রাহুলের সামনে কঠিন পথ

রাহুল গান্ধী। ছবি: এএফপি
রাহুল গান্ধী। ছবি: এএফপি

নির্বাচনসংশ্লিষ্ট সব ব্যক্তি ও সংস্থাই গুজরাট ও হিমাচল প্রদেশে বিজেপির বিজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল। আর সেটা সত্যও হয়েছে। গুজরাটে কংগ্রেস পেয়েছে ৮০টি আসন আর বিজেপি পেয়েছে ৯৯টি। জয়ের ব্যবধান ছাড়া আর কিছুতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। তবে কংগ্রেসের আসন বেড়েছে—সেটাই দেখার বিষয়। যে দলটি কয়েক বছর ধরে কূলকিনারা করতে পারছিল না, তারা আবারও প্রাসঙ্গিক হয়েছে। দুই দলের মধ্যকার ব্যবধান কমেছে। এখন মনে হচ্ছে রাহুল গান্ধী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ভালো লড়াই করবেন। আর এসব কিছুর কৃতিত্ব দিতে হবে সোনিয়া গান্ধীকে, যিনি আবারও দলে প্রাণ সঞ্চার করলেন।

২০০৪ সালে কংগ্রেস সাধারণ নির্বাচনে জেতার পর সেন্ট্রাল হল অব পার্লামেন্টে যে দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল, তা আমার স্পষ্ট মনে আছে। সাংসদেরা সবাই সমস্বরে তাঁকে সরকারপ্রধান হওয়ার অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু তিনি সেটা করতে অনাগ্রহী ছিলেন। সম্ভবত সোনিয়া গান্ধীর মনে তাঁর ইতালীয় জাতীয়তা নিয়ে ক্ষতিকর প্রচারণার কথা মনে ছিল। তিনি এ ব্যাপারেও সতর্ক ছিলেন যে তিনি যে ইতালীয়—এই প্রচারণা তাঁর ছেলে রাহুল গান্ধীর ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি উদ্দেশ্যমূলকভাবেই ড. মনমোহন সিংকে প্রধানমন্ত্রীর পদে বসিয়েছিলেন। কারণ, তাঁর মনে রাজনীতি বা উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না। মনমোহন যে ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন কিছু ঘটেনি। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ফাইলগুলো তাঁর বাড়িতে যেত, এরপর সেগুলো স্রেফ স্বাক্ষরের জন্য মনমোহন সিংয়ের দপ্তরে যেত। সোনিয়ার রাজনৈতিক উপদেষ্টা আহমেদ প্যাটেল সব সিদ্ধান্ত নিতেন। তৎকালীন সরকারের গণমাধ্যম উপদেষ্টা সঞ্জয়া বসু তাঁর বই দ্য অ্যাকসিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার-এ এটি নিশ্চিত করেছেন।

সোনিয়া গান্ধী জানতেন তাঁর বিরুদ্ধে কী অভিযোগ আনা হয়েছে। কিন্তু সন্তান রাহুল গান্ধীর জন্য আসনটি উষ্ণ রাখতে তাঁর এটা করা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। তবে মনমোহন সিং এই অভিযোগ গ্রহণ করেননি। এমনকি তাঁকে এই অভিযোগ সম্পর্কে মন্তব্য করতে বলা হলে তিনি শুধু বলেন, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এর বিচার করবে। এটা ঠিক, আজকের কংগ্রেসে সোনিয়ার শাশুড়ি ইন্দিরা গান্ধীর ছাপ আছে। কিন্তু এই সোনিয়াই দলকে একত্র রেখেছেন। তিনি না থাকলে হয়তো দলটি নানা দলে-উপদলে বিভক্ত হয়ে যেত। তাঁর কৃতিত্ব হলো সব গোষ্ঠীই তাঁকে দলের নেতা হিসেবে মেনে নিয়েছে। বস্তুত, তিনি ছিলেন সব শাখা-উপশাখার মধ্যবিন্দু। দলে তাঁর নেতৃত্বের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছিল না।

তিনি যেভাবে অনায়াসে তাঁর ছেলে রাহুল গান্ধীকে আসনে বসিয়েছেন, তাতে বোঝা যায় তিনি নিজেই দল। আবার রাহুল জানেন, এ নিয়ে পরিবারতন্ত্রের অভিযোগ আছে। তিনি প্রকাশ্যে বলেছেন, কংগ্রেসে সভাপতি নির্বাচনে এর চেয়ে উন্নত পদ্ধতি দরকার। যেভাবেই হোক, রাহুল গান্ধীর মধ্য দিয়েই কংগ্রেসে পরিবারতন্ত্রের অবসান ঘটবে। আর কংগ্রেসের সমস্যা হচ্ছে দলটি এখনো পরিবারতান্ত্রিক নির্ভরতার বাইরে যেতে পারেনি। আর মানুষও নানা কারণে এখন আর পরিবারতন্ত্র পছন্দ করছে না। রাহুল গান্ধী সততা ও আবেগের সঙ্গে প্রপিতামহ নেহরুর নীতি অনুসরণের চেষ্টা করলেও এখনো হালে পানি পাননি। তবে জনগণের মধ্যে সোনিয়ার মেয়ে প্রিয়াঙ্কার গ্রহণযোগ্যতা আছে। সম্ভবত ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাঁর চেহারার মিল থাকায় এমনটা ঘটেছে। অর্থাৎ মানুষের চিন্তায় এখনো ইন্দিরার
প্রভাব আছে।

এ সবই সত্য, তবু দলটি প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে। তারা যে বিকল্প দিতে পারে, এটা মানুষকে বোঝাতে দলটিকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। বড় নোট বাতিলের মতো নানা ইস্যু থাকা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এখনো গ্রহণযোগ্য। মানুষ বিশ্বাস করে, সাময়িক অসুবিধা হলেও এসব কিছু তাদের ভালোর জন্যই হচ্ছে।

বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে সরাতে কংগ্রেসকে অনেক সংগ্রাম করতে হবে। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা এখন আর আগের মতো অতটা আকর্ষণীয় নয়। মানুষ হিন্দুত্ববাদী ভাবধারায় প্রভাবিত হয়েছে। বস্তুত, ভারতে এখন একধরনের মৃদু হিন্দুত্ববাদের হাওয়া বইছে। তার মানে গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের ধারণার পালে আবার হাওয়া লাগানোটা আজ কংগ্রেসের জন্য বড় সমস্যাই বটে।

কংগ্রেসের সমস্যা হলো ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর দলটি একটি নির্বাচনেও জিততে পারেনি। গুজরাটে বিজেপি শেষমেশ ক্ষমতা ধরে রাখতে পারল। এতে ধর্মনিরপেক্ষ ও উদার শক্তির উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত। বিজেপি নিজের ভিত আরও শক্ত করছে আর কংগ্রেস একসময় যে গুরুত্ব বহন করত, তা হারাচ্ছে।

গত সাধারণ নির্বাচনে রাহুল গান্ধী নিজে সারা দেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন। তিনি নিজেই জনতাকে মোকাবিলা করেছেন। সোনিয়া গান্ধী সেখানে ছিলেন না। অর্থাৎ মানুষ রাহুল গান্ধীকে কংগ্রেসের প্রতিনিধি হিসেবে মেনে নিয়েছে। তিনি নিজেও আত্মবিশ্বাস পেয়েছেন। সোনিয়া গান্ধীও নিজেকে অভিনন্দিত করতে পারেন। কারণ, তিনি নিজে সভাপতি হয়েও দেখেছেন, মানুষ তাঁকে গ্রহণ করে নিয়েছে। এতে পরিবারতন্ত্র ছিল, কিন্তু ব্যাপারটা অত একনায়কতান্ত্রিক মনে হয়নি। রাহুল গান্ধী দলের কর্মীদের সঙ্গে কাজ করেছেন। তিনি দেশের বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে দলের কর্মীদের সঙ্গে মাটিতে বসে তাঁদের কথা শুনেছেন।

রাহুলকে দলের কর্মীদের মতো কষ্ট পোয়াতে হয়নি। কিন্তু দলটি গত ১৫০ বছরে যে মূল্যবোধ ধারণ করে আসছে, তিনি তা অনুভব করতে পারেন। কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে এটা তাঁকে ভালো সুযোগ দেবে। এই কাজটা কঠিন, কিন্তু দলের শীর্ষ নেতা হতে গেলে তাঁকে এটা করতে হবে।

অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন।

কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় সাংবাদিক।