আইন কমিশন: রজতজয়ন্তীতে হোক স্বাধীন সংস্থা

অধ্যাপক শাহ আলম স্যার মনেপ্রাণে আইনের বড় সংস্কার দেখতে চেয়েছিলেন। পারেননি। তিনি দূর আকাশের তারা হলেন। তাঁর চলে যাওয়া একটি সত্যিকারের শূন্যতা। তিনি জ্ঞানী ছিলেন। কিন্তু নীতি–নৈতিকতাবিবর্জিত জ্ঞানী ছিলেন না। তাঁর বুদ্ধি তাঁর ব্যক্তিগত স্বার্থকে গভীরতর করার কাজে ব্যবহৃত হয়নি। সত্য প্রকাশে তিনি যথাসম্ভব অকপট ছিলেন। একজন বিনয়ী, নিরহংকার, মিতভাষী ও ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মানুষের প্রতিচ্ছবি ছিলেন তিনি। আমরা একটা প্রচণ্ড বৈরী ও ক্ষয়ানুকূল সময় অতিক্রম করছি, যেখানে আদর্শবাদী মানুষের বড় আকাল। তাঁর প্রস্থানে বাংলাদেশ একজন আলোকিত মানুষ হারাল। একজন সাদা মনের মানুষ হারাল।

আমরা আইন কমিশনকে স্বাধীন ও মর্যাদাসম্পন্ন একটি কার্যকর সংস্থা হিসেবে দেখতে চাই। ২৪ বছর চলমান, আইন কমিশনের রজতজয়ন্তী আসন্ন। শাহ আলম স্যারকে স্মরণ প্রসঙ্গে আইন কমিশনের একটা সালতামামি হতেই পারে। রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (আইন বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান) শিক্ষকতায় এবং জীবনের শেষ পর্বে আইন কমিশনের কাজেই প্রধানত তাঁর জীবন উৎসর্গীকৃত। কিন্তু একবুক হতাশা নিয়ে কমিশন থেকে প্রস্থান করেছিলেন তিনি।

১৯৬১ সালে আইয়ুব খান মুসলিম পারিবারিক আইনের যে সংস্কার করেছিলেন, তার সঙ্গে তুলনীয় সংস্কার বাংলাদেশ দেখেনি। তিনি দেখেছিলেন আইন কমিশনের প্রতি নির্বাহী বিভাগ ও আইনসভার সীমাহীন উপেক্ষা। ২০১০ সালে বিচারপতি আবদুর রশীদ আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পদত্যাগ করেছিলেন। তিনিও বড় মাপের আইন সংস্কারের স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়িত হতে দেওয়া হয়নি। আইন কমিশনের চেয়ারম্যান পদটিতে কেন জানি শুধু অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিদেরই দেখা যায়। সেখানে ব্যতিক্রম ছিলেন বিচারপতি আবদুর রশীদ। অবশ্য তিনি যখন চেয়ারম্যান হন, তখন সেখানে এম এ মোবারক (পরে নির্বাচন কমিশনের সদস্য) ছিলেন কমিশনের অন্যতম সদস্য। দেশের একমাত্র অবসরপ্রাপ্ত সচিব, যাঁর সেখানে ঠাঁই হয়েছিল। আইনে তাঁর জ্ঞান ছিল অগাধ। তাঁর কাছ থেকেই শোনা, তিনি নবাগত চেয়ারম্যানকে বলেছিলেন, আপনি হাইকোর্টের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি ছিলেন। অথচ গোটা আইন কমিশন তো আইন মন্ত্রণালয়ের অধিভুক্ত একটি প্রতিষ্ঠান। তার মানে চেয়ারম্যান পদধারী হলে কী হবে? এটা তো সচিবের অধীনে। গত রোববার তাঁকে ফোন করলে তিনি এ বিষয়ে বলেন, আপনি আইন কমিশনের আইনটি পড়ুন। দেখবেন, এর কোথাও স্বায়ত্তশাসন বা স্বাধীনতা বিষয়ে কোনো কথা নেই। আইনটি পড়ি। দেখি, লেখা: ‘সরকার তার শর্তে নিয়োগ দেবেন। শুনানির সুযোগ দিয়ে অপসারণ করবেন।’

আইন মন্ত্রণালয়ের অধীন আইন কমিশনের উচিত হবে নিজের জন্য একটি উপযুক্ত সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করা। প্রশাসন ক্যাডারের কবজাবন্দী (লক্ষণ ইতিমধ্যে স্পষ্ট) হতে না দেওয়া। আমজনতার চোখে কমিশনকে সরকারের আজ্ঞাবহ হতে না দেওয়া

এ প্রসঙ্গে বাহাত্তরের সংবিধানের মূল ৯৯ অনুচ্ছেদের কথা মনে পড়ল। তাতে অবসরের পর চাকরি নিষিদ্ধ ছিল। বিচার বিভাগ ও বিচারপতির স্বাধীনতা সুরক্ষার সেটাই প্রকৃত ঢাল ছিল। জেনারেল জিয়া প্রথম এটা নষ্ট করেন। বাকশালে বঙ্গবন্ধু এটা করেননি।

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে প্রশ্নবিদ্ধ উপায়ে বিচার বিভাগীয় পদ–পদবি বণ্টন প্রতীয়মান হওয়া পীড়াদায়ক।

বলছিলাম শাহ আলম স্যারের হতাশার কথা। বিচারপতি রশীদের প্রতিবাদী পদত্যাগের পর সরকার তাঁকে দায়ে ঠেকে ‘ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান’ করেছিল। কিন্তু যথেষ্ট যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তাঁকে চেয়ারম্যানের পদ দেওয়া হয়নি। তাই বলি, কেবল অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান করার প্রশ্নবিদ্ধ রেওয়াজ বদলানোর দাবি রাখে।

১৮৩৪ সালে এই উপমহাদেশের প্রথম আইন কমিশনটির চেয়ারম্যান সেই বিখ্যাত লর্ড ম্যাকুলে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ছিলেন না। সেই কমিশনের অন্য তিন সদস্যেরও কেউ বিচারক ছিলেন না। তাঁদের হাতে গড়া দণ্ডবিধি, ১৮৬০, পুলিশ আইন, ১৮৬১ এবং সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২ আজও আপন গরিমায় বলবৎ। ড্রাফটসের চমৎকারিত্ব কী করে কালজয়ী হতে পারে, এসব আইন তারই সাক্ষ্য বহন করছে।

ভারত ও অস্ট্রেলীয় ইতিহাসে বিচারকের বাইরে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান নিয়োগের ইতিহাস অবশ্য আছে। সে কারণে একটা সুপ্ত আশা ছিল। স্যারের চেয়ারম্যান হওয়া প্রসঙ্গে আমরা পরস্পর একাডেমিক আলোচনা করেছি।

অস্ট্রেলীয় মানবাধিকার কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান রোজালিন ক্রোচার স্বনামধন্য শিক্ষাবিদ। আইনের এই অধ্যাপক রোজালিনের সঙ্গে ১৯৮২ সালে মস্কোর প্যাট্রিস লুমুম্বা গণমৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমুদ্রবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রিধারী শাহ আলম স্যারের কিছু মিল ছিল। দুজনে একইভাবে আইন কমিশনের সদস্য হয়ে ঢুকেছেন। রোজালিন সদস্য থেকে চেয়ারম্যান হয়েছেন। শাহ আলম স্যার ঘটনাচক্রে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হয়েছেন মাত্র।

২০১০ সালের ২৭ অক্টোবর (বিচারপতি রশীদের ইঁদুর দমনের পর) লিখেছিলাম, গতকালই নতুন চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত) হিসেবে নিয়োগ পেলেন ড. এম শাহ আলম। তাঁকে অভিনন্দন। তিনিও একদিন যাবেন। মন্ত্রিত্বও ঠুনকো। কিন্তু তাঁরা কি অদৃশ্য ইঁদুর তাড়াতে পারবেন? সরকার (হাইকমান্ড) না চাইলে কী হয়, তার জ্বলন্ত উদাহরণ দুদক, তথ্য ও মানবাধিকার কমিশনের মতো ‘স্বাধীন’ সংস্থা। এরা সবাই জীবন্মৃত।

পাঁচ বছর পর ‘জীবন্মৃত’ অবস্থায় থেকেই একটা মৃদু ঝাঁকুনি দিয়েছিলেন তিনি। আইন কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের সঙ্গে সংবাদ সম্মেলনে হাজির তিনি। দিনটি ছিল ১ জানুয়ারি ২০১৫। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি গরম তথ্য প্রকাশ করলেন। বললেন, ছয় বছর ধরে তিনি আইন কমিশনের সদস্য। এ সময়ে আইন কমিশন নতুন আইন প্রণয়ন ও বিদ্যমান আইন সংশোধনের ৩৯টি সুপারিশ সরকারের কাছে পাঠিয়েছে। কিন্তু একটি সুপারিশও বাস্তবায়িত হয়নি।

পরদিন পত্রিকায় ছাপা হলো, একমত হতে পারেননি আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য। রাগ করে সংবাদ সম্মেলন থেকে উঠে চলে গেলেন বিচারপতি খায়রুল হক। প্রথম আলোতেই এই শিরোনাম ছাপা হলো।

অথচ এটা কোনো মতামতের বিষয় ছিল না। স্যারের তথ্য ভুল না ঠিক, সেটাই প্রশ্ন ছিল।

স্যার প্রয়াত হয়েছেন। প্রশ্নটি মিলিয়ে যায়নি। আইন মন্ত্রণালয়ের অধীন আইন কমিশনের উচিত হবে নিজের জন্য একটি উপযুক্ত সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করা। প্রশাসন ক্যাডারের কবজাবন্দী (লক্ষণ ইতিমধ্যে স্পষ্ট) হতে না দেওয়া। আমজনতার চোখে কমিশনকে সরকারের আজ্ঞাবহ হতে না দেওয়া।

মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক

[email protected]