রুশ নাগরিকেরা কেন বিদ্বেষের শিকার হবে

পশ্চিমা দেশগুলোতে রুশ পণ্য বর্জনের স্টিকার ও পোস্টারে এ ছবি ব্যবহৃত হচ্ছে

ইউক্রেনে ক্রেমলিনের আগ্রাসনের পর পশ্চিমা দেশগুলোতে রাশিয়ানদের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার ঢেউ (প্রকারান্তরে রুশবিদ্বেষ) বয়ে যাচ্ছে। রুশ শিল্পী, সংগীতজ্ঞ এবং চলচ্চিত্র নির্মাতাদের ইউরোপের বিভিন্ন অনুষ্ঠান এবং প্রতিযোগিতা থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে। এ গ্রীষ্মে কাতারে অনুষ্ঠেয় ফিফা বিশ্বকাপের বাকি বাছাইপর্বের ম্যাচগুলোয় রাশিয়ার জাতীয় ফুটবল দলের অংশগ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে। এ ছাড়া ইউইএফএ এ বছরের চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনাল খেলার ভেন্যু সেন্ট পিটার্সবার্গ (যেটি ভ্লাদিমির পুতিনের শহরও) থেকে প্যারিসে স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

ইতালির মিলানো-বিকোকা ইউনিভার্সিটি রুশ সাহিত্যের কিংবদন্তি লেখক ফিওদর দস্তয়েভস্কির ওপর বিদ্যমান থাকা একটি কোর্স স্থগিত করেছিল। পরে অবশ্য সমালোচনার মুখে সেই সিদ্ধান্ত থেকে তারা সরে এসেছে। বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশে খুচরা দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রাশিয়ায় তৈরি পণ্য বর্জন করছে এবং রাশিয়ান বংশোদ্ভূত গ্রাহকদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করছে বলে সংবাদমাধ্যমে খবর পাওয়া যাচ্ছে। মার্কিন কংগ্রেসে ডেমোক্রেটিক প্রতিনিধি এরিক সোয়ালওয়েল এবং রুবেন গ্যালেগো প্রকাশ্যে ‘প্রত্যেক রাশিয়ান শিক্ষার্থীকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বের করে দেওয়ার’ আহ্বান জানিয়েছেন কারণ এই শিক্ষার্থীরা তাঁদের ভাষায় ‘সবচেয়ে ধনী রাশিয়ানদের ছেলে-মেয়ে।’ আন্দাজ করা যায়, রাশিয়ায় নাগরিক অস্থিরতা বাড়ানোর এবং পুতিনের শাসনের বিরোধিতাকে উসকে দেওয়ার উপায় হিসেবে এসব করা হচ্ছে।

ব্যক্তিগত ঝুঁকি আছে জেনেও রাশিয়ার বেশ কয়েকটি শহরে অনেক রুশ নাগরিক যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ করেছেন। তাঁরা এ যুদ্ধকে তাঁদের প্রতিরক্ষার জন্য পরিচালিত যুদ্ধ বলে মনে করেন না। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন রাশিয়ান ভাষ্যকার ঘোষণা করেছেন, রাশিয়ান ফেডারেশনের নাগরিক হিসেবে তাঁরা এ কারণে লজ্জা বোধ করেন যে তাঁদের ট্যাক্সের অর্থে সাংস্কৃতিকভাবে ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী একটি দেশের শহরগুলোতে গুলি চালানো হচ্ছে।

ইউক্রেনে ক্রেমলিনের আগ্রাসনের পরিপ্রেক্ষিতে নির্বিচার রুশ নাগরিকদের বিরুদ্ধে এ ধরনের সাংস্কৃতিক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখানো শুধু বৈষম্যমূলক আচরণ নয়, বরং এটি খামখেয়ালি কাজও বটে। এটি পশ্চিমের প্রতি পুতিনের বিরুদ্ধতাপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিকে ন্যায্যতা দেওয়ার সুযোগ তৈরি করছে। এটিকেই তিনি পশ্চিমাবিরোধী প্রচারের হাতিয়ার করতে পারবেন।

প্রথমেই মনে রাখা দরকার, এটি ক্রেমলিনের যুদ্ধ, রাশিয়ানদের যুদ্ধ নয়। এটি একটি ‘চ্যান্সেলরি যুদ্ধ’ (এটি সমাজবিজ্ঞানী বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসনের চালু করা বাক্যাংশ) যার মাধ্যমে জনপ্রিয় রাশিয়ান জাতীয়তাবাদের সাফাই গাওয়া হচ্ছে। এই তথাকথিত আত্মরক্ষামূলক নীতি প্রমাণ করে, ইউক্রেনে ক্রেমলিন যা করছে তা ‘সরকারি জাতীয়তাবাদ’ (এই বাক্যাংশটিও অ্যান্ডারসনের কাছ থেকে ধার নেওয়া)। ‘সরকারি জাতীয়তাবাদ’ হচ্ছে এমন একটি নীতি, যা ‘রাষ্ট্র থেকে উদ্ভূত এবং রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষায় আপসহীন।’ অর্থাৎ, এ নীতি রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষার নামে সরকারকে যেকোনো কিছু করার নৈতিক অনুমোদন দেয়।

আরও পড়ুন

প্রকৃতপক্ষে ইউক্রেনে রাশিয়া যে যুদ্ধ চালাচ্ছে, তার মধ্যে ক্রেমলিনের ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন রয়েছে। কারণ, পুতিন অনেক আগেই খোলাখুলিভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তিকে ‘বিংশ শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ ভূরাজনৈতিক বিপর্যয়’ বলে অভিহিত করেছেন। সোভিয়েত ভাঙনের জন্য পশ্চিমাদের প্রতি যে রাশিয়া এখনো সংক্ষুব্ধ আছে, তা তিনি অনেকবার কথাবার্তায় প্রকাশ করেছেন। ইউক্রেন অভিযানের সঙ্গে সেই ক্ষোভের যোগসাজশ থাকা অস্বাভাবিক নয়।

তবে পুতিনের এ নীতির সঙ্গে রাশিয়ার সাধারণ মানুষের সবাই একমত নন। ব্যক্তিগত ঝুঁকি আছে জেনেও রাশিয়ার বেশ কয়েকটি শহরে অনেক রুশ নাগরিক যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ করেছেন। তাঁরা এ যুদ্ধকে তাঁদের প্রতিরক্ষার জন্য পরিচালিত যুদ্ধ বলে মনে করেন না। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন রাশিয়ান ভাষ্যকার ঘোষণা করেছেন, রাশিয়ান ফেডারেশনের নাগরিক হিসেবে তাঁরা এ কারণে লজ্জা বোধ করেন যে তাঁদের ট্যাক্সের অর্থে সাংস্কৃতিকভাবে ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী একটি দেশের শহরগুলোতে গুলি চালানো হচ্ছে।

দ্বিতীয়ত, রাশিয়ানদের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক প্রতিক্রিয়ার এ ঢেউ নৈতিকভাবে এবং বাস্তবিকভাবে অন্যায্য। কারণ, রাশিয়ান নাগরিকেরা নিজেরাই ক্রেমলিনের নীতির প্রাথমিক শিকার হয়েছেন। তাই অন্যায়ভাবে তাঁদের টার্গেট করা তাঁদের গণতান্ত্রিক পরিবেশে বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষাকেও দূরে সরিয়ে দেয়। পশ্চিমা সমাজগুলো স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে বলে মনে হয়। তবে এ কথাও সবাইকে মনে করিয়ে দেওয়া ভালো, বিশ্বের বেশ কয়েকটি সমাজ কখনো সত্যিকারের স্বাধীনতার স্বাদ পায়নি।

এ ক্ষেত্রে রাশিয়া একটি জুতসই উদাহরণ। কয়েক শতাব্দীর জারবাদী স্বৈরতন্ত্রের পর ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারির বিপ্লবে অস্থায়ী সরকার ক্ষমতায় এসেছিল। তাদের ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে জনগণের স্বাধীনতার একটি সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। পাভেল মিল্যুকভের নেতৃত্বে অস্থায়ী সরকার (এবং পরে যার নেতৃত্বে ছিলেন আলেক্সান্ডার কেরেনস্কি) রাশিয়ায় প্রথমবারের মতো সত্যিকারের বিপ্লবী সংস্কার (সর্বজনীন ভোটাধিকার, বাক্‌স্বাধীনতা, সমাবেশ করার অধিকার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও ধর্ম পালনের স্বাধীনতা) প্রবর্তন করেছিল। এসব সংস্কার চালু হয়েছিল যুদ্ধকালীন অবস্থার কথা মাথায় রেখে। তবু অস্থায়ী সরকার প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে রাশিয়াকে প্রত্যাহার না করে একটি ঐতিহাসিক সুযোগ হাতছাড়া করেছিল। এর ফলেই ১৯১৭ সালের অক্টোবরে বলশেভিক অভ্যুত্থানের পথ প্রশস্ত হয়েছিল, যা অবশেষে ৭৫ বছরের (১৯৭১-৯১) দীর্ঘ একদলীয় স্বৈরতান্ত্রিক একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল।

অস্থায়ী সরকারের অধীনে মাত্র আট মাস (ফেব্রুয়ারি ১৯১৭—অক্টোবর ১৯১৭) সময়কালের আধা উদারনৈতিক অভিজ্ঞতার পর রাশিয়া অতি সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য বরিস ইয়েলৎসিনের আমলে (১৯৯১ থেকে ১৯৯৯) একটি উদার শাসনব্যবস্থা (যদিও এটি একটি অত্যন্ত দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারে পরিণত হয়েছিল) পেয়েছিল। বাকিটা ইতিহাস। কারণ, ১৯৯৯ সাল থেকে ক্রেমলিনের এক ও অদ্বিতীয় প্রভু হয়ে আছেন ভ্লাদিমির পুতিন।

তৃতীয়ত, রাশিয়ানদের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক প্রতিক্রিয়ার এ ঢেউ ইউক্রেনীয় সংকটের প্রতি পশ্চিমের বর্ণবাদী প্রতিক্রিয়াকে প্রকাশ করে দিচ্ছে। রাশিয়া ইউরোপের একটি দেশে হামলা চালিয়েছে—শুধু এ কথা মাথায় নিয়ে ইউক্রেনের সমর্থন করা যাবে না। বরং দেশটি স্বাধীনতা, স্বতন্ত্র জাতিসত্তা এবং গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করছে—এ কারণে তার প্রতি পশ্চিমের সক্রিয় সমর্থন থাকা উচিত। প্রথম দিন থেকে কয়েক হাজার ইউক্রেনীয় উদ্বাস্তুকে ইউরোপের দেশগুলো উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছে। এটি প্রশংসনীয়। কিন্তু এখনো মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা এবং এশিয়ায় চলমান একই ধরনের সংকটের প্রতি তাদের মনোভাব ঠিক উল্টো। সেখানে মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে ইউরোপে আশ্রয় চাইলেও তাদের নিষ্ঠুরভাবে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

আরও পড়ুন

আরব বসন্ত এবং ২০১৬ সালের ১৫ জুলাই তুরস্কে রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানচেষ্টার সময় আরব ও তুরস্কের বাস্তুচ্যুত নাগরিকদের সঙ্গেও এ ব্যবহার করা উচিত ছিল। কিন্তু তা করা হয়নি। ইউক্রেনীয় শরণার্থীরা ইউরোপীয়—শুধু এ কারণে তাদের স্বাগত জানানো উচিত হবে না। বরং তারা তাদের দেশের আগ্রাসন এবং আক্রমণ থেকে পালিয়ে যাচ্ছে বলে তাদের আশ্রয় দিতে হবে।

দুর্ভাগ্যবশত ইউরোপীয় দেশগুলো ক্রেমলিন-সমর্থিত আসাদ সরকারের আগ্রাসন থেকে পালিয়ে আসা লক্ষাধিক সিরীয় উদ্বাস্তুর দুর্দশার প্রতি সমানভাবে সাড়া দেয়নি। বরং তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যদি ইউরোপীয় বা পশ্চিমা দেশগুলো বর্ণবাদ ও বৈষম্য দূর করার বিষয়ে সত্যনিষ্ঠ হয়, তাহলে এ বৈষম্যমূলক আচরণ থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে। একই সঙ্গে পুতিনের দোষে নির্বিচার রুশ জনগণকে সাজা দেওয়ার মানসিকতাও ছাড়তে হবে।

আনাদোলু এজেন্সি থেকে নেওয়া। অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

  • ইদির লিকা ইস্তাম্বুলের গেলিশিম ইউনিভার্সিটির পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্স বিষয়ের শিক্ষক