রাষ্ট্রদ্রোহ থেকে ডিএসএ: ভিন্নমত দমনই যখন উদ্দেশ্য

প্রতীকী ছবি

সম্প্রতি ভারতের সুপ্রিম কোর্ট রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের প্রয়োগ স্থগিত করেছেন। দেশটির প্রধান বিচারপতি এন ভি রমনার নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ বলেছেন, কেন্দ্রীয় সরকার যত দিন না আইনটি পুনর্বিবেচনা করছে, তত দিন পর্যন্ত এই আইনের প্রয়োগ স্থগিত থাকবে। দেশটির শীর্ষ আদালতের নির্দেশনা হলো, এই আইনে নতুন করে আর কাউকে গ্রেপ্তার করা যাবে না। এই আইন, অর্থাৎ দণ্ডবিধির ১২৪(ক) ধারায় যেসব মামলা চলছে, তা স্থগিত থাকবে এবং এই আইনের কারণে আটক বন্দীরা জামিনের আবেদন করতে পারবেন।

রাষ্ট্রদ্রোহ আইন স্থগিত করে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া সিদ্ধান্তকে অনেকে ‘ঐতিহাসিক’ বলে অভিহিত করেছেন এবং দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যমে তা গুরুত্বসহ প্রকাশিত হয়েছে। আইনটি স্থগিতের কারণ সম্পর্কে সংবাদমাধ্যমগুলো বলেছে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে স্বাধীনতাসংগ্রামীদের দমন করতে এই আইন তৈরি হয়েছিল। কিন্তু এখন একটি স্বাধীন দেশে ১৬২ বছরের পুরোনো এই আইনের অপব্যবহার হচ্ছে। বিশেষ করে বিজেপি সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪(ক) ধারায় আটকের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে।

ভারতে রাষ্ট্রদ্রোহ আইন স্থগিত করার বিষয়টি নিয়ে আমরা কেন আলোচনা করছি? এর কারণ হলো, ভারতের মতো বাংলাদেশের দণ্ডবিধিতেও ১২৪(ক) ধারা রয়েছে এবং হুবহু একই রকমভাবে রয়েছে। দুটি দেশই যেহেতু ভারতীয় উপমহাদেশের অংশ হিসেবে ব্রিটিশ উপনিবেশের অধীন ছিল, আইন-আদালত ও বিচারব্যবস্থায় মিল থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। এ ছাড়া বাংলাদেশের আদালতে ভারতের বিভিন্ন আদালতের রায় ও পর্যবেক্ষণকে নজির বা রেফারেন্স হিসেবে গ্রহণের উদাহরণ রয়েছে। সেই বিবেচনায় ভারতের সুপ্রিম কোর্টের এই নির্দেশনার পর বাংলাদেশের উচ্চ আদালত কি স্বতঃপ্রণোদিতভাবে আইনটি স্থগিত করার বিষয়টি বিবেচনা করতে পারেন না? কেউ কেউ যুক্তি দিতে পারেন, বাংলাদেশে ভারতের মতো রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের ব্যাপক ব্যবহার হচ্ছে না। পরিমাণ বা সংখ্যা দিয়ে বিচার করলে তাঁদের কথা হয়তো সত্যি মনে হবে; কিন্তু সংখ্যার চেয়ে স্পিরিট বা চেতনার বিষয়টি এখানে গুরুত্বপূর্ণ। ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির উত্তরাধিকার বা লিগেসি আমরা আর কত দিন বহন করব? আমাদের এ থেকে বেরিয়ে আসা ‍উচিত।

ভারতের সুপ্রিম কোর্ট রাষ্ট্রদ্রোহ আইনটি পুনর্বিবেচনা ও স্থগিতের নির্দেশ দিয়ে একটি ‘ঐতিহাসিক’ ভূমিকা পালন করেছেন। সদিচ্ছা থাকলে এ ঘটনা থেকে আমাদের সরকার ও আদালতও তেমন কিছু বিবেচনা করতে পারেন। রাষ্ট্রদ্রোহসহ ঔপনিবেশিক আমলের বিভিন্ন আইন এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো নিবর্তনমূলক আইনগুলো পুনর্বিবেচনা ও স্থগিত রাখাটা বাংলাদেশের গণতন্ত্রায়ণের জন্য যে খুবই জরুরি, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

বাংলাদেশের সংবিধানে ‘রাষ্ট্রদ্রোহের যোগ’

বাংলাদেশের পেনাল কোড বা দণ্ডবিধিতে রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধ ও সাজার উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও ২০১১ সালের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে খুবই ব্যতিক্রমীভাবে একই বিষয়ে সংবিধানে একটি অনুচ্ছেদ (৭ক) যুক্ত করা হয়েছে। এতে রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধের সংজ্ঞা বিস্তৃত করার পাশাপাশি সাজার মেয়াদও উল্লেখ করা হয়েছে। পেনাল কোডে যেখানে রাষ্ট্রদ্রোহের সর্বোচ্চ সাজা ছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, সংবিধানে সেই সাজার মেয়াদ করা হয়েছে ‘প্রচলিত আইনে অন্যান্য অপরাধের জন্য নির্ধারিত দণ্ডের মধ্যে সর্বোচ্চ’, অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ড। অনুচ্ছেদটিকে ব্যতিক্রমী বলার কারণ এই যে সংবিধান রাষ্ট্রের ‘সর্বোচ্চ আইন’ হলেও এতে সাধারণত কোনো অপরাধের সংজ্ঞা ও সাজার কথা উল্লেখ থাকে না এবং এই না থাকাটাই বাঞ্ছনীয়; সংবিধানে উল্লেখ থাকে কিছু নীতি-দর্শন, কাঠামো ও পদ্ধতিগত বিষয়। সেই হিসেবে (৭ক) অনুচ্ছেদ আসলে পেনাল কোডের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। সংবিধানে এর অন্তর্ভুক্তি সংবিধানের মাহাত্ম্য বা গুরুত্বকেই ‘ক্ষুণ্ন’ করেছে।

আরও পড়ুন

ভারতে রাষ্ট্রদ্রোহ ও বাংলাদেশে ডিএসএ

ভারতের রাষ্ট্রদ্রোহ আইন সম্পর্কে একটু খোঁজখবর নিতে গিয়ে জানা গেল, আইনটি বাতিলের জন্য মামলাকারীদের মধ্যে রয়েছে দেশটির সাংবাদিক ও সম্পাদকদের সংগঠন এডিটরস গিল্ড। এর কারণ হলো, এই আইনের অন্যতম টার্গেট দেশটির ভিন্নমতাবলম্বী রাজনৈতিক কর্মী, অ্যাকটিভিস্ট, বুদ্ধিজীবীদের পাশাপাশি সাংবাদিকেরাও। অভিযোগ রয়েছে, ভিন্নমত দমন ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত করতেই এই আইনের ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের (ডিএসএ) ক্ষেত্রেও একই রকম ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। সুতরাং এ প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক নয় যে ভারত ও বাংলাদেশে কি দুটি ভিন্ন আইন প্রায় একই উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে?

ভারতের সুপ্রিম কোর্ট রাষ্ট্রদ্রোহ আইনটি পুনর্বিবেচনা ও স্থগিতের নির্দেশ দিয়ে একটি ‘ঐতিহাসিক’ ভূমিকা পালন করেছেন। সদিচ্ছা থাকলে এ ঘটনা থেকে আমাদের সরকার ও আদালতও তেমন কিছু বিবেচনা করতে পারেন। রাষ্ট্রদ্রোহসহ ঔপনিবেশিক আমলের বিভিন্ন আইন এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো নিবর্তনমূলক আইনগুলো পুনর্বিবেচনা ও স্থগিত রাখাটা বাংলাদেশের গণতন্ত্রায়ণের জন্য যে খুবই জরুরি, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।


মনজুরুল ইসলাম সাংবাদিক