রাজকোষ থেকে চুরি

বাৎস্যায়ন তাঁর কামসূত্র-এ একজন মডেল নাগরিককে যে চৌষট্টি কলা রপ্ত করার নিদান দিয়েছেন, তার মধ্যে একটি হচ্ছে ‘চুরিবিদ্যা’। চুরিবিদ্যা হয় বড়, ধরা যদি নাহি পড়ো। প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রে দুই ধরনের চোরের অস্তিত্বের কথা জানা যায়: ১. প্রকাশ চোর ও ২. অপ্রকাশ চোর। প্রকাশ্যে ছিনতাই, ডাকাতি, মাস্তানি, তোলাবাজি...যারা করে, তারা ‘প্রকাশ চোর’। ফাইল আটকে যারা ঘুষ নেয়, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে থেকে কমিশন খায়, নিজের কাজ ঠিকমতো করে না...তারা ‘অপ্রকাশ চোর’। বাংলাদেশের তথাকথিত ভদ্রলোকদের মধ্যে অনেকেই কমবেশি অপ্রকাশ চোর।
ইংরেজ আমল শুরু হওয়ার আগে বাংলাদেশের রাজপথ নিয়ন্ত্রণ করত ঠগিরা। এত ঠগি ছিল কোনো কোনো এলাকায় যে ‘ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়’ হয়ে যেত। ঠগিদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান দুই–ই ছিল। ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে দিনক্ষণ দেখে তারা বেরিয়ে পড়ত রাস্তায়। কোনো পথিক বা তীর্থযাত্রী দেখলে তাদের সঙ্গে ভাব জমাত। তারপর সুযোগ বুঝে দলপতি বলে উঠত: ‘সাহেবলোগ, তামাকু লাগাও!’ সংকেত পাওয়ামাত্র ঠগিরা গলায় রুমাল পেঁচিয়ে খুন করত তাদের শিকারকে। তারপর শিকারের সর্বস্ব হাতিয়ে নিয়ে লাশগুলো মাটিচাপা দেওয়া হতো।
চোখে বিষাক্ত মলম, মরিচের গুঁড়া লাগিয়ে নিরীহ পথিকের সর্বস্ব কেড়ে নেওয়া বাংলাদেশে এখনো নিত্যদিনের ঘটনা। রাতের ট্রেনে সামান্য কয়েক শ টাকার জন্য কোনো অসহায় যাত্রীকে খুন করে লাশ বাইরে ছুড়ে ফেলার বহু ঘটনা ঘটছে ইদানীং, যার একটি সামান্য অংশই মিডিয়া তুলে ধরতে সক্ষম হচ্ছে। ব্যাংকের এটিএম বুথ থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে দেশি-বিদেশি ঠগিরা। সম্প্রতি বিদেশে গচ্ছিত রাখা বাংলাদেশের রিজার্ভ থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার হাতিয়ে নিয়েছে কিছু বিদেশি ডিজিটাল ঠগি এবং (অর্থমন্ত্রীর সন্দেহ) কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ঘাপটি মেরে থাকা তাদেরই কিছু ‘(চোরে চোরে) মাসতুতো ভাই’। অপহৃত অর্থ ব্যবহৃত হয়েছে ক্যাসিনোতে, জুয়াখেলায়। প্রাচীনকাল থেকেই চোর ও জুয়াড়ি যে হরিহর আত্মা, তার প্রমাণ ‘জুয়াচোর’ শব্দটি।
রিজার্ভে হ্যাকিংয়ের ঘটনা কি এর আগেও ঘটেছে? হ্যাকিং বা দুর্নীতির যেসব ঘটনা প্রকাশ পাচ্ছে, সেগুলো হিমশৈলের দৃশ্যমান উপরিভাগ নয়তো? রাজকোষের অর্থ চুরি হয়েছে গত ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমে। কোষাধ্যক্ষ চুরির ব্যাপারটা গোপন রাখায় সরকার ঘটনাটি জেনেছে প্রায় এক মাস পর, মার্চের প্রথমে। মিডিয়া না জানালে আদৌ কি আমরা জানতে পারতাম, আমাদের এত বড় সর্বনাশ ঘটে গেছে? যদি কোনো রাখাল ছাগল চুরি যাওয়ার খবর এক মাস পর্যন্ত মালিকের কাছে গোপন করে, তবে তার সততা নিয়ে প্রশ্ন না থাকতে পারে, কিন্তু দায়িত্বহীনতার দায় কি সে এড়াতে পারে? অবিমৃশ্যকারিতার একটা সীমা থাকা উচিত। কোনো দুষ্কর্ম থেকে আর্থিকভাবে লাভবান না হলেই যে-কাউকে সৎ বলতে হবে—এমন কোনো কথা নেই। বাংলাদেশের এক ‘শহীদ’ সিপাহসালার আর্থিক দিক থেকে সৎ ছিলেন, কিন্তু আশপাশের অনেককেই তিনি চরম অসৎ করে তুলেছিলেন কার্যে ও চিন্তায়।
সরকারের বিভিন্ন অঙ্গের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব থাকলে ছিদ্রপথে ঠগিরা ঢুকে পড়ে সরকারকে আরও অনেক বড় বিপদে ফেলতে পারে। এ ধরনের বিপদ এড়াতে প্রাচীন ভারতের শাস্ত্রকারেরা রাজাকে তিন সেট গুপ্তচর রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। প্রথম ও দ্বিতীয় সেট পরস্পরকে চিনবে না। তৃতীয় সেট প্রথম ও দ্বিতীয় সেটের কাজের ওপর নজর রাখবে। গুপ্তচরের জাল ছড়িয়ে থাকবে সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বত্র। এই তিন সেট গুপ্তচরের পাঠানো খবর যাচাই করে রাজা প্রতি রাতে পরবর্তী দিনের সিদ্ধান্ত নেবেন। গুপ্তচর ভুয়া খবর দিচ্ছে কি না, তা-ও খেয়াল রাখতে হবে রাজাকে। চোখ দিয়ে নয়, রাজা প্রধানত কান দিয়ে দেখবেন। রাষ্ট্র পরিচালনার এসব সুচিন্তিত দিকনির্দেশনা মেনে চললে পিলখানার বিদ্রোহ বা রিজার্ভ চুরি যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটার আশঙ্কা অনেকটাই কমে যাওয়ার কথা। তবে সরিষার ভেতরেই যদি ভূত থাকে, তবে সরিষা দিয়ে ভূত তাড়ানো মুশকিল।
রবীন্দ্রনাথের ‘পরিশোধ’ কবিতার কাহিনিতে রাজকোষে চুরি হয়েছিল। ‘ধরে আন্ চোর,/ নহিলে নগরপাল, রক্ষা নাহি তোর’। রাজাদেশে নগরপাল রক্ষীদের পাঠালেন চোর ধরতে। চোর ধরা কি ‘ছেলের হাতের মোয়া’? সুতরাং সহজ কাজটাই করল রক্ষীরা। বজ্রসেন নামে এক অশ্ব ব্যবসায়ী দস্যুহস্তে সর্বস্ব হারিয়ে মনের দুঃখে শুয়ে ছিল এক ভাঙা মন্দিরে। রক্ষীরা তাকেই চোর সাব্যস্ত করে রাজার কাছে নিয়ে যাচ্ছিল। নগরনটী শ্যামা জানালা দিয়ে বজ্রসেনের সুন্দর চেহারা দেখে মুগ্ধ হয়ে তার সমস্ত সম্পদের বিনিময়ে বন্দীকে মুক্ত করতে বৃথা অনুরোধ করল নগরপালকে। ‘তব অনুনয় আজি ঠেলিনু সুন্দরী...বিনা কারো প্রাণপাতে নৃপতির রোষ শান্তি মানিবে না।’ শ্যামার অনুরোধে তার কিশোর প্রেমিক উত্তীয় রাজার কাছে গিয়ে চুরির দায় স্বীকার করে। মুক্ত বজ্রসেনকে নিয়ে শ্যামা চলে যায় মধুচন্দ্রিমা যাপনে।
‘যার ধন তার নয়, নেপোয় মারে দই’! দেশি-বিদেশি নেপোরা কি কল্পনা করতে পারেন, মধ্যপ্রাচ্যের ৫০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় মরুভূমিতে কী দারুণ শারীরিক-মানসিক কষ্ট আর অপমান সয়ে দেশের শ্রমিকেরা এক-একটি দিনার-রিয়াল উপার্জন করে? দেশের যে নাগরিকেরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অর্জিত আয়ের একাংশ তুলে দিচ্ছে সরকারের হাতে আয়কর বা মূসক হিসেবে, তারা হয়তো কখনোই জানতে পারবে না, কে প্রকৃত চোর, উত্তীয়, নাকি বজ্রসেন, নাকি বাইরের কোনো হ্যাকার ‘বুধো’, যার ‘ঘাড়ে চাপানো হয়েছে’ ঘরের কোনো ‘উদোর পিণ্ডি’।
খাম্বা, খেলাপি ঋণ, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির পরে ঠগিদের টুপিতে যুক্ত হওয়া নতুন এই পালক: রিজার্ভ হ্যাকিং—জাতীয় সম্পদ লুটপাটের সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি। পাকিস্তানের ২৪ বছরে পাঞ্জাবি ঠগিরা যে পরিমাণ শোষণ করতে পেরেছিল বাঙালিদের, স্বাধীনতার ৪৫ বছরে বাঙালি ঠগিরা তার শতগুণ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এক এক সরকার আসে আর নতুন ঠগির দল লুটপাটের চৌকস সব উপায় বের করতে কোমর বেঁধে লেগে পড়ে। কোন সরকারের কী কী অর্জন, তার একটা হিসাব যেমন থাকা দরকার, তেমনি কোন সরকারের আমলে রাষ্ট্রীয় তহবিল কীভাবে, কতটা তছরুপ হলো, তারও একটা তুলনামূলক চিত্র তৈরি করা গেলে ভোটের আগে জনগণের সুবিধা হতো।
জনগণের জানমাল রক্ষার দায়িত্ব সরকারের। বাংলাদেশে জানের নিরাপত্তা কখনোই ছিল না। এখন মালও অনিরাপদ হয়ে পড়েছে, ঘরে ও বাইরে। ‘আমার আসলে কী হয়েছে?’—এক উদ্বিগ্ন রোগী জিজ্ঞেস করেছিল ডাক্তারকে। নিরুদ্বেগ ডাক্তার উত্তর দিয়েছিল, ‘আপনার আসলে কী হয়েছে, তা জানা যাবে ময়নাতদন্তের পর!’
শিশির ভট্টাচার্য্য: অধ্যাপক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।