রমনা - বিগত বসন্ত

বসন্তে পার্কের সবচেয়ে নজরকাড়া ফুলের নাম ব্রুনফেলসিয়া
বসন্তে পার্কের সবচেয়ে নজরকাড়া ফুলের নাম ব্রুনফেলসিয়া

‘বসন্ত-প্রভাতে এক মালতীর ফুল’। স্বপ্নোদিত ভাবনা। বসন্তে মালতীলতায় ফুল ফোটে না, ফোটে বর্ষায়। সে জন্যই হয়তো কবির আক্ষেপ: ‘কবে কোন ফাল্গুনে ছিনু আমি তব ভরসায়/ এলে তুমি ঘন বরষায়।’
বসন্ত-প্রভাতে ফোটে মাধবী। ‘বসন্তের জয়রবে/ দিগন্ত কাঁপিল যবে/ মাধবী করিল তার সজ্জা।’ বড়ই স্বল্পায়ু মাধবীর জয়রব। ‘মাধবী হঠাৎ কোথা হতে এল ফাগুন দিনের স্রোতে/ এসে হেসেই বলে “যাই যাই যাই”।’ মাধবী আছে রমনা পার্কে, শতায়ু অঙ্গনের পশ্চিম চত্বরের তোরণগুলোর একটিতে। আরেকটি আছে মাঠের ওপাশে ঝোপ হয়ে। ফুল ফোটে মধ্য-ফেব্রুয়ারিতে, অপূর্ব সুগন্ধি, ভ্রমরপ্রিয়। থাকে হপ্তা দুই। মাধবীর খানিকটা উত্তরে আরেকটি তোরণে আছে বিউমন্টিয়া। ঘণ্টাকার বড় বড় সাদা ফুল, ভারি দৃষ্টিনন্দন।
বসন্তে পার্কের সবচেয়ে নজরকাড়া ফুলের নাম ব্রুনফেলসিয়া। ঝোপালো গুল্ম। নিষ্পত্র গাছ ভরে ফোটে বেগুনি ও সাদা রঙের ফুল। তাজা ফুল বেগুনি, বাসি ফুল সাদা। বাতাসে ভাসে মধুগন্ধ। পুষ্পসম্ভারে নজরকাড়া পার্কের দুটি গাছ—পলকজুঁই ও সাদা রঙ্গন। তিন-চার মিটার উঁচু গাছ, পত্রঘন, সাদা সুগন্ধি ফুলের থোকায় গাছ ভরে থাকে। পলকজুঁই থাকে অল্প দিন, সাদা রঙ্গন অনেক দিন। একই আকারের আরেকটি গাছ হলো ক্যালিয়েন্ড্রা, তবে এতটা পত্রঘন নয়, যৌগপত্রগুলোও সরু সরু। দুটি জাত। একটি লাল ফুলের, অন্যটি সাদা গোলাপি। থোকা থোকা ফুল, নয়নভোলানো। গুস্তাভিয়াও প্রায় একই উচ্চতার গাছ, বড় বড় পাতা, ডালের আগায় দু-তিনটি ফুল, বেশ বড়, গোলাপি রঙের, সুগন্ধি। দক্ষিণের খালপারের গেটের ভেতরে যে গাছটি বেগুনি-নীল ফুলের ছোট ছোট থোকায় ভরে থাকে, সেটি হলো অঞ্জন। চোখ ফেরানো যায় না।
দুর্লভ শুদ্ধ নীল রঙের ফুলের কয়েকটি জ্যাকারান্ডা গাছও আছে পার্কে। লম্বাটে, কমনীয় গঠন, পাতা ঝালরের মতো। ডালের আগায় লম্বা ডাঁটায় ফুল, অপূর্ব শোভা। এবার এখনো ফুল ফোটেনি, ফুটবে মধুমাধব বৈশাখে। পার্কের একমাত্র কনকচাঁপা গত বছর ভুলবশত কাটা পড়ে। এখন সেখানে আছে গোড়া থেকে গজানো একটা ঝোপ এবং একটা নতুন চারাগাছ। বসন্তে কনকচাঁপার নিষ্পত্র গাছে তামাটে কচি পাতা আর সোনালি ফুলের ঢল নামে। অতুলন সৌরভ। এবার এই ঝোপে কয়েকটিমাত্র ফুল ফুটেছে। গৌরীচৌরী হালকা-পাতলা গাছ, ঝোপও বানানো যায়, থোকা থোকা হলুদ ফুল, গাছ ভরে ফোটে।
বাগানবিলাসের অনেকগুলো ঝাড় আছে পার্কে, সবই লাল ও বেগুনি রঙের। সাদা, হলুদ ও মিশ্র রঙের বাগানবিলাস সম্ভবত লাগানো হয়নি। সব কটি জাত সঠিকভাবে লাগালে পার্কে রঙের ঝরনা ঝরত।
রমনা পার্ক প্রকট বৃক্ষময়, প্রাধান্য মেহগনি ও রেইনট্রির। পার্কের জন্য অনাকাঙ্ক্ষিত ও বড়ই বেমানান। যে তিনটি বৃক্ষ বসন্তের স্বাগতিক—শিমুল, পলাশ ও গ্লিরিসিডিয়া—তাদের প্রথমটি, অর্থাৎ শিমুল রেকর্ডে আছে, দৃশ্যত নেই। সাদা শিমুল আছে কয়েকটি, গোড়ায় চ্যাপ্টা অধিমূল দেখে সহজেই চেনা যায়। বিশাল বৃক্ষ, ঢাউস ডালপালা। ছোট ছোট সাদা রঙের ফুল ঝরে পড়ে নিচে, শেষে সাদা তুলোর আস্তর বিছায়। পলাশ আছে কয়েকটি। নিষ্পত্র গাছে কমলা রঙের ফুলের ঝরনা ঝরে। ‘এক রাত্রে বর্ণবহ্নি জ্বালাল সমস্ত বন জুড়ি।’ ইংরেজি নাম ফ্লেম অব দ্য ফরেস্ট। অরণ্যের অগ্নিশিখা। পুষ্পপাগল এই গাছে মধুলোভী পাখিদের ভিড় জমে, সংখ্যাধিক্য কাঠশালিকের, টিয়াও বাদ পড়ে না। দুঃখের বিষয়, অসতর্ক রোপণে গাছগুলো অন্য গাছের আড়ালে পড়ে গেছে। পার্কে দু-তিনটি গ্লিরিসিডিয়া আছে, কিন্তু আশপাশের বড় বড় গাছের জন্য তাদের না আছে সুষ্ঠু গড়ন, না দেখা যায় প্রস্ফুটনের শোভা। বেশ বড় গাছ, ডালগুলো নোয়ানো, নিষ্পত্র গাছে বসন্তের শুরুতে ফুল ফোটে, ফুলে সাদা রঙে হালকা বেগুনি আঁচ। গোটা গাছটিকে তখন প্রকাণ্ড এক স্তবকের মতো দেখায়। অশোকের একটি বীথি আছে পার্কে। কমলা লাল থোকা থোকা ফুল, গাছের শরীরজুড়ে ফোটে—কাণ্ডে, শাখায় এবং সুগন্ধি ছায়াঘন এ গাছ পাতা ঝরায় না।
পার্কে কাঠগোলাপের গাছ আছে কয়েকটি, সব কটিই সাদা ফুলের। গড়ন দেখেই গাছটি চেনা যায়। মূল কাণ্ড ক্রমান্বয়ে ভাগ হতে হতে ওপরের দিকে ওঠে ও ছড়াতে থাকে। ডালগুলো পুরুষ্টু। বসন্তে নিষ্পত্র গাছের ডালের আগায় বড় বড় ফুলের বড় বড় থোকা। ফুল সুগন্ধি। কাঠগোলাপের হালকা লাল ও গাঢ় লাল জাতও আছে। রক্তকাঞ্চন বসন্তের ফুল। পাতাঝরা গাছে লাল রঙের অজস্র ফুল ফোটে। পাঁচটি খোলা পাপড়ি, সামনেরটি কারুকার্যময়। একটি দুধসাদা ভ্যারাইটিও আছে। ভারি নজরকাড়া। জোড়া পাতা দেখে কাঞ্চনকে সহজেই শনাক্ত করা যায়।
নাগেশ্বর পার্কের প্রধান পুষ্পবৃক্ষ। শতায়ু অঙ্গন ঘিরে আছে একটি লম্বা সারি। কৌণিক গড়নের চিরসবুজ গাছ, ডালের আগায় জোড়া ফুল থাকে। ‘হেলিয়া দুলিয়া পড়ে নাগকেশরের ফুল’। সাদা রঙের পাঁচটি ছড়ানো পাপড়ি, মাঝখানে সোনালি কেশরের একটি থোকা। ‘মধু গন্ধে ভরা’। রমনার সবচেয়ে আকর্ষণীয় ফুলগাছ নাগলিঙ্গম আছে কয়েকটি। ব্যতিক্রমী গড়নের বড় বড় ফুল, ডালের বদলে ফোটে কাণ্ড থেকে গজানো লম্বা লম্বা অনেকগুলো ঝুলন্ত ডাঁটায়। পাপড়ির ভেতরের রং লাল বা গোলাপি, সুগন্ধি। ফুল ঝরায়। কয়েক মাস পরপর পাতাও। মিলেসিয়া (মণিকাঞ্চন) মিয়ানমারের প্রজাতি। পার্কে আছে একত্রে কয়েকটি, গাছগাছালির ভিড়ে। নিষ্পত্র গাছে লম্বা লম্বা ছড়ায় ছোট ছোট ফুল, হালকা গোলাপি, গাছতলায় ঝরে পড়ে আবির ছড়ায়। মনে পড়ে ষাটের দশকের গোড়ার দিকে এখানকার জিরো পয়েন্টে গাছগুলো প্রথম দেখি। যাচ্ছিলাম বাসে নটর ডেম কলেজে। জিপিওর স্টপে নেমে পড়ি। ‘একি এ সুন্দর শোভা’। চোখ ফেরাতে পারি না। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম। কুসুমগাছ আছে অরুণোদয় গেট থেকে পার্কের নার্সারি পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে। বিশাল বৃক্ষ। সম্ভবত রমনা গ্রিনের স্থপতি প্রাউডলকের লাগানো। বসন্তের শুরুতে সারা গাছে নতুন পাতা গজায়, টকটকে লাল। থাকে অল্প দিন। তারপর সবুজের নানা আঁচে পাতার রংবদল ঘটে।
পরিশেষে দুলিচাঁপা। আমাদের একমাত্র বুনো ম্যাগনোলিয়া। অতিবিপন্ন প্রজাতি। লাগিয়েছিলাম সিলেটের পাথারিয়া পাহাড় থেকে এনে। গতবার অল্প কয়েকটি ফুল ফুটেছিল। এবার হয়তো বেশি ফুটবে। বড় বড় পাতা, বড় বড় ফুল ডালের আগায়, সাদা ও সুগন্ধি। অরুণোদয় গেট পেরিয়ে ডান দিকের মৌসুমি ফুলের কেয়ারি পেরিয়ে কিছু দূর গেলেই বাঁয়ে আছে গাছটি। এখনো বৃক্ষ হয়ে ওঠেনি।
বসন্ত শেষে একটি সুসংবাদ আছে। পূর্ত বিভাগ লেকসহ গোটা পার্কের সৌন্দর্যায়নের এক ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। মন্ত্রী মহোদয়ের প্রণোদনায় লাগানো হবে নানা রঙের ফুলের অনেকগুলো গাছ আর সেই সঙ্গে মৌসুমি ফুলের বড় বড় কেয়ারি, লতানো ফুলের আর্চ এবং একটি গোলাপবাগান। সবই পরিকল্পিত নকশায়। বৃক্ষনৈরাজ্য হটিয়ে পার্ককে বানানো হবে একটি ল্যান্ডস্কেপ গার্ডেন। অদূর কোনো বসন্তে আমরা রমনার নয়নাভিরাম শোভা দেখার অপেক্ষায় রইলাম। তবে রমনার বটমূলে সেই শোভার একটি আগাম খণ্ডচিত্র টানিয়ে রেখেছেন এই কর্মযজ্ঞের অন্যতম স্থপতি তুঘলক আজাদ।
দ্বিজেন শর্মা: নিসর্গবিদ।