রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা ও জনস্বার্থে তথ্য প্রকাশ

পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশেই রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা রক্ষাসংক্রান্ত আইন রয়েছে, যার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ ও নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রাষ্ট্র অপ্রকাশিত রাখতে পারে। তবে এই আইনগুলো নিয়ে বেশির ভাগ সময়ই যে বিতর্ক তৈরি হয় তা হলো, এ ধরনের আইনের প্রয়োগের সঙ্গে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং তথ্য পাওয়ার অধিকারের একটি সাংঘর্ষিক অবস্থান।

যখন রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তাসংক্রান্ত আইনগুলোতে গোপনীয় তথ্যের সংজ্ঞাসহ আইন প্রয়োগের ক্ষেত্র অবারিত থাকে, তখন স্বাভাবিকভাবেই তাতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব হওয়ার সুযোগ থাকে। একই সঙ্গে জনগণের কাছে রাষ্ট্রের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার প্রক্রিয়াতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। রাষ্ট্রীয় তথ্যের গোপনীয়তা নিশ্চিত করার যে সুরক্ষা রয়েছে, তা রাষ্ট্রের স্বার্থেই করা হয়েছে। এটা রাষ্ট্রীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে যেতে পারে না। আর এ কারণেই কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি প্রকাশ করতে পারে এমন তথ্য বের করার পথ যাতে অবরুদ্ধ না হয়, সেই বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। অর্থাৎ সুশাসন নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রীয় তথ্যের গোপনীয়তা আর তথ্য পাওয়ার অধিকার—এই দুটি বিষয়ের মধ্যেই একটি সুচিন্তিত ভারসাম্য সৃষ্টি করা প্রয়োজন।

বাংলাদেশে প্রযোজ্য ব্রিটিশ আমলের অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট, ১৯২৩ কে সংবিধানের আলোকে গভীরভাবে পর্যালোচনা করার প্রয়োজন রয়েছে। ব্রিটিশ ভারতে ১৯২৩ সালে আইনটি করা হলেও এই আইনের শুরুটা হয় ১৮৪৩ সালে। সেই সময়ে সরকারি কর্মকর্তাদের সংবাদমাধ্যমগুলোতে সরকারি তথ্য ফাঁসের একাধিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন ভারত সরকারের পক্ষ থেকে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়, যেখানে সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের সরকারি তথ্য জনসমক্ষে প্রকাশ করাকে নিষিদ্ধ করা হয়। পরবর্তী সময়ে ১৮৮৯ সালে বিষয়টি যখন ব্রিটেনে আইন হিসেবে পাস হয়, তখন একই সালে কলোনিভুক্ত ব্রিটিশ ভারতের জন্যও এই অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট প্রণয়ন করা হয়।

ব্রিটিশ ভারতে ১৮৮৯ সালের পরবর্তী সময়ে সামরিক বাহিনীর অনুরোধে গুপ্তচরবৃত্তিকে প্রতিরোধ করতে আইনটিকে আরও কঠোর করে পরিবর্তন করার দাবি ওঠে এবং যার পরিপ্রেক্ষিতে আইনটি আবারও পরিবর্তিত হয় ১৯০৪ সালে এবং তারপর সর্বশেষ ১৯২৩ সালে। অর্থাৎ সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের সরকারি তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে বাধা-নিষেধ আর গুপ্তচরবৃত্তিকে দমন করাই মোটা দাগে আইনটির মূল উদ্দেশ্য। তবে কয়েকটি ধারার ক্ষেত্রে যেকোনো ব্যক্তিই তথ্য প্রকাশ বা গোপন তথ্য রাখার জন্য এই আইনে অপরাধী হতে পারেন—যে ধারাগুলোই তথ্য অধিকারের সঙ্গে বেশি সংঘাতপূর্ণ।

১৮৮৯ সালের মূল ব্রিটিশ অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট প্রথম থেকেই তথ্যের অধিকার প্রশ্নে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়। ব্রিটেনে এই মূল আইনটি আবার পৃথকভাবে বিভিন্ন সময়ে সংশোধিত হয় এবং সর্বশেষ সংশোধনী হয় ১৯৮৯ সালে। ১৯৮৯ সালের সংশোধনের মাধ্যমে ১৮৮৯ সালের মূল আইনটির ২ ধারার জায়গায় নতুন একটি ধারা প্রতিস্থাপন করা হয়। মূল আইনের এই ধারা ২ আমাদের বর্তমান ১৯২৩ সালের আইনের ধারা ৫-এর সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ, যেখানে বেআইনিভাবে তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে দণ্ড আরোপ করা হয়েছে। যুক্তরাজ্যে মূল আইনের এই ধারাটি পরিবর্তন করার অন্যতম কারণ হচ্ছে, এই ধারাটিকে নির্বিচারে প্রয়োগ করার সুযোগ ছিল। সংশোধনীর আগে মোটামুটিভাবে সব সরকারি তথ্যকেই চাইলে এই ধারার আওতায় ফেলা যেত। ‘ক্যাচ অল’ ধারা হিসেবে সমালোচিত এই ধারা পরিবর্তন করায় যুক্তরাজ্যের বর্তমান অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট এখন শুধু ছয়টি বিশেষ শ্রেণির তথ্যকেই গোপনীয়তার সুরক্ষা দিচ্ছে। এ ছাড়া বর্তমান ধারাটি শুধু তথ্য ‘প্রকাশ’কেই দণ্ডনীয় করছে—তথ্য পাওয়া বা তথ্য জানার বিষয়টিকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করছে না। উপরন্তু বর্তমান আইন অনুযায়ী তথ্য প্রকাশের বিষয়টি যে ‘ক্ষতিকর’ হয়েছে তা প্রমাণ করতে হবে। সংশোধিত ধারাটিতে কখন কোন তথ্য রাষ্ট্রীয় স্বার্থের জন্য ‘ক্ষতিকারক’, তার ব্যাখ্যাও রয়েছে।

অন্যদিকে ব্রিটিশ ভারতের ১৯২৩ সালের আইনটি উপনিবেশ-পরবর্তী সময়ে ভারতে কয়েকবার সংশোধিত হয়েছে। ১৯৪৭ সালের পর পাকিস্তানেও আইনটিতে বেশ কয়েকবার সংশোধন আনা হয়, তবে ধারা-৫-এ কিন্তু কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আনা হয়নি; বরং ভারতের সংশোধনকে অনেক বিশ্লেষক ব্রিটিশ আমলের থেকেও বেশি নিষ্পেষণমূলক আখ্যা দিয়েছেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পাকিস্তান আমলের সংশোধনসহ ১৯২৩ সালের আইনটিকেই আমরা আত্তীকরণ করেছি। এর ফলে বর্তমান আইনটি এমন অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে যে এটা শুধু ঔপনিবেশিক নীতিরই প্রতিফলন নয়, ১৯৬৮ সালের করা পাকিস্তান আমলের সংশোধনও এখানে প্রযোজ্য। ১৯২৩ সালের ব্রিটিশ ভারতের আইনটির ধারা-৩ (যা গুপ্তচরবৃত্তি সংক্রান্ত) এবং ধারা-৫—এই দুটি ধারাতে সর্বোচ্চ শাস্তি বলা ছিল ১৪ বছরের কারাদণ্ড। কিন্তু ১৯৬৮ সালের সংশোধনের মাধ্যমে পাকিস্তান সরকার এই দুটি ধারার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তি নির্ধারণ করে মৃত্যুদণ্ড। অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা রক্ষার আইনের তুলনায় এই দণ্ড অতিমাত্রায় কঠোর।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে এই আইনে কিছু সামান্য পরিভাষাগত পরিবর্তন ছাড়া এর আলোচনা-পর্যালোচনা খুবই সীমিত। অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ১৯২৩-এর ধারা ৫-এর প্রয়োগের ক্ষেত্রে অবারিত সুযোগ, আর অপরাধের ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় কঠোর শাস্তির বিধান ছাড়াও এই আইনটিতে আরও অনেক বিষয়েই অস্পষ্টতা রয়েছে। বলা হচ্ছে, কোনো ‘গোপন’ তথ্য প্রকাশ করা যাবে না, কিন্তু এই ‘গোপন’ তথ্য বলতে কী বোঝানো হবে, সেটি আইনে কোথাও উল্লেখ নেই। যেকোনো সরকারি তথ্য সংগ্রহ বা প্রকাশ করলেই তা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিরুদ্ধে যাবে, তা নিশ্চয়ই নয়। ফলে কোন ধরনের তথ্য কতটুকু সুরক্ষা পাবে এবং কোন তথ্য প্রকাশের শাস্তির মাত্রা কেমন হবে, সেটি স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। একই সঙ্গে এই আইনটিতে ‘শত্রুরাষ্ট্রের’ মতো শব্দ প্রয়োগ করা হয়েছে একাধিক জায়গায়, যা বাংলাদেশের বর্তমান পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

বাংলাদেশের সংবিধান তো বটেই, রাষ্ট্র যে জনস্বার্থে তথ্য প্রকাশকারীর গুরুত্বকে সার্বিকভাবে স্বীকৃতি দেয়, তা কিন্তু ২০০৯ সালের তথ্য অধিকার আইন আর ২০১১ সালের জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইনের মাধ্যমেও সুস্পষ্ট। ২০১১ সালের আইনটিতে জনস্বার্থে দুর্নীতির তথ্য প্রকাশকারীকে যেকোনো ধরনের ফৌজদারি বা দেওয়ানি মামলা থেকে সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে এবং এমনকি পুরস্কৃত করার কথাও বলা আছে। আইনটি গণমাধ্যমে তথ্য প্রকাশকে সুরক্ষা না দিলেও একই বিবেচনায় আইনি কাঠামোয় অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে আইনি সুরক্ষা দেওয়ার সুযোগগুলো পর্যালোচনা করতে হবে।

২০০৯ সালের তথ্য অধিকার আইনও এই বিষয়ক আলোচনায় উঠে এসেছে গণমাধ্যমে। তবে ২০০৫ সালের ভারতীয় তথ্য অধিকার আইনের সঙ্গে এই আইনের অনেক ধারায় মিল থাকলেও রাষ্ট্রীয় স্বার্থের সম্পৃক্ততা–সম্পর্কিত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান রাখা হয়নি আমাদের আইনে, যা ভারতীয় আইনে রয়েছে। ভারতের তথ্য অধিকার আইনের যে ধারায় রাষ্ট্রীয় তথ্যগুলোকে ব্যতিক্রম হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে, অর্থাৎ যে তথ্যগুলো আইন অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ দিতে বাধ্য থাকবে না, সেই তথ্যগুলোও শর্ত সাপেক্ষে দেওয়া যাবে, যদি তা রাষ্ট্রীয় স্বার্থের প্রয়োজনে প্রকাশ করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়। আমাদের তথ্য অধিকার আইনে জনস্বার্থে তথ্য সংগ্রহ, বিশেষ করে দুর্নীতি-অনিয়মের ক্ষেত্রে তথ্য পাওয়ার অবস্থান কেমন হতে পারে, সেই বিষয়টিও ভেবে দেখা দরকার।

সর্বোপরি শুরুতে যে সুচিন্তিত ভারসাম্যের প্রয়োজনীয়তার কথা বলছিলাম, তার আলোকে ১৯২৩ সালের এই আইনসহ সামগ্রিক আইনকাঠামোয় কী কী পরিবর্তন আনা যায়, তা নতুন করে ভাবতে হবে, যাতে রাষ্ট্রীয় তথ্যের নিরাপত্তা যেমন নিশ্চিত করা যায়, তেমনি জনস্বার্থে তথ্য প্রকাশের পথও যাতে রুদ্ধ না হয়। এই দুটি বিষয়ই যে নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়ায় অবহেলিত, সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে তা স্পষ্ট হয়েছে। আমরা দেখছি, একদিকে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষার কাঠামো যেমন দুর্বল, তেমনি নিবর্তনমূলক আইনগুলোও দুর্নীতির তথ্য ধামাচাপা দেওয়ার হাতিয়ার হিসেবে প্রস্তুত। রাষ্ট্রের প্রয়োজনেই এই দুটি বিবেচনার মধ্যে তাই সামঞ্জস্য আনা জরুরি।

তাসলিমা ইয়াসমীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক

[email protected]