রাহুল গান্ধীকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে

কুলদীপ নায়ার
কুলদীপ নায়ার

না, এখানে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এটা খুব ভালো করেই জানা আছে যে কংগ্রেস পার্টি হতাশাজনকভাবে নেহরু-গান্ধী বংশের ওপর নির্ভরশীল। কংগ্রেস সভাপতির পদে রাহুল গান্ধীকে মনোনীত করাটা প্রত্যাশিতই ছিল। কিন্তু কংগ্রেসের নেতা মণি শংকর আয়ার এ ঘটনায় আরেকটি মাত্রা দিয়েছেন। তিনি রাহুলের এই মনোনয়নকে মোগল রাজবংশের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি বলেছেন, রাজার পুত্র সব সময় রাজাই হবে।

ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু তাঁর মেয়ে ইন্দিরা গান্ধীকে যখন কংগ্রেসের সভাপতির পদের জন্য প্রস্তুত করে তুলছিলেন, সেই সময় কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটিতে দলের তৎকালীন সভাপতি ইউ এন ধীবর ইন্দিরা গান্ধীর নাম প্রস্তাব করেন, কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গোবিন্দ বল্লভ পন্থ বলেছিলেন যে ইন্দিরার স্বাস্থ্যের অবস্থা যেহেতু ভালো নয়, কাজেই তাঁকে এ দায়িত্ব দিয়ে বিরক্ত করা উচিত হবে না। নেহরু তখন তাঁর এই মন্তব্যের প্রতিবাদ করে বলেছিলেন যে তাঁর নিজের এবং পন্থের তুলনায় ইন্দিরার স্বাস্থ্য অনেক ভালো। এরপর ইন্দিরা দলের সভাপতি নির্বাচিত হন।

রাহুলকে সভাপতি করার ব্যাপারে কংগ্রেসের সভাপতি সোনিয়া গান্ধীও কোনো ভিন্নমত পোষণ করেননি। তিনি সোজা তাঁর ছেলেকে সভাপতির আসনে বসান। তবে একটি গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল যে, সোনিয়া হয়তো তাঁর মেয়ে প্রিয়াঙ্কার নাম ঘোষণা করতে পারেন, কারণ রাহুল কোনোভাবেই নিজেকে তুলে ধরতে পারছেন না। তবে অন্যান্য ভারতীয় মায়ের মতো তিনি উত্তরাধিকার হিসেবে ছেলেকেই বেছে নেন।

সভাপতি পদে রাহুল গান্ধীর মনোনয়নকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য কংগ্রেস নেতা জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া বলেন, এর মধ্য দিয়ে একটি নতুন যুগের সূচনা হচ্ছে। আরেক কংগ্রেস নেতা দিগ্বিজয় সিং বলেন, সোনিয়া গান্ধী ও কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সিদ্ধান্তে সভাপতির পদে রাহুলকে বসানো হয়েছে। দিগ্বিজয় সিং আরও বলেন, কংগ্রেসের তৃণমূল নেতা-কর্মীরাও এমনটিই চাইছিলেন। হ্যাঁ, এটা তৃণমূল নেতা-কর্মীদের একটি অভিন্ন ইচ্ছা।

প্রকৃতপক্ষে এখন ১০ জনপথ থেকে দলের কার্যক্রম চালানো হবে, যেমনটি চালানো হয়েছিল নেহরু ও ইন্দিরা গান্ধীর আমলে তিন মূর্তি অথবা সফদরজংয়ের বাসভবন থেকে। যেদিন সোনিয়া গান্ধী কংগ্রেস সভাপতির পদে অধিষ্ঠিত হন এবং ড. মনমোহন সিংকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত করা হয়, সেদিন আমি পার্লামেন্টের কেন্দ্রীয় হলে ঘটনার সাক্ষী ছিলাম। তখন দলের সদস্যরা কাঁদছিলেন। তাঁরা বলছিলেন যে সোনিয়া গান্ধীরই প্রধানমন্ত্রী হওয়া উচিত। কিন্তু তখন সোনিয়া নিশ্চুপ ছিলেন, কারণ তখন থেকেই তাঁর মনে ছিল ছেলের চিন্তা এবং তিনি যদি সেই সময়ে প্রধানমন্ত্রী হতেন, তখন এটিকে একটি সাজানো মঞ্চনাটকের মতো দেখাত।

এমনকি ড. মনমোহন সিংও বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, রাহুল গান্ধীর জন্য চেয়ারটা ছেড়ে দিতে হলে তিনি খুশিই হবেন। যাহোক, দেরি করে হলেও রাহুলের সভাপতি হওয়ার সুযোগ হয়েছে; বিশেষ করে সোনিয়া গান্ধীর দুর্বল স্বাস্থ্যের কারণে রাহুল গান্ধীর দলের ভার গ্রহণ করাটা অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল।

রাহুল গান্ধী ইতিমধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতাকে নামফলকে পরিণত করেছেন। ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) প্রকাশ্যে হিন্দুত্ববাদের কথা না বললেও এটা পরিষ্কার যে, ২০১৯ সালের নির্বাচনে কেবল হিন্দুত্ববাদের স্লোগান নিয়ে মাঠে নামবে দলটি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই সত্য গোপন করেননি যে তিনি নাগপুরে আরএসএস সদর দপ্তরে যান এবং মহারাজ ভাগওয়াতের মতো নেতাদের কাছ থেকে পথনির্দেশ চান। তাঁর ‘সাব কা সাথ, সাব কা বিকাস’ স্লোগানটি এখন নিছক একটি স্লোগান বলেই প্রমাণিত হয়েছে।

এখন মুসলমানরা আর তাঁর পরিকল্পনা বা কর্মসূচিকে গণনার মধ্যে আনে না এবং এটা খুবই দুঃখজনক যে তারা নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছে। উত্তর প্রদেশের নির্বাচনে বিপুল বিজয় এটা প্রমাণ করেছে যে কীভাবে বিজেপি এই রাজ্যের ক্ষমতা হস্তগত করেছে। এটা স্পষ্ট যে এই দলটি জনগণকে জানাতে চেয়েছিল যে তারা কোনোভাবেই মুসলিম ভোটারদের ওপর নির্ভরশীল ছিল না।

সদ্য শুরু হওয়া গুজরাট নির্বাচনের আগে মোদি এটা স্পষ্ট করে দেন যে যিনি গুজরাটে জয় পাবেন, তিনি ভারতের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করবেন। এই রাজ্যে বিজেপির একটানা প্রায় ২৩ বছরের শাসন অক্ষুণ্ন রাখতে অক্লান্ত প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি। অন্যদিকে গুজরাট দখলে আনার মরিয়া চেষ্টায় রীতিমতো লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন রাহুল গান্ধীও।

তবে এখন পর্যন্ত রাহুল গান্ধীর রেকর্ড কোনো দিক থেকে চিত্তাকর্ষক নয়। তিনি উত্তর প্রদেশসহ অনেক নির্বাচনে লড়াই করেছেন। উত্তর প্রদেশ নির্বাচনের সময় তিনি সমাজবাদী পার্টির নেতা অখিলেশ যাদবের সঙ্গে জোট বেঁধেছিলেন। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। তারা বিজেপির কাছে শুধু পরাজিতই হয়নি, এই নির্বাচনে কংগ্রেসের অবস্থান চতুর্থ স্থানে নেমে আসে। এখন গুজরাটের নির্বাচনে তাঁর জনপ্রিয়তা প্রমাণ করতে হবে। যদি তিনি তা করতে ব্যর্থ হন, তবে বোঝা যাবে যে তিনি নিজে নিজে আর কোনো জয় পাবেন না। যদি তিনি কংগ্রেসকে ক্ষমতায় দেখতে চান, তাহলে তাঁকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। কিন্তু বর্তমানে দলকে টেনে তোলার কোনো ক্ষমতা রাহুলের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। তবে এ অবস্থান পরিবর্তন হতে পারে।

আমরা ইন্দিরা গান্ধীকে দেখেছি, যিনি ‘গুঙ্গি গুড়িয়া’ বা ‘বোবা পুতুল’ নামে পরিচিত ছিলেন, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই সবার এমনকি বিরোধীদেরও মন জয় করেন। তাঁর ছেলে রাজীব গান্ধী, যিনি রাষ্ট্রপতি জৈল সিংয়ের চাপে পড়ে প্রধানমন্ত্রী হন, তাঁকেও সবাই মেনে নিয়েছিলেন। তাহলে রাহুল গান্ধীকেও মেনে না নেওয়ারও কোনো কারণ নেই। তবে এটা নির্ভর করবে তিনি দলকে কীভাবে টেনে তুলবেন এবং নির্বাচনে জেতাতে পারবেন, তার ওপর। এই সময়ে এটা করা কঠিন হবে বলেই মনে হচ্ছে; কারণ, ধর্মনিরপেক্ষতাকে পটভূমি করা হয়েছে যখন কিনা দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে হিন্দুত্ববাদের আদর্শ।

এটি খুবই দুঃখের বিষয় যে একটি দেশ যা বহুত্ববাদের ওপর ভর করে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছে, সেই দেশ স্বাধীনতার মূল্যবোধ অনুসরণ করতে সক্ষম হয়নি।

অনুবাদ: রোকেয়া রহমান।

কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় সাংবাদিক।