রাখাইনরা কি ‘উন্নয়ন’ উদ্বাস্তু হয়ে যাবে

গত কয়েক দিনে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ও সরাসরি স্থানীয় সূত্রে আমরা জানতে পেরেছি, পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার ছয়আনীপাড়ার ছয়টি রাখাইন পরিবারকে কোনো ধরনের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদের পাঁয়তারা চলছে। পায়রা তৃতীয় সমুদ্রবন্দরের জন্য জমি অধিগ্রহণের আওতায় পড়ায় প্রায় ৩০০ বছরের প্রাচীন রাখাইনপল্লি নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে।

অভিযোগ আছে, বন্দরের জন্য জমি অধিগ্রহণের সময় পাড়াটিকে বাদ দেওয়ার দাবি জানিয়ে এলেও কর্তৃপক্ষ তাদের দাবি তোয়াক্কা না করে কয়েক মাস আগে থেকে বারবার নোটিশ দিয়ে আসছিল। পরে বাড়িঘরসহ বিদ্যমান অবকাঠামোর বিপরীতে ক্ষতিপূরণ ও যথাযথ পুনর্বাসনের জন্য দাবি জানানো হলেও সেটির সুরাহা না করেই প্রতিদিন যন্ত্রপাতি নিয়ে একটু একটু করে গ্রামের বিভিন্ন জায়গা ভাঙা হচ্ছে। গত ১০ জুন রাতের আঁধারে রাখাইনপল্লির প্রবেশপথ কেটে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। প্রথা অনুযায়ী প্রতি রাখাইন গ্রামে দুটি শ্মশানভূমি থাকে। যার মধ্যে শত বছরের পুরোনো শ্মশানভূমি পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ কোনো রকম অনুমতি ও আলোচনা ছাড়াই ইতিমধ্যে বালু দিয়ে ভরাট করে ফেলেছে। অন্য শ্মশানভূমির ওপর রাস্তা নির্মাণ চলছে। বালু ফেলে নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে তাদের সংরক্ষিত সুপেয় পানির পুকুর। এতে পাড়ার রাখাইনদের মধ্যে বিরাজ করছে ক্ষোভ, অসন্তোষ আর উচ্ছেদ-আতঙ্ক। আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন তাদের অস্তিত্ব ভয়াবহ সংকটপূর্ণ।

কলাপাড়া উপজেলার টিয়াখালী ইউনিয়নের মধ্যটিয়াখালী গ্রামের এই ছয়আনী রাখাইনপাড়ায় একসময় বাস ছিল কয়েক শ রাখাইন পরিবারের। এখন আছে সামান্যই, ছয়টি পরিবারে মোট সদস্য রয়েছেন ২৮ জন। এ পাড়ার মোট জমির পরিমাণ আট একর। এর মধ্যে ছয়টি পরিবারের বাড়িঘরসহ অধিগ্রহণের আওতায় পড়া জমির পরিমাণ ৫ একর ৫৪ শতক, যার মূল্য সাড়ে তিন কোটি টাকার মতো। এ জমির মালিকানা নিয়ে স্থানীয় গাজী আব্বাস উদ্দিন বাচ্চু নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে বিরোধের জেরে হাইকোর্ট বিভাগে একটি মামলা চলমান রয়েছে।

যেহেতু ভূমির মালিকানা নিয়ে আদালতে মামলা চলমান, সেহেতু জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাঁদের জমির ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়টি আপাতত অনিশ্চিত জেনে রাখাইনরা বলেছিলেন, তাঁদের বাড়িঘর, অবকাঠামোর বিপরীতে অ্যাওয়ার্ড বা ক্ষতিপূরণের টাকা বুঝে পেলে তাঁরা চলে যাবেন। কিন্তু সেই অ্যাওয়ার্ডের সরকারনির্ধারিত ৯১ লাখ ৪৭ হাজার টাকা জেলা প্রশাসনের অধিগ্রহণ শাখা থেকে অদ্যাবধি তাঁদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি।

উপরন্তু কথিত এক দাবিদার সাদিকুর রহমান অধিগ্রহণ শাখায় লিখিত আপত্তি দিয়ে রেখেছেন, যার শুনানি হবে ১৫ জুলাই। অভিযোগ আছে, অধিগ্রহণ শাখার কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে কথিত দাবি নিয়ে কিছু মধ্যস্বত্বভোগী বা দালাল এ ধরনের আপত্তি দিয়ে ইতিমধ্যে ক্ষতিপূরণের অর্থের একটি বিরাট অংশ আত্মসাৎ করে ফেলেছে।

স্থানীয় ভুক্তভোগী রাখাইনদের বক্তব্যমতে, বন্দর কর্তৃপক্ষ ছয়আনীপাড়াবাসীকে বন্দরের জন্য নির্মিত গুচ্ছগ্রামে স্থানান্তর করতে চাইছে। সেই গুচ্ছগ্রামে থাকতে হবে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিবাসী নয় এমন লোকজনের সঙ্গে, যেখানে তাঁরা থাকতে চাইছেন না। কেননা, ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিবাসীরা তাঁদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও স্বতন্ত্র জীবনধারা অনুযায়ী বসবাস করেন। শত বছরের পুরোনো ঐতিহ্য, বটগাছ, বৌদ্ধমন্দির এবং সাংস্কৃতিক নানা উপাদান ছেড়ে বাঙালি-অধ্যুষিত সেই গুচ্ছগ্রামে থাকতে চান না। কিন্তু প্রশাসনকে তাঁরা এটা জানালেও প্রশাসন নির্বিকার।

পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে ৫ জুলাই জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বন্দর কর্তৃপক্ষ ও ভুক্তভোগী ক্ষুদ্র জাতিসত্তার প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নেয়। আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয়, স্থায়ী পুনর্বাসনের আগপর্যন্ত ছয়টি রাখাইন পরিবারের দায়িত্ব নেবে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ। এ ক্ষেত্রে আলোচনার পর জেলা প্রশাসকের বক্তব্য হলো, ‘পায়রা বন্দরের সঙ্গে সমন্বয় করে ছয়টি রাখাইন পরিবারের অন্তত ২৭ থেকে ২৮ জনকে ওই উপজেলার পরিবেশসম্মত ভাড়া বাসায় রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে।’

আমরা এ আলোচনার জন্য জেলা প্রশাসনের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। তবে আমরা একই সঙ্গে হতাশ যে সরকারি প্রশাসন এখনো এটি অনুধাবন করতে পারছে না যে রাখাইনদের কৃষ্টি-কালচারের সঙ্গে এ ধরনের ভাড়া বাসা কিংবা গুচ্ছগ্রাম কোনোভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আমরা মনে করি, রাখাইনদের পক্ষ থেকে কোনো একটি রাখাইন গ্রামে তাঁদের পুনর্বাসনের যে দাবি করা হয়েছে, সেটি তাঁদের জীবন-জীবিকার সুরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য অত্যাবশ্যক।

আমরা বন্দরের জন্য জমি অধিগ্রহণ কিংবা ‘উন্নয়ন’ প্রকল্পের বিরুদ্ধে নই। কিন্তু জমি অধিগ্রহণের নামে যথাযথ পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ ছাড়া সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষকে তাঁদের বসতভিটা ও জমি থেকে উচ্ছেদের বিপক্ষে।

রাখাইনদের জমি, পুকুর, শ্মশানসহ সবকিছু দখল হয়ে যাচ্ছে বলেই নিজ ভূমি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন তাঁরা। জালিয়াতির মাধ্যমে জমি জবরদখল, রাজনৈতিক প্রভাবশালী ও স্বার্থান্বেষী দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের নিষ্ক্রিয়তার কারণে তাঁরা তাঁদের ভূমি হারাচ্ছেন প্রতিনিয়ত।

বন্দরের জন্য জমি অধিগ্রহণের সময় গ্রামটাকে বাদ দেওয়ার দাবি জানানো হলেও সেটি মানা হয়নি। জাতিসংঘের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিবাসী–বিষয়ক ঘোষণাপত্রের ১০ নম্বর অনুচ্ছেদে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিবাসী-অধ্যুষিত জায়গায় কোনো উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণের আগে স্থানীয় লোকজনের মতামত নিতে হবে, সেটাও এ গ্রামের ক্ষেত্রে অনুসরণ করা হয়নি।

আমরা এই ছয়টি রাখাইন পরিবারকে উচ্ছেদের প্রক্রিয়া বন্ধের আহ্বান জানাই। একই সঙ্গে নিম্নলিখিত দাবিগুলো পূরণের জন্য সরকারের কাছে আহ্বান জানাই: এক. অবিলম্বে কলাপাড়া উপজেলার ছয়আনীপাড়ার ছয়টি পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ ও তাদের সংস্কৃতি ও জীবনধারার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়—এমন জায়গায় পুনর্বাসন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে; দুই. মৃতদেহ সৎকারের জায়গা ও বৌদ্ধবিহার নির্মাণের জায়গা ও অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে; তিন. অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যোগ্যতা অনুযায়ী পায়রা বন্দরে তাঁদের বা সন্তানদের চাকরির ব্যবস্থা করতে হবে; চার. রাখাইনদের ভূমি অধিকার সুরক্ষায় স্থানীয় প্রভাবশালী ভূমিদস্যু, দালালদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে; পাঁচ. রাখাইন জনগোষ্ঠীসহ সমতলের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিবাসীদের ভূমি অধিকার সুরক্ষা ও ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য একটি পৃথক আদিবাসী ভূমি কমিশন প্রতিষ্ঠা ও কার্যকর করতে হবে।

আমরা বন্দরের জন্য জমি অধিগ্রহণ কিংবা ‘উন্নয়ন’ প্রকল্পের বিরুদ্ধে নই। কিন্তু জমি অধিগ্রহণের নামে যথাযথ পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ ছাড়া সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষকে তাঁদের বসতভিটা ও জমি থেকে উচ্ছেদের বিপক্ষে। এটা সবাই স্বীকার করে যে বৃহত্তর পটুয়াখালী অঞ্চলের বিস্তীর্ণ জমিকে রাখাইন জনগোষ্ঠীই তাদের ঘাম ও রক্ত দিয়ে বাসযোগ্য ও আবাদযোগ্য জমিতে পরিণত করেছিলেন। তাঁদের অন্যতম প্রধান নেতা উ সু য়ে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধে অনবদ্য ভূমিকা রেখেছিলেন। আজ সেই রাখাইন জনগোষ্ঠী উন্নয়নের নামে উচ্ছেদের সম্মুখীন, জালিয়াতি ও জবরদখলের দ্বারা তাঁদের জমি কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। এই মুহূর্তে রাখাইন জনগোষ্ঠীর ভূমি, জীবন-জীবিকা রক্ষার্থে প্রয়োজন সাহায্য-সহযোগিতা ও নৈতিক সমর্থন।

লেখকবৃন্দ মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক, অ্যাকটিভিস্ট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।