রফিকুল হায়দার চৌধুরী

শহীদ বুদ্ধিজীবী, জীবনবিমা কর্মকর্তা, বিক্রমপুর, মুন্সিগঞ্জ, ঢাকা

রফিকুল হায়দার চৌধুরী

সাহিত্যিক ছিলেন রফিকুল হায়দার চৌধুরী (ঈষিকা)। কর্মজীবনে ছিলেন একটি জীবনবিমা কোম্পানির কর্মকর্তা।

সক্রিয় বা পরোক্ষভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও রাজনীতিসচেতন ছিলেন। স্বাধিকারের আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছেন।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মুক্তিযুদ্ধের কাজে পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছেন।


একাত্তরের ১৩ ডিসেম্বর সকাল সাতটায় রফিকুল হায়দার চৌধুরীকে তাঁর শহীদবাগের ভাড়া বাসা থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এ-দেশীয় দোসর আলবদর বাহিনীর সদস্যরা ধরে নিয়ে যায়।

এরপর তিনি আর ফিরে আসেননি। তাঁর মরদেহ পাওয়া যায়নি। ১২ ডিসেম্বর রাতে তিনি তাঁর স্ত্রীকে বলেছিলেন, আর মাত্র তিন-চার দিন কষ্ট করলেই দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে। কিন্তু সেই স্বাধীনতা তিনি দেখে যেতে পারেননি।

এ ঘটনা সম্পর্কে জানা যায় তাঁর স্ত্রী হাসিনা চৌধুরীর ‘আমার স্বামী’ রচনা থেকে। তিনি লিখেছেন, ‘দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পর এল স্বাধীনতা।

কিন্তু এই স্বাধীনতা আমার জীবনে বড় নিষ্ঠুর। কঠিন বাস্তবের নিষ্ঠুর কশাঘাতের মাঝেও এই স্মৃতি আমাকে প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে বেড়ায়।

সে স্মৃতি মনে ভেসে উঠলেই সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে যায়। সেই দিনটি, যে দিনটি কেড়ে নিয়েছে আমার সবচেয়ে আপন মানুষটি, কেড়ে নিয়েছে আমার সব সুখ, শান্তি, আশা, ভরসা।

হারিয়ে যাওয়ার ১০ ঘণ্টা আগেও যে মানুষটি দেখিয়েছিলেন কত সুখের স্বপ্ন, শুনিয়েছিলেন আশার বাণী।

বলেছিলেন, আর তিন থেকে চারটা দিন কষ্ট করলেই দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে। কথাগুলো বলেছিলেন ১২ ডিসেম্বর রাত নয়টায়।

এর মাত্র ১০ ঘণ্টা পর এল সেই অশুভ তারিখ ১৩ ডিসেম্বর। ‘আমরা তখন থাকতাম ৯২১ শহীদবাগের বাড়ির দোতলায়। বাড়ির মালিক আজিজুল্লাহ সাহেব থাকতেন তিনতলায় আর নিচতলায় যিনি বাস করতেন, তিনি একটি ব্যাংকে কর্মরত ছিলেন।

পরে জেনেছি তিনি জামায়াতের রমনা শাখার সেক্রেটারি ছিলেন। ‘১৩ ডিসেম্বর, সকাল সাতটা।

শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল। সবেমাত্র ঘুম থেকে উঠে বিছানায় বসে আছি দুই মাসের ছেলেটিকে কোলে নিয়ে।

আমার স্বামীও উঠে চেয়ারে বসেছে। এমন সময় বাসার কলবেল বাজতে শুরু করল। সামনে মেয়ে দাঁড়িয়ে।

ওকে ওর বাবা বলল, “দেখো তো কে এসেছে।” মেয়ে দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলেই দেখে চারজন খাকি পোশাকধারী, মুখে সাদা রুমাল বাঁধা, হাতে রাইফেল।

মেয়েকে তারা জিজ্ঞাসা করেছে, “তোমার বাবা কোথায়?”

ও ভয়ে দৌড়ে এসে জানাল, “পাপ্পা, চারজন পুলিশ।” এর মধ্যে ওরা সবাই আমাদের শোবার ঘরে ঢুকে পড়েছে এবং রাইফেল তাক করে উর্দুতে বলল, “বাত মাত বলিয়ে, গোলি মার দেঙ্গে।” আর আমার স্বামীকে বলল, “হ্যান্ডস আপ, আপকা নাম?”

সে নাম বলার সঙ্গে সঙ্গে ইশারায় ঘর থেকে বের করে নিয়ে গেল। মেয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠল।

আমি নির্বাক হয়ে বারান্দায় বেরিয়ে এলাম, কিন্তু ততক্ষণে ওরা সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামিয়ে নিয়ে গেছে গেটের কাছে।

আমি বারান্দা থেকে নিচে তাকিয়ে দেখি, ওরা রুমাল দিয়ে ওর হাত পেছনে বাঁধছে। তখনো সারা শহরে কারফিউ চলছে।

এরপর আর কোনো কিছুই আমার স্মরণ নেই। হারানো জ্ঞান যখন ফিরে পেলাম, জানলাম আমার সব শেষ হয়ে গেছে।

স্বাধীনতা আমার সাজানো সংসারটা কেড়ে নিয়েছে। হারিয়ে গেল সে আমার জীবন থেকে।

হারিয়ে গেল চিরদিনের জন্য, কোনো দিন আর এল না ফিরে।’ (স্মৃতি: ১৯৭১, তৃতীয় খণ্ড, সম্পাদনা রশীদ হায়দার, প্রকাশ ১৯৯০)।


রফিকুল হায়দার চৌধুরীর জন্ম ১৯৩৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর, মুন্সিগঞ্জ জেলার বিক্রমপুর পরগনার অন্তর্গত শ্রীনগর উপজেলার সোনাকান্দা গ্রামে।

১৯৪৯ সালে মুন্সিগঞ্জের জেসি বোস ইনস্টিটিউশন থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৫৩ সালে দার্জিলিং থেকে বিজ্ঞানে স্নাতক সম্পন্ন করেন।


রফিকুল হায়দার চৌধুরী গল্প ও উপন্যাস লিখতেন। মূলত কথাসাহিত্যিক। তবে কিছু কবিতাও লিখেছিলেন। তাঁর লেখা কবিতা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।

তাঁর রচিত রম্যরচনা ‘স্মৃতা’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে। এরপর সম্ভাবনা ও পুরান প্রেমের ইতিকথা নামে দুটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়।

জার্নাল নামে আরও একটি উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি চূড়ান্ত করেছিলেন। উপন্যাসটি প্রকাশ হওয়ার আগেই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।


তাঁর স্ত্রীর রচনা থেকে আরও জানা যায়, রফিকুল হায়দার চৌধুরী কিছুটা বিশৃঙ্খলা, খামখেয়ালি ও উদাসীন প্রকৃতির ছিলেন।

যতটা সংসারী হওয়া প্রয়োজন, তা তিনি ছিলেন না। তবে পড়াশোনায় ছিল তাঁর ব্যাপক আগ্রহ।

প্রতিকৃতি: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (চতুর্থ পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৫) থেকে।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান।
[email protected]