পারি অমুক ব্যক্তি শিক্ষাবিদ, তমুক ব্যক্তি অর্থনীতিবিদ কিংবা সাহিত্যিক। অথচ পুরস্কার দেওয়ার দায়িত্বে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের উচিত ছিল পুরস্কারপ্রাপ্তদের সংক্ষিপ্ত বৃত্তান্ত তুলে ধরা। ঠিক কোন কারণে, কোন অবদানের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভূষিত করা হচ্ছে, তার সারাংশ তুলে ধরা। যাতে করে পদকপ্রাপ্তদের বিষয়ে জানতে কারও বিভ্রান্তি না ছড়ায়। এর ফলে পুরস্কারপ্রাপ্তদের সম্মান যেমন বৃদ্ধি করা যায়, তেমনি পুরস্কার পাওয়ার যোগ্যতার স্বচ্ছতা রক্ষা করা সম্ভব হয়।

কিন্তু সেটি না করে, আমাদের পুরস্কারদাতারা ‘চুপিসারে’ নামের তালিকা করেই যাচ্ছেন। কারণ, পদকপ্রাপ্তদের বিষয়ে কিছু লিখতে হলে, তাঁদের বিষয়ে পড়াশোনা করতে হবে, তাঁদের জানতে হলে তাঁদের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করতে হবে। সেই সময়ের ফুরসত কোথায় তাঁদের? সারা দিন দাপ্তরিক কাজে ব্যস্ত থাকা এই সব মানুষ কীভাবে সাহিত্য বুঝবেন? কীভাবে অর্থনীতির প্যারামিটার পরিমাপ করবেন? কীভাবে সাংবাদিকতার ওজন দেখবেন? ঠিক কোন কাঠামোতে পুরস্কার দেওয়া হয়, তা স্পষ্ট করা সময়ের দাবি। কিন্তু পদক দেওয়ার ব্যক্তি কিংবা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর অযৌক্তিক আচরণ আমাদের ভাবিয়ে তুলছে।

শুধু নোবেল পুরস্কার নয়, পৃথিবীর সব বড় বড় রাষ্ট্রীয় পুরস্কার দেওয়ার আগে পদকগ্রহীতার বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানাশোনার রেওয়াজ রয়েছে। প্রতিবেশী ভারতের কথায় বিবেচনাও যদি করেন, তাহলে দেখবেন ভারতরত্ন, পদ্মবিভূষণ, পদ্মভূষণ ও পদ্মশ্রীপ্রাপ্তদের বিষয়ে তাঁরা সংক্ষিপ্ত পরিসরে কী ধরনের পরিচয় তুলে ধরেছে। অথচ আমাদের দেশে পুরস্কারপ্রাপ্তদের ছবি তো দূরে থাক, তাঁদের বিষয়ে জানতেই আমাদের কাঠখড় পোড়াতে হয় অনেক সময়। ঠিক কী কারণে প্রযুক্তির এই যুগেও এই সেকেলে সংস্কৃতি আমাদের নীতিনির্ধারকেরা বহন করে আসছে, তা সত্যি আমার বোধগম্য হয়নি।

আরও পড়ুন

এই ধরেন, একুশ পদকের কথা। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ২০১৯ সালে একুশে পদকসংক্রান্ত একটি নীতিমালা তৈরি হয়। সেখানে পাঁচজন সদস্যের একটি সাব-কমিটিতে রয়েছেন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী অথবা প্রতিমন্ত্রী, একই মন্ত্রণালয়ের সচিব, তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন, যাঁকে যুগ্ম সচিব পদমর্যাদাসম্পন্ন। বলা হচ্ছে যখন যে কর্মকর্তা এই পদে থাকেন, পদাধিকারবলে তাঁরা প্রতিবছর একুশে পদকের বাছাই কমিটিতে থাকেন।
আমরা কেউ সবজান্তা নই। তাই একেকজনের বিশেষ জানাবোঝার ক্ষেত্র একেকটা হয়ে থাকে। যেমন অর্থনীতিকে জানতে একজন অর্থনীতিপড়ুয়ার প্রয়োজন হয়, ঠিক তেমনি চিকিৎসাবিজ্ঞানকে জানতে হলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তরদের দ্বারা সম্ভব হয় না। অথচ আমরা পদক কমিটিগুলো অকার্যকর করে রেখেছি। অমুক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী-সচিব পদাধিকারবলে কমিটিগুলোতে থাকছেন, তাঁরাই আড়ালে–আবডালে আমির হামজা, রমিজদের আনছেন।

ফলে মসলিনকে পুনরুজ্জীবিত করা অধ্যাপক মনজুর হোসেন কিংবা নিউক্লিয়ার ফিজিকসে একাডেমিশিয়ান অধ্যাপক অরুণ কুমার বসাকরা পুরস্কার কমিটির নজর থেকে যোজন যোজন দূরত্বে থাকছেন। জীবদ্দশায় মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হওয়ায় মরণোত্তর পুরস্কার দিয়ে অসাড় তৃপ্তির ঢেকুর তুলে কোনো লাভ নেই। এসব পুরস্কারে মৃতদের সম্মান জানানো হয় না, বরং তাঁদের নিয়ে মশকরা করা হয়। যে ব্যক্তিকে আপনি বেঁচে থাকার সময় দিনের পর দিন অবহেলা করলেন, মৃত্যুর পর তাঁকে মহান বানানো একধরনের অপমান।

আরও পড়ুন

আমাদের এ সংস্কৃতি থেকে বের হতে হবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষে আমরা যখন নিমেষে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তের খবর পেতে কয়েক সেকেন্ড সময় নিচ্ছি না, তখন রাষ্ট্রের একজন সূর্যসন্তানকে স্বীকৃতি দেওয়ার পর আমাদের জানতে বেগ পেতে হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় পুরস্কার নিয়ে প্রায়ই যে বিতর্ক ওঠছে, তার আশুসমাধান প্রয়োজন। স্বচ্ছতা না আনতে পারলে এসব মূল্যবান পুরস্কারের গ্রহণযোগ্যতা যেমন হারাবে, তেমনি গুণীদের কদর বুঝতে নতুন প্রজন্ম ব্যর্থ হবে। আমি চাইব সরকার তার পুরস্কার কমিটির নীতিমালার সংস্কার করুক। যে যে কাজে পারদর্শী, তাঁদের দায়িত্ব দিক, অন্তত তাঁরা যেন আমির হামজার মতো কাউকে পুরস্কার দেওয়ার আগে শতবার ভাবে।

ড. নাদিম মাহমুদ গবেষক, ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। [email protected]