নববর্ষে আজকাল বেশ রসগোল্লা পাচ্ছি উপহার হিসেবে। আপনাদের রসগোল্লার ভাগ দিতে পারছি না, আপাতত বলতে পারি, সৈয়দ মুজতবা আলীর রসগোল্লা গল্পটি পড়ে নিন। তবে দেশ-বিদেশের রসগল্প তো ভাগ করে নিতেই পারি।
নাসির উদ্দিন হোজ্জার ওই গল্পটা মনে করুন। হোজ্জার কাছে এসেছেন পড়শি—হোজ্জা, তোমার গাধাটা একটু ধার দেবে? হোজ্জা বললেন, আমার গাধা তো একটু আগে আরেকজন ধার নিয়ে চলে গেছে। তখনই গাধা ডেকে উঠল উঠান থেকে। পড়শি বললেন, ওই যে তোমার গাধা ডাকছে! নাসির উদ্দিন বললেন, তুমি আমার কথার চেয়ে একটা গাধার কথাকে বেশি বিশ্বাস করো, আমি কী করে তোমাকে আমার গাধা ধার দেব বলো।
কবি হাফিজ লিখলেন, তুর্কি রূপসীটি যদি আমার হৃদয় গ্রহণ করে, আমি সমরখন্দ আর বোখারা তার ওই এক কালো তিলের বিনিময়ে দিয়ে দিতে পারি। শুনে বাদশাহ তৈমুর লং ডেকে পাঠালেন কবিকে, বললেন, একটা মেয়েমানুষের মুখের তিলের জন্য কেউ সমরখন্দ কিংবা বোখারা দিয়ে দেয়? আর শোনো, এই দুই রাজ্য তোমার না। আমি ওই রাজ্যের অধিকার কোনো দিন তোমাকে দেবও না। তুমি কীভাবে আমার রাজ্য অন্যকে দান করছ?
শুনে কবি বললেন, এই যে আপনার ক্ষুদ্রতা আর কৃপণতা, তাই আপনাকে দিয়েছে ক্ষমতা। আর আমার উদারতা আমাকে আপনার ক্ষমতার অধীনস্ত করেছে আর আমাকে করেছে অমিতব্যয়ী। কোনোই সন্দেহ নেই যে আপনার ক্ষমতা আমার বেহিসাবিপনার চেয়ে বেশি কার্যকর।
আজ পয়লা বৈশাখ। আজকের দিনে আগে একটা বাঙালির হাসির গল্প বলে নিই। বাদশাহ বললেন, বীরবল, তুমি আমার রাজ্য থেকে সবচেয়ে বোকা লোককে ধরে আনো। বীরবল বললেন, এ তো খুব সোজা। এক নম্বরে থাকবে আপনার নাম। কারণ, গত বছর তুরস্ক থেকে এক ঘোড়ার সওদাগর এসে বলল, আগামী বছর আপনার জন্য সে ঘোড়া নিয়ে আসবে, আপনি তাকে অগ্রিম মোহর দিলেন। সে মোহর নিয়ে কেটে পড়েছে। আপনার চেয়ে বোকা আর কে আছে? বাদশাহ বললেন, আর যদি সে ফিরে আসে? বীরবল বললেন, তখন আপনার নাম কেটে তার নাম বসিয়ে দেব।
বীরবল বের হলেন পথে পথে। ফিরে এসে তিনি কতগুলো বোকা মানুষের গল্প শোনালেন। যেমন: এক লোক রাস্তার ধারে আলোর নিচে কী যেন খুঁজছে। বীরবলও তার সঙ্গে খুঁজতে লাগলেন। বললেন, কী হারিয়েছে? পয়সা। কত পয়সা? এক পয়সা। কোথায় পড়েছে? ওই ওখানে? তা ওখানে না খুঁজে এখানে খুঁজছ কেন?
লোকটা বলল, ওখানে তো আলো নেই। তাই ওখানে খুঁজছি না। এখানে তো আলো আছে। তাই এখানে খুঁজছি।
আরেক লোককে বীরবল দেখে সে জাল ফেলছে শুকনো ডাঙায়। শুকনো ডাঙায় কী ধরছ? লোকটা বলল, আমার ঘর দিনের বেলায়ও অন্ধকার। আমি তাই জাল দিয়ে আলো ধরছি। ঘরে আলো নিতে হবে।
ছোটবেলায় এই গল্প পড়ে খিলখিল করে হাসতাম।
অন্ধকার তাড়ানোর জন্য তরবারি ঘুরিয়ে লাভ নেই। অন্ধকার দূর করার একটাই উপায়, তা হলো আলো জ্বালানো।
একটা বিদেশি গল্প কদিন আগে গদ্য কার্টুনে লিখেছিলাম। এক ধনাঢ্য ব্যক্তি তার তিন ছেলেকে তিনটা টাকা দিয়ে বললেন, আজ সন্ধ্যার মধ্যে এমন কিছু কিনে আনবে যেন দেখি তোমার ঘর ভরে গেছে। বড় ছেলে কিনে আনল খড়, মেজ ছেলে তুলা। ছোট ছেলে কী কিনল, কেউ দেখতেই পেল না। সন্ধ্যার পর বাবা বড় ছেলের ঘরে ঢুকে দেখলেন খড় ছড়ানো, মেজ ছেলের ঘরে তুলা উড়ছে, আর ছোট ছেলে? সে পকেটে করে এনেছিল একটা মোমবাতি, তাই সে জ্বালিয়েছে, ঘর আলোয় আলোয় ভরে উঠেছে। আমাদের আলো জ্বালাতে হবে।
কবি হাফিজ অমিতব্যয়ী, বেহিসাবি, তাই তৈমুর লং ক্ষমতাবান। ক্ষমতার অনেক হিসাব-নিকাশ থাকে। হিসাব কষলে কবিদের চলে না। আর আমরা একটা গাধার ডাককে বিশ্বাস করব, নাকি বিশ্বাস করব গাধার মালিকের মুখের কথায়, সে বিষয়টাও তো স্থির নয়।
গোপাল ভাঁড়ের গল্প না বললে পয়লা বৈশাখের লেখা অসম্পূর্ণ থাকে। এক লোক দশটা ভাষা জানে। একবার হিন্দি বলে, একবার পারসি বলে, একবার সংস্কৃত বলে, একবার পশতু বলে। রাজা বললেন, এ আসলে কোন দেশি। বের করো তো গোপাল। গোপাল ভাঁড় হঠাৎ পেছন থেকে তার মাথায় মারলেন বাড়ি, সে চিৎকার করে উঠল, ওরে মারে মেরে ফেলল রে, খেয়ে ফেলল রে। গোপালভাঁড় বললেন, মহারাজ, ও বাঙালি। বিপদেই মানুষ কেবল নিজের পরিচয় বের করে। নিজের ভাষায় কথা বলে।
আজকে আমাদের পেছন থেকে আঘাত আসছে। আজকে আমাদের সমস্ত বাঙালিত্ব নিয়ে মা বলে ডেকে ওঠার সময়। আপনি চেষ্টা করলে আপনার পাসপোর্ট বদলাতে পারেন, আমেরিকান হতে পারেন, অস্ট্রেলিয়ান হতে পারেন। মাইকেল মধুসূদনের মতো কেউ আবার ধর্মও বদলাতে পারেন। কিন্তু আপনার নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, আপনার গায়ের রং, আপনি যে বাঙালি—এটা আপনি কিছুতেই মুছতে পারবেন না। আমাদের জিনের মধ্যে হাজার হাজার বছর ধরে সেটা বয়ে যাচ্ছে।
আমরা তাই নগরবাসী হই, কিন্তু ঈদে ফিরে যাই আদিবাড়িতে, আমরা আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, সুইডেনে গিয়ে মাছের ঝোল রাঁধি, শুঁটকি রেঁধে এলাকার বাতাস ম-ম করে ফেলি, আমাদের আমেরিকান বাচ্চারা বড় হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে মাকে ফোন করে বলে, আমি ফিরছি, ভাত আর মাংসের ঝোল রাঁধো, আমি হাত দিয়ে মেখে ভাত খাব। মা ভাত রেঁধে নিজ হাতে মেখে ধিঙ্গি সন্তানকে তুলে তুলে খাওয়ান, ছেলে খায়, আর ইংরেজি কওয়া জিবে বলে, আমার মা সবচেয়ে ভালো।
বাংলাদেশ যে স্বাধীন হলো, উপমহাদেশে আর কোনো জাতিরাষ্ট্র নেই, এই এক বাংলাদেশ ছাড়া, এর কারণ আমাদের সংস্কৃতির শিকড় অনেক গভীরে প্রোথিত, তা গভীর থেকে শক্তিসুধা তুলে এনে আমাদের ঋদ্ধ করে প্রতিনিয়ত।
সংস্কৃতির চিহ্নের ওপরে আঘাত করতে গিয়ে আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান, মোনেম খানরা পালিয়েছে। বাংলা ভাষায় কথা বলা, বাংলা গান গাওয়ার অধিকার প্রতিষ্ঠা করব বলে আমরা স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছি। আজ আমাদের সংস্কৃতির ওপরে আঘাত আসছে। সে আঘাত আমাদের ঐক্যবদ্ধ করুক। আমাদের নতুন করে জাগিয়ে তুলুক। সংস্কৃতির নবজাগরণ আমাদের আরও ঋদ্ধ করুক। আলো জ্বলে উঠুক কোটি প্রাণে।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।