রায়হান হত্যার মূল্য যখন তিন লাখ টাকা

সিলেটের যুবক রায়হানকে ছিনতাইকারী এবং গণপিটুনিতে মারা যাওয়ার গল্প প্রচারে ব্যর্থ আকবর ও তাঁর সহযোগীদের (ফাঁড়ির কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যরা) শাস্তি পাওয়ার বিষয়টি এখন পর্যন্ত পুরোপুরি পুলিশের কর্তৃত্বে রয়েছে। অথচ ২০১৩ সালের নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইনটির উদ্দেশ্য তা ছিল না। আইনটি মূলত করাই হয়েছিল এই ধারণার বশবর্তী হয়ে যে যখন পুলিশের বিরুদ্ধে নির্যাতন বা নিষ্ঠুরতার অভিযোগ উঠবে, তখন তার তদন্তের নেতৃত্ব পুলিশ দেবে না। দেবে বিচার বিভাগ।

সুতরাং সমগ্র সংবাদমাধ্যম এবং পুলিশ ক্রমাগতভাবে বলে চলেছে যে এসআই আকবর বাহিনীর বিরুদ্ধে মামলা চলছে ২০১৩ সালের আইনের অধীনে। এটি একটি বিভ্রান্তিকর প্রচারণা। পুলিশ বিভাগ জনগণকে এটা বলতে পছন্দ করছে যে ২০১৩ সালের নির্যাতন নিবারণ আইনের আওতায় তদন্ত চলছে।

রায়হান হত্যাকাণ্ডের তদন্তপ্রক্রিয়া সাধারণ পুলিশি তদন্ত থেকে পিবিআইয়ের কাছে যাওয়ার কারণে ২০১৩ সালের আইনের মূল উদ্দেশ্য পূরণ হয় না। এ পর্যন্ত মামলার অগ্রগতি যে প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হয়েছে, তাতে বিশ্বাসযোগ্যতার ঘাটতি দুঃখজনকভাবে প্রকট।

এখানে স্মরণ করতে চাই যে এই আইনের বিরোধিতা করেছিল পুলিশ। এমনকি পাস হওয়ার চার বছর পরও বিস্ময়করভাবে আইনটি বাতিলের দাবি তুলেছিল তারা। ২০১৭ সালে রাজারবাগে তারা প্রধানমন্ত্রীর সামনেই আইনটি বাতিলের দাবি জানায়। কোনো সন্দেহ নেই
যে বর্তমান সরকারের যতগুলো ভালো কাজ, তার অন্যতম এই আইন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের দাবি নাকচ করেছিলেন।

রায়হান হত্যাকাণ্ডের তদন্তপ্রক্রিয়া সাধারণ পুলিশি তদন্ত থেকে পিবিআইয়ের কাছে যাওয়ার কারণে ২০১৩ সালের আইনের মূল উদ্দেশ্য পূরণ হয় না। এ পর্যন্ত মামলার অগ্রগতি যে প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হয়েছে, তাতে বিশ্বাসযোগ্যতার ঘাটতি দুঃখজনকভাবে প্রকট। বিশেষ করে যে কারণে ইউএনডিপির সেই পুলিশের খসড়া আইনে যে স্বাধীন তদন্ত সংস্থার কথা বলা হয়েছিল, তেমন করেই দায়িত্ব পালন করার কথা পিবিআইয়ের। কিছু ক্ষেত্রে তাদের অবশ্যই সাফল্য আছে। কিন্তু ২০১৩ সালের আইনটি পাসের পর বিচার বিভাগীয় তদন্ত যে কারণে চাওয়া হয়েছিল, তার ঘাটতি পিবিআই পূরণ করতে পারেনি।

এই অবস্থা থেকে উত্তরণে ২০১৩ সালের আইনটিকে কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হবে। পিবিআইয়ের তদন্তপ্রক্রিয়া চলমান থাকতে বিচার বিভাগীয় তদন্ত হতে বাধা নেই। সুপ্রিম কোর্টের দুজন আইনজীবী দুটি পৃথক রিট মামলায় বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশনা চেয়েছেন। দুটি রিটেরই শুনানি হয়েছে। আদালত রুল জারি না করলেও সিলেট অঞ্চলের এই দুই আইনজীবীর সঙ্গে আলোচনায় মনে হয়েছে, তাঁরা হাল ছাড়েননি। লেগে আছেন। তাঁদের উভয়ের কথায়, দুটি পৃথক রিট বেঞ্চই বিষয়টি তাঁদের পর্যবেক্ষণে রেখেছেন।

সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী রায়হানের মায়ের অনশন ভাঙিয়েছেন। পুলিশের কেউ আসেননি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সস্ত্রীক রায়হানদের বাসায় গেছেন। অনুদান দিয়েছেন। প্রায় ধারাবাহিকভাবে সিলেটের বিভিন্ন পেশা ও শ্রেণির মানুষ আন্দোলন করছেন। সিলেট বেশ প্রতিবাদী। সিলেট আইনজীবী সমিতির পুরো দল রায়হানের স্ত্রী ও মাকে গিয়ে বলেছে, তারা সব রকম আইনি সহায়তা দেবে। কিন্তু একটি শূন্যতা আছে।

সিলেট আইনজীবী সমিতির সভাপতির কাছেই জানতে চাইলাম, আপনারা আন্দোলন করছেন। নাগরিক সমাজও এগিয়ে এসেছে। ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতারা বিচার চাইছেন। তাহলে সিলেটে কি একজন লোকও নেই, যিনি বাদী হয়ে ২০১৩ সালের আইনে সিলেটের আদালতে একটি মামলা করবেন?

২০১৩ সালের আইন বলছে, পুলিশ তার হেফাজতে নির্যাতন করে খুন করলে তার সাজা যাবজ্জীবন। শুধু তা-ই নয়, ভয়ংকর বিষয় হলো একটা ‘অথবা’ লাগানো আছে। তার মানে বিচারক চাইলে এসআই আকবর ও তাঁর বাহিনীর কাউকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড না দিলেও পারবেন।

তাঁর কাছ থেকেই এজাহারের একটি গলদ সম্পর্কে জানলাম। তিনি আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে কপি পাঠান। রায়হান হত্যা মামলার এজাহার হাতে লেখা। তার নিচে সই করেছেন রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নি। অথচ পুলিশ যখন এজাহারটি নির্দিষ্ট সরকারি ফরমে নথিভুক্ত করেছে, তখন লিখেছে, ‘বাদীর টাইপকৃত স্বাক্ষরিত অভিযোগ উপপুলিশ কমিশনারের পত্রের মূলে অত্র থানায় প্রাপ্ত হইয়া এজাহারের সকল কলাম পূরণপূর্বক মামলা রুজু করিলাম।’ এখন পুলিশ যদি বলে, সরল বিশ্বাসে এটা একটা টাইপো বা লেখার ভুল, তাহলে তা মানব। কিন্তু ভবিষ্যতে এই মামলা যখন যথারীতি সবার বিস্মৃতির গহ্বরে হারিয়ে যাবে, তখন আসামিদের আইনজীবীরা এর সুবিধা নেবেন বা পাবেনই না, তা হলফ করে বলা যাবে না।

তান্নির মাথায় ২০১৩ সালের আইন না থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু পুলিশ কি কৌশল করেই তান্নির এজাহারটি ২০১৩ সালের আইনের আওতায় গ্রহণ করল? ২০১৩ সালের আইনটি ধরেই নিয়েছে, পুলিশের বিরুদ্ধে যখন অভিযোগ উঠবে, তখন তারা সহজে মামলা নিতে চাইবে না এবং তারা সুষ্ঠু তদন্ত করবে না। ভুক্তভোগী বা নির্যাতিত ব্যক্তি থানা দূরে থাক, আদালতে মামলা করতে আসবেন না। সে কারণে যেকোনো ব্যক্তিকে তাদের পক্ষে আদালতে আসতে বলেছে। যদি কেউ আসতেন, তাহলে ‘চিকিৎসক অভিযোগকারী ব্যক্তির­­ দেহের জখম ও নির্যাতনের চিহ্ন এবং নির্যাতনের সম্ভাব্য সময় উল্লেখপূর্বক ২৪ ঘণ্টার মধ্যে উহার একটি রিপোর্ট তৈরি করিবেন।’ এখানে ‘দেহ’ আছে, ‘মৃতদেহ’র কথা নেই। কিন্তু আইন যেহেতু বলেছে, কেউ মারা গেলেও তা হবে একটি নির্যাতন। তাই রাস্তায় না নেমে আদালতে যেতে হবে। আদালতে গেলে মামলা দায়েরের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রায়হানের ময়নাতদন্তের রিপোর্ট ২০১৩ সালের আইনের আওতায় পাওয়া সম্ভব ছিল। তবে কিছু নথিপত্র পর্যালোচনায় সন্দেহ হলো, পুলিশ বিভাগ ইচ্ছা করেই তান্নির এজাহারটি ২০১৩ সালের আইনের আওতায় এনেছে। অথচ এই আইনের আওতায় আদালতের কোনো তদারকি (পিবিআই প্রক্রিয়ার বাইরে) নেই।

আইনটির একটি দুর্বলতা হলো, যা হাইকোর্টের একটি রিট পিটিশনে যথার্থই প্রতিকার চাওয়া হয়েছে যে ২০১৩ সালের আইনের অধীনে সর্বোচ্চ শাস্তি হলো যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। যুগ যুগ ধরে সবারই জানা খুনের সাজা মৃত্যুদণ্ড। অথচ ২০১৩ সালের আইন বলছে, পুলিশ তার হেফাজতে নির্যাতন করে খুন করলে তার সাজা যাবজ্জীবন। শুধু তা-ই নয়, ভয়ংকর বিষয় হলো একটা ‘অথবা’ লাগানো আছে। তার মানে বিচারক চাইলে এসআই আকবর ও তাঁর বাহিনীর কাউকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড না দিলেও পারবেন। এর শাস্তি হতে পারে এক লাখ টাকা জরিমানা। এর সঙ্গে ক্ষতিপূরণ অতিরিক্ত দুই লাখ টাকা। তার মানে আদালতে পুলিশের হাতে রায়হানের খুনের বিষয়টি প্রমাণিত হলেও দেশের আইন অনুযায়ী এর দাম (ক্ষতিপূরণ) তিন লাখ টাকা। ভাগাভাগি করে এক লাখ পাবে রাষ্ট্র, দুই লাখ পাবেন রায়হানের মা-স্ত্রী। আইন বলেছে, এই আইনে বিচার মামলা দায়েরের ১৮০ দিনের মধ্যে জেলা ও দায়রা জজ শেষ করবেন। আমরা কি আইনের শর্ত মেনে ৯০ কার্যদিবসে অভিযোগপত্র এবং ১৮০ দিনে প্রথম রায়টি পাব?

তবে সিলেটের আদালতে অনতিবিলম্বে আরেকটি মামলা করা উচিত। সিলেট বার সভাপতিকে বললাম, উপকমিশনারের কাছে কারা অভিযোগ করেছিল? তিনি বললেন, থানা তান্নির মামলা নিতে না চাইলে তাঁরা উপকমিশনারের কাছে যান। তখন তিনি মামলা নিতে
চিঠি দেন। এই চিঠির বরাতেই পুলিশ মামলা নিল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, চিঠিই যদি তান্নির এজাহারের ভিত্তি হয়, তাহলে আইনটির বাকি শর্তগুলো উপকমিশনার পালন করছেন কি না।

আইন বলেছে, তৃতীয় পক্ষের কাছ থেকে অভিযোগ শুনে উপকমিশনার ‘তাৎক্ষণিক একটি মামলা দায়ের ও অভিযোগকারীর বক্তব্য রেকর্ড করিবেন এবং মামলার নম্বরসহ এই অভিযোগের ব্যাপারে কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইতে পারে উহা অভিযোগকারীকে অবহিত করিবেন। এবং এ রকম ব্যবস্থা গ্রহণকারী ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অভিযোগ দায়েরের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দায়রা জজ আদালতে একটি রিপোর্ট পেশ করিবেন।’ সেই রিপোর্ট কোথায়?

সিলেট বার সভাপতির সঙ্গে একমত, থানায় রায়হান হত্যা মামলা দায়ের হলেও ২০১৩ সালের আইন এবং ফৌজদারি কার্যবিধির ২০৫ডি ধারা অনুযায়ী এখনো আদালতে একটি মামলা দায়ের করা সম্ভব। দুটো একত্রে চলবে। শুনানি এবং রায়ও হবে একত্রে।

রায়হান হত্যার সুবিচারে বিচার বিভাগীয় তদারকির বিকল্প দেখি না।

মিজানুর রহমান খান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক

[email protected]