রাজনীতি, কূটনীতি ও জাতীয় স্বার্থ

সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার পর রাখাইন রাজ্যের মংডু থেকে পালিয়ে বেঁচেছেন এই নারী
সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার পর রাখাইন রাজ্যের মংডু থেকে পালিয়ে বেঁচেছেন এই নারী

ফরাসি প্রেসিডেন্ট শার্ল দ্য গল বিচক্ষণ রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন। তাঁর বিখ্যাত উক্তি: রাজনীতির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শুধু রাজনীতিবিদদের ওপর ছেড়ে দেওয়া যায় না। এর অনুকরণে আমরা বলতে পারি, কূটনীতি এমন জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে তা শুধু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়। কোনো দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যদি দক্ষ, কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন ও দেশপ্রেমিক কর্মকর্তাদের দ্বারা পরিচালিত না হয়, তাহলে সেই দেশের গণতান্ত্রিক সরকারও কূটনৈতিক ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করতে পারে না। কূটনৈতিক ক্ষেত্রে অদক্ষতার কারণে একটি দেশের অবস্থান আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দুর্বল হয়।

একাত্তরে অল্প সময়ের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনে তখনকার বাঙালি কূটনীতিবিদদেরও ভূমিকা ছিল। তাঁরা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিভিন্ন দেশের পাকিস্তানি দূতাবাস ও কূটনৈতিক মিশন থেকে বেরিয়ে গিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পাকিস্তানের অবস্থান দুর্বল হতে থাকে। পাকিস্তানি ফরেন সার্ভিসের কর্মকর্তারা ছিলেন সুশিক্ষিত ও দক্ষ। তাঁদের পেশাদারি ছিল আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন। কঠিন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চাকরিতে যোগদানের পরে তাঁদের যে প্রশিক্ষণ হতো তা ছিল উঁচু মানের। তাঁদের সবারই ইংরেজি ভাষায় অসামান্য দক্ষতা তো ছিলই, অনেকেই আরও কোনো কোনো ভাষা জানতেন।

রাষ্ট্রের স্বাধীনতা–সার্বভৌমত্ব রক্ষায় শক্তিশালী প্রতিরক্ষা বাহিনীর সঙ্গে দক্ষ কূটনৈতিক ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা সম্ভব নয়। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের অব্যবহিত পরে ফারুক চৌধুরী ও তাঁর সহকর্মীদের স্বপ্রণোদিত তৎপরতায় শূন্য থেকেই বলতে গেলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যাত্রা শুরু করে। ঘটনাক্রমে ওই দপ্তরের সঙ্গে তখন আমিও কিছু সময় যুক্ত ছিলাম। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ ছিলেন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। সবার সঙ্গেই তাঁর আচরণ ছিল সৌজন্যমূলক। বঙ্গবন্ধু সরকারের আরেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেনের সময়ের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পেশাদারিতে আন্তর্জাতিক মান অর্জন করে। সেই সময় আমাদের বন্ধুদেশ যেমন ছিল, তেমনি অ–বন্ধু এমনকি শত্রুভাবাপন্ন দেশও ছিল। পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে ফরেন অফিসকে তখন বহু জটিল কাজ সমাধা করতে হতো।

জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও পেয়েছিলেন একটি দক্ষ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কূটনীতিকদের সবাই ছিলেন প্রধানত পিএফএস অফিসার। রাজনৈতিক দুর্বলতা কূটনৈতিক দক্ষতা দিয়ে পুষিয়ে নিতেন। স্বাধীনতার পরে বিভিন্ন ব্যাচে যাঁরা ফরেন সার্ভিসে যোগ দিয়েছেন তাঁদেরও অনেকে মেধাবী। কিন্তু কোনো প্রতিষ্ঠানের গৌরব নির্ভর করে ব্যক্তিবিশেষের গুণের ওপর নয়, সামগ্রিক কর্মসম্পাদন ও কৃতিত্বের ওপর।

আধুনিক যুগে বৈদেশিক সম্পর্ক চাট্টিখানি বিষয় নয়। সম্রাট আকবরের সময় অস্ট্রেলিয়া বা আমেরিকার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ভালো-মন্দে বিশেষ কিছু আসত-যেত না। কূটনীতি একালে এক কঠিন বিষয়। ভ্রাতৃপ্রতিম সম্পর্কই হোক বা বন্ধুপ্রতিম সম্পর্কই হোক, মনে করার কারণ নেই যে সবাই সব সময় ভাইয়ের মতো মমতা মাখানো বা বন্ধুর মতো অন্তরঙ্গ আচরণ করবে নিজের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে। বৈদেশিক সম্পর্ক পারস্পরিক স্বার্থনির্ভর। আমি তোমাকে দেব, তুমি আমাকে দেবে। তবে সবকিছুর ঊর্ধ্বে জাতীয় স্বার্থ। দুটি রাষ্ট্রের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রেম-প্রীতির ব্যাপার নয়; দেওয়া-নেওয়ার বিষয়; মর্যাদা ও স্বার্থরক্ষার বিষয়।

প্রসঙ্গত একটি বিষয় মনে রাখা দরকার, বৈদেশিক সম্পর্কের বিষয়ে পেশাদার কূটনীতিকেরাই সবচেয়ে ভালো বোঝেন তা নয়, অন্য পেশার মানুষও, যদি তিনি হন দেশাত্মবোধে উজ্জীবিত এবং ধীশক্তির অধিকারী, তাহলে কূটনৈতিক ব্যাপারে সফল হতে পারেন। পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুব খান তাঁর দেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী এ কে ব্রোহীকে ভারতে হাইকমিশনার করে পাঠান। তাঁর উদ্যোগে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক ভালো হতে থাকে, কারও স্বার্থে ব্যাঘাত না ঘটিয়েই। ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে ব্রোহীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের সৃষ্টি হয়। ব্রোহীর পাণ্ডিত্যের গুণগ্রাহী ছিলেন নেহরু, তিনি নিজেও ছিলেন একজন বড় পণ্ডিত। নেহরুর সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠতা ও বন্ধুত্ব আইয়ুব ও তাঁর উপদেষ্টাদের ভালো লাগেনি। তাঁরা ব্রোহীকে দিল্লি থেকে ফেরত নিয়ে যান।

এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের বৈদেশিক সম্পর্ক শুধু পেশাদার কূটনৈতিক কর্মকর্তা এবং বড় বড় পণ্ডিত ও রাজনৈতিক নেতাই ভালো বোঝেন তা নয়। দেশের সাধারণ মানুষও কম ডিপ্লোম্যাট নয়। একজন পানের দোকানি পর্যন্ত বোঝেন কোথায় দেশের স্বার্থ রক্ষিত হচ্ছে আর কোথায় বিঘ্নিত হচ্ছে। কিন্তু তাঁর করার কিছু নেই। রাষ্ট্রের অর্থভান্ডার থেকে যাঁদের বেতন-ভাতা দিয়ে রাজার হালে রাখা হয়, তাঁরা যদি দেশের স্বার্থরক্ষায় অসমর্থ হন, তাহলে সাধারণ মানুষের হতাশা প্রকাশ ছাড়া করার কিছু থাকে না। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যেও আজ একধরনের হতাশা দেখা দিয়েছে। তাদের রাজনৈতিক ব্যাপারে হতাশার মধ্যে যোগ হয়েছে কূটনৈতিক বিষয়েও হতাশা।

কূটনীতিকের কাজ জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণ। বাংলাদেশের মতো দেশ সামরিক শক্তি দিয়ে সমস্যার সমাধান করতে পারে না। সেটা তার কাম্যও নয়। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে কোনো দেশই গানবোট ও ডিপ্লোমেসিতে যায় না। নতজানু না হয়েও সমস্যার কূটনৈতিক সমাধানই শ্রেষ্ঠ পথ। দর-কষাকষি হবে বন্ধুভাবাপন্ন পরিবেশে, তবে নিজের অবস্থানে দৃঢ় থেকে। তার জন্য একজন কূটনীতিককে তাঁর দেশের রাজনৈতিক পলিসি শুধু নয়, জানতে হবে ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে। যে দেশে তিনি দায়িত্ব পালন করছেন, সে দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কেও সুস্পষ্ট জ্ঞান থাকতে হবে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বহু দেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। রাষ্ট্রের নতুন ভৌগোলিক সীমারেখা নির্ধারিত হয়েছে। ওই সব দেশ যখন স্বাধীন হয়, তখন সেখানে বসবাসরত সব মানুষই সেই রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে গণ্য হয়—তার জাতিসত্তা, মাতৃভাষা, ধর্ম-বর্ণ যা-ই হোক। সে বা তার পূর্বপুরুষ কত দিন আগে কোথা থেকে এসেছেন, সে প্রশ্ন অবান্তর। তা না হলে  যুক্তরাষ্ট্রের সব সাদা লোকের নাগরিকত্ব খারিজ হয়ে যেত স্বাধীনতার পরই। কারণ তাদের কেউ এক পুরুষ আগে কেউ দুই পুরুষ আগে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে ভাগ্যান্বেষণে ওই নতুন ভূখণ্ডে পাড়ি জমিয়েছিলেন।

আরাকানের রোহিঙ্গাদের বলা হচ্ছে ‘বাঙালি’। কখনো তাদের বলা হয়েছে চিটাগাইঙ্গা। রোহিঙ্গাদের অনেকের পূর্বপুরুষের কেউ যদি চার শ-পাঁচ শ বছর আগে চট্টগ্রাম-নোয়াখালী থেকেই হোক বা মঙ্গল গ্রহ থেকেই হোক আরাকানে গিয়ে জঙ্গল পরিষ্কার করে বসতি স্থাপন করে থাকেন, তাতে তাঁদের বংশধরেরা কোনো দোষ করেনি। আরাকানই তাদের দেশ। পৃথিবীতে আর কোথাও তাদের ‘সেকেন্ড হোম’ নেই। আরাকান প্রদেশ তাদের দেশ নয়, তারা মিয়ানমার রাষ্ট্রের নাগরিক নয়—এমন কথা বলা ঘোরতর মানবাধিকার লঙ্ঘন। রাষ্ট্রের ভূগোল বা সীমারেখা পরিবর্তন হবে আর মানুষের নাগরিকত্ব খারিজ হয়ে যাবে—এ রকম কোনো বিধি পৃথিবীতে নেই।

আরাকানের রোহিঙ্গারা, সেখানকার মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান প্রভৃতি সম্প্রদায়ের মানুষ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের বাংলায় কথা বললেও তারা বাঙালি নয়, তারা আরাকানি। আরাকানি রোহিঙ্গাদের নিয়ে কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশ ঝামেলার মধ্যে আছে। বিষয়টির কূটনৈতিক সমাধানের উদ্যোগ না নেওয়ায় তা শুধু যে অমীমাংসিত রয়ে গেছে তা-ই নয়, এখন জটিল আকার ধারণ করেছে। তারা যে বাঙালি নয়, বাংলাদেশি তো নয়ই—এই সত্য বাংলাদেশ সরকার এবং আমাদের কূটনীতিকেরা আন্তর্জাতিক ফোরামে সাবলীলভাবে প্রমাণ করতে পারেননি। সেই দুর্বলতার সদ্ব্যবহার করছে মিয়ানমারের স্বৈরাচারী সরকার।

কোনো দেশের কোনো সম্প্রদায়ভুক্ত কোনো নাগরিক যদি কোনো অপরাধ করে, রাষ্ট্রের প্রচলিত আইনে তার শাস্তি হবে। কেউ যদি চুরি করে তার শাস্তি হবে। কেউ খুন করলে তারও ফাঁসি হতে পারে। কেউ যদি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে, সেই অপরাধেরও শাস্তি আছে। কিন্তু তাকে অত্যাচার করে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেবে পাশের দেশে, সেটা আন্তর্জাতিক কোনো আইন সমর্থন করে না। কেউ দোষী সাব্যস্ত হলে তাকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া যাবে, কিন্তু তার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া যাবে না, তার সম্প্রদায়ের নারীদের ধর্ষণ করা যাবে না, তাদের গণহত্যার বস্তু করা যাবে না।

আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (সংক্ষেপে আরসা) নেতা-কর্মীরা যদি কোনো দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র করে থাকেন, রাষ্ট্র তাঁদের শাস্তি দেবে। তাঁরা বিচ্ছিন্নতাবাদী না জাতীয়তাবাদী, নাকি জাতিগত মুক্তিকামী, তা বাংলাদেশের ভাববার বিষয় নয়। আরসার নেতারা দাবি করছেন তাঁরা ‘জিহাদি’ নন, তাঁরা ধর্মভিত্তিক বিচ্ছিন্নতাবাদীও নন। তাঁরা চান মিয়ানমারের মধ্যেই তাঁদের নাগরিক অধিকার। তাঁদের রাজনীতির সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো সম্পর্ক নেই। আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যম থেকে যতটা জানা যায়, ২০১২ সালে রোহিঙ্গাদের ওপর হামলার পরই এই সংগঠনের জন্ম। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক ফোরামে জোরালো ভূমিকা রাখছে। সেখানে বাংলাদেশের কূটনীতিকদের কী ভূমিকা, তা আমাদের জানা নেই।

আমাদের দূতাবাস মিয়ানমারে রয়েছে, মিয়ানমারের দূতাবাস আছে ঢাকায়। গত দুই সপ্তাহে রোহিঙ্গাদের ওপর যে পৈশাচিক বর্বরতা ঘটেছে, যা বাংলাদেশকে একটা সংকটে ফেলে দিয়েছে। সে সম্পর্কে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যে ভূমিকা তা মানুষকে হতাশ করেছে। মিয়ানমারের হেলিকপ্টার আমাদের আকাশসীমা লঙ্ঘন করলে একটা রুটিন প্রতিবাদ করা হয়েছে। যখন বাংলাদেশ অত্যাচারিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে সমস্যায় রয়েছে, তখন ফরেন অফিসের কূটনীতিকেরা ‘সন্ত্রাস দমনে যৌথ’ তৎপরতার প্রস্তাব দেয়। ওই প্রস্তাবের অর্থ ও তার পরিণাম বাংলাদেশের সাধারণ মানুষও বোঝে। তাতে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বাড়েনি, দুর্বলতার প্রকাশ ঘটেছে।

রোহিঙ্গা সমস্যা একটি আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক সমস্যা, যে সমস্যার সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী বাংলাদেশ। অন্যেরা ঘরের খেয়ে বনের মোষ খুব বেশি দিন তাড়াবে না। এ সমস্যার রাজনৈতিক কূটনৈতিক সমাধান বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকেই করতে হবে। জাতীয় স্বার্থে সে জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও কূটনৈতিক দক্ষতা।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।