রায়ের পরও যে উদ্বেগ থেকে গেছে

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংবিধানের ‘মৌলিক কাঠামো’ গণ্যে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল হলো। আমরা এই রায়কে সতর্কতার সঙ্গে স্বাগত জানাই। আশা করব এটা রাষ্ট্রের অঙ্গসমূহের মধ্যে একটা আত্মজিজ্ঞাসা, আত্মসমালোচনা, ভারসাম্য ও স্থিতির রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করবে। এই রায়কে ঘিরে সরকার ও সংসদের সঙ্গে আদালতের কোনো দূরত্ব বা টানাপোড়েন প্রত্যাশিত নয়।
প্রতিবেশী ভারতের দ্বিকক্ষবিশিষ্ট ও গ্রহণযোগ্য সংসদে পাস করা সংবিধানের ৯৯তম সংশোধনী সে দেশের সুপ্রিম কোর্ট বাতিল করেছে। কংগ্রেস ও বিজেপি বহু বছরের আলাপ-আলোচনার পরে বিচারক নিয়োগে সুপ্রিম কোর্টের এখতিয়ারে কিছুটা নির্বাহী অংশগ্রহণ চেয়েছিল। তাই তারা সমঝোতা করে বিল পাস করেছিল কিন্তু তা বাতিল হলো। সেই রায়ের পরে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা পত্রিকায় আদালতের বাতিল করার এখতিয়ার নেই মর্মে নিবন্ধ লিখেছেন। কিন্তু সরকার নীরব থেকে রায় মেনেছে।
আমরা অবশ্য কিছুটা ভিন্ন কারণে উদ্বিগ্ন। রায়ে বলা হয়েছে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল সংবিধানের মৌলিক কাঠামো। আমরা অবশ্যই সংসদের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছি। এটা বাতিল হয়েছে বলে সন্তুষ্ট। কিন্তু বর্তমান কাউন্সিল যেটি পুনরুজ্জীবিত হলো সেটি যে অতিমাত্রায় নির্বাহী বিভাগমুখী থেকে গেল তার সমাধান কী। প্রধানমন্ত্রী না চাইলে যে কাউন্সিল কারও আচরণের তদন্তে বসতেই পারবে না, সেটাও আমাদের স্মরণ রাখা দরকার। সেই রকম একটি সংস্থাই অপরিবর্তনীয় মৌলিক কাঠামো হিসেবে থেকে যাচ্ছে। কাউন্সিলের একটি বিধান হলো প্রধান বিচারপতি যেকোনো সূত্রে কারও বিষয়ে কোনো অভিযোগ পেয়ে তদন্ত শুরু করতে চাইলে তিনি তা অনুমোদনের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে প্রেরণ করবেন। বাস্তবে এখানে রাষ্ট্রপতি মানে রাষ্ট্রপতি নন। প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি ছাড়া রাষ্ট্রপতি এখানে কিছুই করতে পারবেন না। তার মানে আমাদের প্রকৃত অর্জন কিন্তু সীমিত। আগামী নির্বাচনে কোনো নির্বাচন কমিশনার (যিনি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির মতো একই অবস্থানের অধিকারী) মহা অপরাধ করলেও সুপ্রিম কোর্ট তাঁর বা তাঁদের বিষয়ে কোনো তদন্ত শুরু করতেই পারবে না। অপসারণ করা তো দূরের কথা।
সংবিধানের ৭ক ও ৭খ অনুচ্ছেদ নিয়ে বিতর্ক কম নেই। ২০১১ সালে সংবিধানে ৭খ অনুচ্ছেদ তৈরি করে অন্যান্যের মধ্যে সেখানে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে ঢুকিয়ে তাকেও কিন্তু সংশোধন-অযোগ্য মৌলিক কাঠামো বলা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের চরম স্ববিরোধিতা ফুটে উঠেছে সেখানেই। আর আদালতও ষোড়শ সংশোধনীকে বাতিল করতে এই অনুচ্ছেদটিকেই অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন।
৭খ-এ যেসব বিষয়কে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো চিহ্নিত করা হয়েছে, সেগুলোর সবকিছুই মেনে নেওয়ার প্রশ্নেও ভিন্নমত আছে। এখন সরকার এই রায়কে যেন ৭খ অনুচ্ছেদের প্রতি আদালতের একটি অনুসমর্থন হিসেবে না দেখেন। অবশ্য প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা এবং বিচারপতি মো. ইমান আলী এ বিষয়ে সতর্ক ছিলেন বলেই প্রতীয়মান হয়।
এই অনুচ্ছেদটি আওয়ামী লীগ সংবিধানে কেন এনেছিল তার উদ্দেশ্যটা স্পষ্ট। ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীতে তারা যেসব পরিবর্তন এনেছে, বিশেষ করে রাষ্ট্রধর্ম, ধর্মনিরপেক্ষতাসহ চার মূলনীতি, জাতির পরিচয় বাঙালি (নাগরিকের পরিচয় হিসেবে যদিও বাংলাদেশি রাখা হয়েছে), জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি সরকারি অফিস–আদালতে প্রদর্শন, ক্ষমতা জবরদখলকারীদের রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে বিচার, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ (১৫০ অনুচ্ছেদে সংযোজিত), ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে জাতির পিতা কর্তৃক প্রদত্ত স্বাধীনতা ঘোষণা, মুজিবনগর সরকারের জারি করা ঘোষণাপত্রকে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো হিসেবে ঘোষণা করা।
এই তালিকার কিছু বিষয়ের (কার্যপ্রণালিগত) সঙ্গে একমত হলেও অনেক কিছুর সঙ্গেই অনেকের ভিন্নমত রয়েছে। যেমন বিচারপতি এম এ মতিন মনে করেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ সংবিধানের অংশে পরিণত করার দরকার ছিল না। আবার তাকে ১৫০ অনুচ্ছেদের ক্রান্তিকালীন বিধানাবলির মধ্যেও রাখা ঠিক হয়নি।’ কারণ, ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ কোনোভাবেই একটি ক্রান্তিকালীন বিষয় হিসেবে সংবিধানে থাকতে পারে না।
উপরন্তু আরও উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, এই ৭খ অনুচ্ছেদ দিয়ে সরকার একটি বর্ম তৈরি করেছে, যাতে কারও পক্ষে পরিবর্তনগুলোর বিরুদ্ধাচরণ করা সম্ভব না হয়। সে জন্য তারা ৭ক (২) অনুচ্ছেদ যুক্ত করেছে। এতে বলা হয়েছে, ‘সংবিধানের কোনো অনুচ্ছেদ রদ, রহিত বা বাতিলে ‘‘সহযোগিতা বা উসকানি প্রদান, মার্জনা, সমর্থন বা অনুসমর্থন’’ দিলে রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে তার সর্বোচ্চ শাস্তি হবে। প্রয়াত সংবিধান বিশেষজ্ঞ মাহমুদুল ইসলাম লিখেছেন, এটা বাক্স্বাধীনতার ওপরে ‘চিলিং এফেক্ট’ (নিস্তেজক প্রভাব) তৈরি করেছে।
এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারকেরা এই ৭খ অনুচ্ছেদের ওপরে বেশ জোর দিয়েছেন। অবশ্য সুখের বিষয় তাঁরা এ বিষয়ে সতর্ক ছিলেন।
বিচারপতি মো. ইমান আলী লিখেছেন, ‘ক্ষমতা জবরদখলকারীদের রুখতে ৭ক অনুচ্ছেদ একটি উচ্চাভিলাষী পন্থা। জনগণের অগাধ শক্তি এবং বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধান খুনি জবরদখলকারী ও শক্তিধরের কবল থেকে (বাহাত্তরের) সংবিধানকে রক্ষা করতে পারেনি। অনেক পারিবারিক সদস্যের সঙ্গে জাতির জনককে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করা হয়েছে। অন্তরীণ থাকাকালে অত্যন্ত কাপুরুষোচিতভাবে জাতীয় নেতাদের হত্যা করা হয়েছে। জনগণের মতোই সংবিধান তখন ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ে।’
তিনি এরপর লিখেছেন, ‘৭(ক) এবং ৭(খ) অনুচ্ছেদের বৈধতা এই মামলায় চ্যালেঞ্জ করা হয়নি।’ তাই তাঁরা বিষয়টিকে বিচার্য হিসেবে গ্রহণ করেননি। কিন্তু তিনি যে এই দুটি অনুচ্ছেদকে সুনজরে দেখেননি, সেটা পরিষ্কার করেছেন।
বিচারপতি ইমান আলী লিখেছেন, ‘এটা বলা যথেষ্ট যে সংসদ সদস্যদের মতোই সংসদ আসবে ও যাবে। কিন্তু সংসদ তার উত্তরসূরিদের বেঁধে রাখতে পারে না। জনগণের ক্ষমতা তত দিন চলবে, যত দিন জনতা টিকে থাকবে। ভাবীকালের জনগণের ক্ষমতা তার উত্তরসূরিদের চেয়ে কম নয়। তবে সংবিধানের ৭ক ও ৭খ অনুচ্ছেদ ভবিষ্যতের জনগণকে বেঁধে ফেলার চেষ্টা করেছে।’ তাঁর কথায় ৭ক এবং ৭খ ক্ষমতার মোহে আচ্ছন্ন ব্যক্তি এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে কোনো নিগড়ে বেঁধে ফেলবে কি না, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। এই বন্ধন যে টিকবে না, তার বড় প্রমাণ ষোড়শ সংশোধনী। আমরা অবশ্যই গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের মতো কিছু বিষয়কে অপরিবর্তনীয় মৌলিক কাঠামো মনে করি। কিন্তু আবার অন্যগুলো করি না।
প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা লিখেছেন, সংবিধানের ৭খ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ষোড়শ সংশোধনী সংসদের সংবিধান সংশোধনী ক্ষমতার বাইরে ছিল। অন্য ছয়জনও এটা আলাদাভাবে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু আমরা মনে করি, রায়ের পরেও এই ৯৬ অনুচ্ছেদ ৭খ–এর আওতায় থাকবে। কিন্তু এর উপযুক্ত সংশোধনী লাগবে।
রায়ের ৩২১ পৃষ্ঠায় প্রধান বিচারপতির বর্ণনায় বিষয়টি এভাবে এসেছে, ‘সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ফিদা এম কামালের নিবেদন হলো সংবিধানের মৌলিক কাঠামো ধ্বংসে ৭খ অনুচ্ছেদ একটি স্পষ্ট প্রতিবন্ধক।’ কিন্তু এটা আমরা পুরোপুরি নিতে পারি না। কারণ, ৭খ অনুচ্ছেদ নিজেই মৌলিক কাঠামো অর্থাৎ বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে আঘাত করে।
বিচারকদের দ্বারাই বিচারকদের বিচারের ধারণা বাংলাদেশের জন্য এখন দরকারি। কিন্তু একে স্থায়ী মৌলিক কাঠামো গণ্য
করার দরকার নেই। ভবিষ্যতে তাকে আরও সমৃদ্ধ করার উপায় ভাবতে হবে। দুনিয়াজোড়াই এসব ব্যবস্থাকে সমৃদ্ধ করার অব্যাহত প্রয়াস চলছে।
রায় পেয়ে আমরা খুশি। আবার উদ্বেগের কারণ রায়ে প্রধান বিচারপতিসহ সাত বিচারকই ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করতে ৭খ অনুচ্ছেদের ওপর জোর দিয়েছেন। কারণ, ৭খ অনুচ্ছেদটির আওতায় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকেও পরিবর্তনের অযোগ্য ঘোষণা করেছিল বিগত সংসদ। এ ঘটনার ৩ বছর ২ মাস ১০ দিন পরে তারা নিজেরাই ৭খ লঙ্ঘন করেছে। অবশ্য অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল মৌলিক কাঠামো নয়। তাই ৯৬ অনুচ্ছেদকে সংশোধন করতে সংসদের সামনে কোনো বাধা ছিল না। অথচ সংবিধানের ৭খ অনুচ্ছেদ বলেছে, সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা সংসদের হাতে থাকলেও সংবিধানের কতিপয় (প্রায় ৫০টি হবে) অনুচ্ছেদসহ সংবিধানের অন্যান্য মৌলিক কাঠামোসংক্রান্ত অনুচ্ছেদসমূহের বিধানাবলি সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন, রহিতকরণ কিংবা অন্য কোনো পন্থায় সংশোধনের অযোগ্য হবে।
মৌলিক কাঠামোর ধারণা মূলত বিচার বিভাগের উদ্ভাবন। গণতন্ত্র, আইনের শাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা যে মৌলিক কাঠামো তা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। এই উপমহাদেশে যেমন, তেমনি পশ্চিমা দুনিয়ার উচ্চ আদালতও এটা মানছে। কিন্তু এখন প্রশ্ন দাঁড়াল, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা যদি মৌলিক কাঠামো হয়, তাহলে বিচারক অপসারণ বা তাদের নিয়োগের কোনো একটিমাত্র নির্দিষ্ট পদ্ধতিকে অপরিবর্তনীয় মৌলিক কাঠামো বলা যাবে কি না? আমরা পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল যা ১৯৭৭ সালে সংবিধানে যুক্ত হয়েছিল এবং এখন তা আবার সেই আগের রূপেই ফিরে এসেছে, সেই বিষয়ে সংস্কারের প্রস্তাব নিয়েও বিভিন্ন সময়ে কথাবার্তা হয়েছে। আমরা একটি ইনহাউস পিয়ার রিভিউ কমিটি গঠনের পক্ষে মত দিয়েছিলাম। নতুন আচরণবিধিতে তার অন্তর্ভুক্তি আমাদের আশাবাদী করেছে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
[email protected]