রাজনীতিতে নবীনবরণের ‘টাঙ্গাইল মডেল’

মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে টাঙ্গাইলে গিয়ে পুলিশের সামনেই ছাত্রলীগের হামলার শিকার হন গণ অধিকার পরিষদের নেতা-কর্মীরা
ছবি: সংগৃহীত

পরিবারে নতুন সদস্য এলে মিষ্টিমুখ করা হয়। রাজনীতিও দেশের বৃহত্তর পরিবার। এই পরিবারে নতুন কোনো সদস্য এলে বা নতুন দল গঠিত হলে পুরোনোদের উচিত সাদরে অভ্যর্থনা জানানো।

কিন্তু বাংলাদেশের নবীনতম দল গণ অধিকার পরিষদের নেতা-কর্মীরা যেভাবে টাঙ্গাইলে সংবর্ধিত হলেন, তাতে অতীতের ধারাবাহিকতাই রক্ষিত হয়েছে। অন্যের মুখ ম্লান করেই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা নিজেদের কৃতিত্ব জাহির করতে চেয়েছেন।

সম্প্রতি সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়ার ছেলে রেজা কিবরিয়া ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন দল গণ অধিকার পরিষদ গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। এই দল মূলত সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের সাবেক নেতা-কর্মীদের নিয়ে গঠিত। দেশের সব জেলাতেই তাদের কর্মী-সমর্থক আছে। নতুন দল করার প্রয়োজনীয়তা তখনই দেখা যায়, যখন পুরোনোরা জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে ব্যর্থ হন। পুরোনোরা বিদায় নেবেন, নতুনেরা আসবেন—এটাই চিরায়ত নিয়ম।

গণ অধিকার পরিষদের নেতারা বুধবার টাঙ্গাইলে গিয়েছিলেন মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুপুর পৌনে ১২টার দিকে ঢাকা ও টাঙ্গাইলের বিভিন্ন উপজেলা থেকে সংগঠনটির প্রায় ৫০০ কর্মী-সমর্থক জড়ো হয়েছিলেন ভাসানীর কবরের কাছাকাছি। সামনের সারিতে ছিলেন মেয়েরা। পেছনে রেজা কিবরিয়া, নুরুল হক ও অন্যরা। এ সময় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা লাঠিসোঁটা নিয়ে তাঁদের ওপর হামলা চালান। ছাত্রলীগের নেতা নিবিড় পাল, নাজিম রূপক, মানিক শীল, রবিউল ইসলাম প্রমুখ হামলায় নেতৃত্ব দেন বলে অভিযোগ আছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ রেজা কিবরিয়া, ভিপি নুরুলসহ গণ অধিকার পরিষদের বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মীকে তাদের ভ্যানে তুলে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যায়। প্রথম আলোর ছবিতে দেখা যায়, গণ অধিকার পরিষদের নেতা-কর্মীদের ভ্যানে তোলার পরও পেছন থেকে ছাত্রলীগের কর্মীরা লাঠিসোঁটা নিয়ে তাঁদের ওপর আঘাত করছেন।

রেজা কিবরিয়া ও নুরুল হক পরদিন ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, পুলিশের নিচের পর্যায়ের কর্মকর্তারা ছাত্রলীগের হামলা থেকে রক্ষা করেছেন। টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বলেছেন, দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটলে তাঁরা গণ পরিষদের নেতা-কর্মীদের নিরাপত্তা দিয়েছেন। কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, সেখানে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটেনি। ছাত্রলীগ নেতাদের দাবি, গণ অধিকার পরিষদের নেতা-কর্মীরা সরকারের বিরুদ্ধে আপত্তিকর স্লোগান দিচ্ছিলেন। আপত্তিকর স্লোগান দিলে সেটি দেখবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী; ছাত্রলীগ নয়। সংখ্যায় গণ অধিকার পরিষদের কর্মীরা বেশি থাকায় ছাত্রলীগ সুবিধা করতে পারেনি।

ছাত্রলীগ অনেক পুরোনো সংগঠন। এই সংগঠনের আছে দীর্ঘ সংগ্রামের ঐতিহ্য। তারা নবীন দলের নেতা-কর্মীদের টাঙ্গাইলে অভ্যর্থনা জানাতে পারতেন। আমরা কি এ রকম কোনো চিত্রকল্পের কথা ভাবতে পারি, বিরোধী কোনো ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরা রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক কোনো কর্মসূচিতে যোগ দিতে গেছেন এবং সেখানকার সরকার-সমর্থক ছাত্রসংগঠনটির নেতা-কর্মীরা তাঁদের ফুল দিয়ে স্বাগত জানাচ্ছেন; আবার সরকার সমর্থক ছাত্রসংগঠনটির নেতা-কর্মীরা নতুন সংগঠনের অফিসে গেলে একইভাবে উষ্ণ অভ্যর্থনা পাচ্ছেন?

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের টাঙ্গাইলে হামলার ঘটনার নিন্দা করেছেন এবং দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। গতকাল দুপুরে প্রথম আলোর টাঙ্গাইল প্রতিনিধি কামনাশীষ শেখরের সঙ্গে আলাপ করলে তিনি জানান, ওই ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। যদি মামলাই না হয়, ব্যবস্থা নেবেন কীভাবে, কার বিরুদ্ধে?

নব্বইয়ে স্বৈরাচারের পতনের পর আমরা মধুর ক্যানটিনে দু-একবার প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীদের ফুল ও মিষ্টি দিয়ে বরণ করার চিত্র দেখেছি। কিন্তু তা স্থায়ী হয়নি। স্থায়ী হয়েছে প্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের মধ্যকার মারামারি, হানাহানি। পরবর্তীকালে উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করেছি যে বিএনপির শাসনামলে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের হলছাড়া করা হয়েছে, আর এখন আওয়ামী লীগ আমলে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা ক্যাম্পাসে ঢুকতে পারছেন না। এর মধ্যে ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সারা দেশ তোলপাড় করেছে, সরকার তাদের দাবি মানতে বাধ্য হয়েছে। ডাকসু নির্বাচনেও ভিপিসহ বেশ কিছু পদে নির্বাচিত হয়েছেন (দুর্মুখেরা বলেন, নির্বাচন শতভাগ সুষ্ঠু হলে ছাত্র অধিকার পরিষদ শতভাগ পদই পেত)। এটা ছাত্রলীগের দাপুটে নেতা-কর্মীদের পক্ষে মানা সম্ভব নয়। এ কারণে ভিপি নুরুল হক ও তাঁর সহযাত্রীদের ওপর এর আগে ১৯ বার হামলা হয়েছে। অসত্য মামলায় ফাঁসানোর চেষ্টা হয়েছে। আর ২০তম হামলা হলো টাঙ্গাইলে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের টাঙ্গাইলে হামলার ঘটনার নিন্দা করেছেন এবং দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। গতকাল দুপুরে প্রথম আলোর টাঙ্গাইল প্রতিনিধি কামনাশীষ শেখরের সঙ্গে আলাপ করলে তিনি জানান, ওই ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। যদি মামলাই না হয়, ব্যবস্থা নেবেন কীভাবে, কার বিরুদ্ধে?

টাঙ্গাইলে ছাত্রলীগের ‘নবীনবরণ’ আমাদের অতীতের বেশ কিছু ঘটনার কথা মনে করিয়ে দিল। ১৯৭২ সালে জাসদ গঠিত হওয়ার আগেই আওয়ামী লীগের অনুসারী ছাত্রলীগ দুই ভাগ হয়ে যায়। জাসদ-সমর্থিত অংশের পাল্লা ভারী ছিল। সে সময় সরকার সমর্থক এক ছাত্রলীগ নেতা আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ছাত্রলীগের এত নেতাকে ভর্তি করালাম। কিন্তু সংগঠন শক্তিশালী হলো না।

১৯৮৩ সালে আব্দুর রাজ্জাক ও তাঁর অনুসারীরা আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে গিয়ে বাকশাল গঠন করলে ছাত্রলীগ আবার ভাগ হয়। এবারও বেশির ভাগ নেতা-কর্মী ফজল-চুন্নু গ্রুপে চলে যান; যদিও পরে তঁারা ধরে রাখতে পারেননি। ছাত্ররাজনীতির মতো জাতীয় রাজনীতিতেও যতবার বিভক্তি ঘটেছে, পুরোনোরা সহজভাবে মানতে পারেননি; বাধা দিয়েছেন।

অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী ছিলেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব। খালেদা জিয়ার আমলে তিনি শিক্ষামন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সালে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের মেয়াদ শেষ হলে তিনি রাষ্ট্রপতি হন। পরবর্তীকালে বিএনপির নেতৃত্বের সঙ্গে তাঁর বিরোধ দেখা যায় এবং পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এরপর তিনি বিকল্পধারা নামে নতুন একটি দল করতে গেলে বিএনপির নেতা-কর্মীরা মহাখালী রেলক্রসিংয়ে কীভাবে তাঁকে ‘অভ্যর্থনা’ জানিয়েছিলেন, সেই সময়ের পত্রপত্রিকায় তার প্রমাণ মিলবে। তাঁর সঙ্গে পুত্র মাহী বি চৌধুরীসহ মাত্র দুজন সাংসদ গিয়েছিলেন। বিএনপির নেতৃত্ব তা-ও মানতে পারেননি। তাঁরা তাঁকে পদে পদে বাধা দিয়েছেন।

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের সঙ্গে বিরোধের জের ধরে দল থেকে পদত্যাগ করেন আবদুল কাদের সিদ্দিকী। এরপর তিনি ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে কৃষক শ্রমিক জনতা দল নামের একটি নতুন দল গঠনের উদ্যোগ নিলে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও তাঁকে বিরস সংবর্ধনা জানান। এটাই যেন আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে। ড. কামাল হোসেন আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে এসে গণফোরাম করেন ১৯৯৩ সালে। সে সময় বিএনপি ক্ষমতায়। ফলে তাঁকে ক্ষমতার রোষ দেখতে হয়নি। গণফোরামের এখনকার অবস্থা যা–ই হোক না কেন, শুরুতে তারা রাজনীতিতে বেশ চমক দেখিয়েছিল; বিভিন্ন দল থেকে অনেক নেতা-কর্মী এসে যুক্ত হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভায় গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন, এ রকম একাধিক রাজনীতিক-সাবেক আমলা গণফোরামের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

গণ অধিকার পরিষদ যাত্রা শুরু করলেও ঢাকায় এখনো বড় কোনো কর্মসূচি নেয়নি। দলের সদস্যসচিব নুরুল হক বলেছেন, তাঁরা আগামী নির্বাচনে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেবেন। তাঁর এ ঘোষণা ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, তা জানার অপেক্ষায় আছি।

আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি ন্যূনতম গণতান্ত্রিক রীতি মেনে চলে, ভিন্নমত ও চিন্তাকে ফুৎকারে উড়িয়ে না দেন, তাহলে নতুন দল বা সংগঠনকে টাঙ্গাইল মডেলে বরণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]